লেখা-লেখি

শরৎ তোমার অরুণ আলোর অঞ্জলি

১:০১:০০ PM 0 Comments






© সুনীতি দেবনাথ

মনে পড়ে আমাদের ছেলেবেলার স্কুল জীবনের বড়সড় দুটি একমাস করে ছুটির দিনের কথা। তপ্ত দারুণ প্রখর গ্রীষ্মের দিনে একটি মাসের ছুটি। শুরু হবার আগের দিনে বিরাট হলে 'এসো এসো হে বৈশাখ ' দিয়ে শুরু হতো মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। চলতো রবীন্দ্র সঙ্গীত., নৃত্য আবৃত্তির অনুষ্ঠান অর্ধেক দিন ধরে। পরদিন থেকে গ্রীষ্মের একমাস ছুটি। এরপর তাপদাহের অবসানে ' এসো শ্যামল সুন্দর ' বা ' হৃদয় আমার নাচেরে আজিকে ময়ূরের মত নাচেরে ' এসব গান যেন স্নিগ্ধ শ্যামল শোভন বর্ষার আবাহনী ও আনন্দধ্বনির বিস্তার ঘটাতো। আবার পুজোর ছুটি, 'শরৎ তোমার অরুণ আলোর অঞ্জলি '! আবার গান, আবার নাচ আবার আবৃত্তি! স্তুপে স্তুপে ঝরা শিউলির আনমনা  গন্ধ. আরো কত কি! আবার কবিগুরুর গানের সুরে শরৎ আসে মহা বিভাসে! এভাবে ছয়টি ঋতুর রঙমহল সেজে ওঠে রবীন্দ্র সঙ্গীতের কাব্য কথা সুর তালের বন্দিশে। এ যেন এক অপরূপ ক্যানভাসের বিশাল চত্বরে চত্বরে বর্ণ মহিমায় সুর আর কথার ভাববিলাসে চিত্রিত রূপমহল।
    কবিগুরুর সৃষ্টির জগৎ বড়ই বিচিত্র। কবিতা উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ, সঙ্গীত কি নেই সেখানে? বহুমুখী প্রতিভার অবদানের সৃষ্টির ভাণ্ডারকে তিনি সাজিয়েছেন থরেথরে। দীর্ঘ জীবৎকাল সত্ত্বেও বিস্মিত না হয়ে পারা যায়না এতোসব মৌলিক সৃষ্টি একজীবনের বিস্তৃতিতে কিভাবে সম্ভব হয়েছিল! সঙ্গীতের পরিসংখ্যানে চোখ বুলালে বিস্ময় যেনো বেপরোয়া হতে চায়। সঙ্গীতের কথা বা কাব্য অংশ যেমন নিজে অনন্য সুদক্ষতায় রচনা করেছেন, তেমনি সুরারোপও করেছেন নিজে। গায়করূপে কণ্ঠও দিয়েছেন তিনি।
     রবীন্দ্রনাথের সকল গান গীতিবিতান নামক সংকলন গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে। উক্ত গ্রন্থের ১ম ও ২য় খণ্ডে রবীন্দ্রনাথ নিজেই তাঁর গানগুলিকে ‘পূজা’, ‘স্বদেশ’, ‘প্রেম’, ‘প্রকৃতি’, ‘বিচিত্র’ও ‘আনুষ্ঠানিক’ – এই ছয়টি পর্যায়ে বিন্যস্ত করেছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পর গীতবিতান  গ্রন্থের তৃতীয় চতুর্থ এই দুই খণ্ডে অসংকলিত গানগুলি নিয়ে ১৯৫০ সালে উক্ত গ্রন্থের ৩য় ৪র্থ খণ্ড প্রকাশিত হয়। এই খণ্ডে প্রকাশিত গানগুলি ‘গীতিনাট্য’, ‘নৃত্যনাট্য’, ‘ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী’, ‘নাট্যগীতি’, ‘জাতীয় সংগীত’, ‘পূজা ও প্রার্থনা’, ‘আনুষ্ঠানিক সংগীত, ‘প্রেম ও প্রকৃতি’ ইত্যাদি পর্যায়ে বিন্যস্ত। এরপর প্রকাশিত হয় অখণ্ড গীতবিতানে সব গান নিয়ে।  ৬৪ খণ্ডে প্রকাশিত স্বরবিতান গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথের যাবতীয় গানের স্বরলিপি প্রকাশিত হয়েছে।
   কারো কারো মতে ১২ বছর বয়সে তিনি প্রথম গান রচনা করেন। আবার কেউ কেউ বলেন, ১৮৭৫ সালে ১৪ বছর বয়সে তাঁর গান রচনা শুরু হয়। এ সময়ে তিনি অগ্রজ জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের সরোজিনী নাটকের জন্য ‘জ্বল্ জ্বল্ চিতা দ্বিগুণ দ্বিগুণ’ গানটি রচনা করেন। এ বছরই  হিন্দুমেলা উপলক্ষে দুটি গান ‘হিন্দুমেলার উপহার’ নামে ছাপা হয়। এর একটি ‘তোমারি তরে, মা, সঁপিনু এ দেহ’ রবীন্দ্র-রচনা হিসেবে অবিসংবাদিত; কিন্তু অপরটি ‘এক সূত্রে বাঁধিয়াছি সহস্রটি মন’ জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত বা সুরারোপিত বলে অনেকের ধারণা।  জীবনের শেষ জন্মদিনের জন্য তিনি রচনা করেন ‘হে নূতন, দেখা দিক আর-বার জন্মের প্রথম শুভক্ষণ’ গানটি। এটি রচিত হয়েছিল ২৩ বৈশাখ ১৩৪৮ (৭ মে ১৯৪১), অর্থাৎ ৬৮ বছর যাবৎ রবীন্দ্রনাথ গানের পর গান  রচনা করে গেছেন । তাঁর গানের সংখ্যা ২২৩২ এবং সেগুলি অখন্ড গীতবিতান  গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে। পরবর্তী সময়ে কোন কোন গবেষক তাঁর গানের সংখ্যা ১৯১৫ বলে মতপ্রকাশ করেন তাঁদের মূল্যবান গবেষণায়।
       অবিসংবাদিত যে কবিগুরু বাংলা সাহিত্যে তথা প্রাচ্য সাহিত্যে শ্রেষ্ঠ প্রকৃতির কবি। পাশ্চাত্য কাব্য সাহিত্যে যেমন ওয়ার্ডসওয়ার্থ।  প্রকৃতি জগতের নাড়ীর স্পন্দনকে কবিদ্বয় তাঁদের সমগ্র সত্তা দিয়ে অনুভব করে তাঁদের কাব্যে অনিন্দ্যসুন্দর রূপকল্পে প্রকাশ করেছেন। রবীন্দ্রনাথের সমকালের ইউরোপীয় সাহিত্যে রোমান্টিসিজমের রমরমা চলছিল। সেই তরঙ্গের অভিঘাতে রবীন্দ্রনাথও আন্দোলিত হয়েছিলেন। তাঁর প্রকৃতিচেতনা আর রোমান্টিকতা একাকার হয়ে তাঁর কাব্যসাহিত্যকে যেমন, তেমনি সঙ্গীত সৃষ্টির জগতকেও প্রভাবিত করেছিল। মানুষের জীবন, যাপন, শিল্প, সংস্কৃতি, সভ্যতা সবকিছুই কোন না কোন ভাবে প্রকৃতি নিয়ন্ত্রিত হতে বাধ্য। প্রকৃতি তার সুগভীর মায়াঞ্জন মানুষের বিস্ময়াভিভূত চোখে মাখিয়ে যেন বলে আমাকে দেখো, দেখো তোমার জন্য সাজানো আমার রূপ - রস - শব্দ- স্পর্শ -গন্ধ আর স্বাদের ডালি! মুগ্ধ মানুষ প্রকৃতির সেই সৌন্দর্য ভাণ্ডারে অরূপের বর্ণ সুষমায় বিমোহিত হতে বাধ্য হয়। যাঁরা কবি, শিল্পী বা স্রষ্টা তাঁরা তাঁদের পঞ্চেন্দ্রিয়ের অতিরিক্ত ষষ্ঠেন্দ্রিয়ের সাহায্যে যেন আরো সুগভীরভাবে প্রকৃতিকে অনুভব করে নব নব রূপে সৃষ্টি করে যান।
       বাংলার প্রকৃতি তার শ্যামল কোমল সুমধুর রূপ মহিমায় সমগ্র বিশ্বে অতুলনীয়। রবীন্দ্র সমসাময়িক অবিভক্ত বাংলার রূপমহিমা যেন আরো অতুলনীয় ছিলো। প্রকৃতিতে দূষণ তখন আজকের মত প্রকট ছিলো না। আর কবি তো ছিলেন বিশুদ্ধ প্রকৃতিপ্রেমী সাধকতুল্য। বাংলার প্রকৃতি সুস্পষ্টভাবে বৈশিষ্ট্যের তারতম্য আর বৈচিত্র্যের বিভিন্নতায় ছয়টি ঋতু পর্যায়ে পৃথক হয়ে প্রকাশ পেতো। আজো পায়, তবু যেন কিছুটা ফারাক সৃষ্টি হয়েছে।
   বাংলা গানের আদিযুগ বলতে তো সেই চর্যাপদের যুগ।সেখানেও সঙ্গীতের সঙ্গে প্রকৃতিলগ্নতা পরিলক্ষিত হয়। আর মধ্যযুগের বিশাল প্রান্তরে কাব্য -সঙ্গীতের সঙ্গে প্রকৃতি জগতের যুগলবন্দী অনবদ্য। রবীন্দ্রনাথে এসে তা যেন পরিপূর্ণতা পেলো। বাংলার প্রথম ঋতু থেকে শুরু করে প্রতিটি ঋতুর সঙ্গে গানে গানে, সুরে সুরে কবির  প্রাণের বন্ধন, জীবনের বন্ধন,  জীবন দর্শনের অনিবার্য বন্ধন। প্রতিটি ঋতুকেই স্বাগত জানান তিনি প্রাণের আকুুতিতে। দাবদাহে কাতর তৃষ্ণার্ত গ্রীষ্ম যেন রুদ্র তাপস। সেই প্রখর দিনেও কবি ঋতুরঙ্গের গানে বলতে পারেন, ' চিত্ত পিপাসিত রে / গীত সুধার তরে।। ...' গ্রীষ্মের শেষ গানে কবি রচনা করে চলেন, 'চক্ষে আমার তৃষ্ণা ওগো তৃষ্ণা বক্ষ জুড়ে ...'।কবি আন্তরিক সকল আকুলতা নিয়েই আহ্বান জানালেন বর্ষার আগমনের, 'এসো শ্যামল সু্ন্দর /
আনো তব তাপহরা তৃষাহরা সঙ্গসুধা...'। ঋতু বিষয়ক গানের মধ্যে লক্ষণীয় সবচেয়ে বেশি সংখ্যক গান তিনি লিখেছেন বর্ষা ঋতুকে  নিয়েই। মোট ১১৫ টি গান। বর্ষা প্রকৃতি কেবল নয় সব ঋতুর প্রকৃতির সঙ্গে প্রেম ও পূজার ভাবের মিলিঝুলি আবেগ প্রবণতার জন্য ঘটেই যায়। আরেকটি বিষয় বলতে হয় কবিগুরুর প্রিয় ঋতু বুঝিবা বর্ষাই। বর্যার বর্ষণ, আকাশে ' মেঘের পরে মেঘের' সজ্জা সবুজের হিন্দোল মাখা শ্যামলী বঙ্গভূমিকে যখন স্নিগ্ধ শ্যামল করে তোলে, নদী নালা খাল বিলে পূর্ণতার ঢেউ ওঠে, তখন ' নীল আকাশে ' 'সাদা মেঘের ভেলা 'ভাসিয়ে আসে শরৎ। শরৎ ঋতুর গানের সংখ্যা সত্তরটি।
     ' আজি শরততপনে প্রভাতস্বপনে কী জানি পরান কী যে চায়। ...' শরৎ যেন পরিপূর্ণতার ঋতু, মনোরম ঋতু। শারদ প্রাতে স্বপ্ন মেশা সোনার আলো মন -প্রাণকে কি এক ব্যাকুলতায় ভরিয়ে তোলে! ' শরৎ তোমার অরুণ আলোর অঞ্জলি ...'।
শরতের ঝলমলে রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে কবি মন আনন্দে উচ্ছল হয়ে উঠত। 'ধানের ক্ষেতে রৌদ্রছায়ায় লুকোচুরি খেলা' র এই দিনে সবাইকে নিয়ে মেঘ কেটে যাবার রোদমাখা আনন্দের দিনে কবি মন মেতে উঠতে চায়। সবার সঙ্গে সেই বাঁধ ভাঙ্গা আনন্দের প্রকাশ ' ওরে, যাব না আজ ঘরে রে ভাই,  যাব না আজ ঘরে। / ওরে আকাশ ভেঙে বাহিরকে আজ নেব রে লুট ক'রে। যেন  জোয়ার - জলে  ফেনার রাশি   বাতাসে আজ ছুটছে হাসি, / আজ বিনা কাজে বাজিয়ে বাঁশি কাটবে সকল বেলা। ' বর্ষা দিনের বৃষ্টি বন্দি দিনগুলির পর যেন ছুটির ঘণ্টা বেজে ওঠে শরতের এই আলোকোজ্জ্বল দিনগুলিতে। চারদিকে, বিশেষ করে ' ধানের ক্ষেতে রৌদ্রছায়ার লুকোচুরি খেলা ' কবি মনকে উদ্বেলিত করে তোলে। মেঘমুক্ত  আকাশে কবির মনে হয় কে ভাসিয়েছে 'শাদা মেঘের ভেলা ', আকাশ হয়ে ওঠে সুনীল-সুন্দর-দৃষ্টিনন্দন। সাদা মেঘের ভেলার সাথে কবি মনও ভেসে বেড়ায় দিগ থেকে দিগন্তে। নদীচরে চখা-চখির মেলা কবিমনকে ডাকে অবিরাম। শিশিরভেজা ঘাসে সূর্যালোকের মধুর হাসি, আদিগন্ত ধানের ক্ষেতে বিপুল মঞ্জরি, নদীচরে, প্রান্তরে কাশফুলের দুলুনি, শিশির সিক্ত সুগন্ধি  শেফালির ঝরে পড়া, আর তাদের শুভ্রতার সৌন্দর্যে কবিকে অপার্থিব আনন্দ আর অনির্বচনীয় খুশির জোয়ারে ভাসায়। প্রকৃতির জগতে রূপসাগরে ডুব দিয়ে কবি যেন অনিবার্যভাবে বারবার ব্যাকুল হয়ে উঠেছেন শারদলক্ষ্মীর আবির্ভাব কামনায় । শেফালির শুভ্রতা অনুভব করেছেন শারদলক্ষ্মীর মঙ্গলমূর্তি- খানিতে।  আবার শিশিরের ক্ষণিকতা অনুভব করেছেন জীবনের অনুষঙ্গে।
সবকিছুর ঊর্ধ্বে শরতের রৌদ্রোজ্জ্বল দিন, মেঘমুক্ত আকাশ, শুভ্র শেফালি ও শিশিরে রোদের জ্বলে ওঠার মাঝে কবির চেতনাস্রোত প্রবাহিত ।
         ভাদ্র আর আশ্বিন এ দুটি মাস নিয়ে আমাদের শরৎ একান্তই আমাদের ঋতু। সারাটা উত্তর গোলার্ধের আর কোথাও শরৎ নেই।নেই এমনি ' শরৎ তোমার অরুণ আলোর অঞ্জলি ...'! শরৎ প্রাতে দু 'হাতের অঞ্জলিপুটে যেন তরলিত সোনার আলো ধরতে চাই! আঙুলের ফাঁকে গলে গলে সে আলো ছড়িয়ে যায় আমাদের অঙ্গনে, আকাশে, বাতাসে! হেসে ওঠে শারদ প্রকৃতি শিউলির সুবাসে, শিশিরের আনমনা মুক্তো বিভাসে, টলমলে স্বচ্ছতোয়া নদী দিঘীতে বিল হাওয়ের জলে। নানা রঙের শাপলা পদ্ম ফুলগুলি হাসতে থাকে দুলতে থাকে। কাশের বনে লাগে মুক্ত হাওয়ায় মাতন। নেচে নেচে ওঠে সবুজে সবুজে ধান ক্ষেতের আনন্দ লহরী। আর দূরের নীলাকাশ জল আয়নায় মুখ দেখতে গিয়ে আকুল ব্যাকুল হয়ে সাদা মেঘের ভেলায় এদিকে ওদিকে শুরু করে মাতন! মাঝেমধ্যে দু 'এক পশলা রিমঝিম ইলশেগুঁড়ি, হাসতে হাসতে অতি আনন্দে ঝরঝরিয়ে কেঁদে ফেলা! মহাপ্রকৃতির এই একান্ত অবসরে, প্রেক্ষিতে দার্শনিক মহাকবি উদাস হলেন, অনুভূতির গভীরে নাড়া লাগলো।দার্শনিক কবি প্রকৃতি ও জীবনের আন্তপ্রক্রিয়ায় অনুভব করলেন তিনি এই অনুষঙ্গে গান গাইতেই তো এসেছেন। আমরা পেয়ে গেলাম পরম সম্পদ একগুচ্ছ শারদ সঙ্গীত!





কাজরী,
৩০ আগস্ট, ২০১৬

    

SUNITI Debnath

আমি সুনীতি দেবনাথ, অবসরপ্রাপ্ত সরকারি শিক্ষিকা। কবিতা, প্রবন্ধ ও ছোটগল্প লিখি। কবিতা আমার প্রিয়ভূমি, শৈশব থেকেই হেঁটে চলেছি...

0 comments: