লেখা-লেখি

কবি সুনীতি দেবনাথের ' কালপুরুষ ' কবিতার সমালোচনা

৬:৩১:০০ PM 0 Comments




















উত্তমকুমার রায়

কবি সুনীতি দেবনাথের আলোচ্য কবিতাটির নাম 'কালপুরুষ' । কালপুরুষের আভিধানিক অর্থ পুরুষাকৃতি নক্ষত্রবিশেষ । আদ্রা, কার্তিকেয়, চিত্রলেখ, অনিরুদ্ধ, ঊষা, কার্তবীর্য ও রাণরাজা এই সাতটি নক্ষত্রের সমন্বিত রূপকে বলা হয় কালপুরুষ । যোদ্ধার হাতে যেমন থাকে ঢাল ও তরবারি, তদ্রূপ কালপুরুষের হাতেও থাকে ঢাল ও তরবারি; তবে তা নক্ষত্রের আলোয় আলোকিত ঢাল ও তরবারি । ইংরেজিতে এই কালপুরুষকে বলা হয় Orion.

রাতের আকাশে সাতটা নক্ষত্রের আলোকসজ্জিত সমাবেশই কালপুরুষ বলে পরিচিত । এই সাতটি নক্ষত্রের অবস্থান ও তাদের আলোকসজ্জা দেখতে ঢাল-তরবারি হাতে এক যোদ্ধা বলেই আমাদের কাছে মনে হয় । যুগ যুগ ধরে কালপুরুষ নাম্নী যোদ্ধা প্রত্যক্ষ করে যাচ্ছে পৃথিবীর ভাঙাগড়ার ইতিবৃত্ত । প্রকৃতপক্ষে কালের সাক্ষী কালপুরুষ । একজন দৃঢ়সংকল্পচেতনাধারী যোদ্ধার যেসব গুণাবলী থাকে তাই রয়েছে এই ক্ষমতাধর কালের সাক্ষী কালপুরুষের ।

পৃথিবী নামক এই গ্রহের রয়েছে বিড়ম্বিত অস্তিত্ব । একসময় এই পৃথিবীতে সুস্নিগ্ধ নরম বাতাস চঞ্চল পায়ে ঘুঙুরের মতো বাজতো, আকাশ দেখে সফেন সমুদ্র খিলখিল হেসে ভীষণ গর্জনে উদ্বেলিত হয়ে উঠতো । অথচ পৃথিবীতে আজ সব থেকেও যেন কিছুই নেই । মানুষ আজ প্রেম-ভালোবাসা ভুলে গিয়ে আদিম পশুত্বের কাছে সঁপে দিয়েছে জীবন । অরাজকতার একটা বিষম সময় হাজির হয়েছে এ পৃথিবীর বুকে । সর্বত্রই একটা যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব দেখা যাচ্ছে । এই যুদ্ধে নির্ণীত হবে মানুষের বিবেক মনুষ্যত্বে অধিষ্ঠান করবে নাকি ধ্বংসের পরিণতি ডেকে আনবে । এই যুদ্ধে স্থির হবে মানুষ এই পৃথিবীর উত্তরাধিকার পাবে না ধ্বংস ডেকে আনবে ।

কবি আশাবাদী । এই যুদ্ধে কালপুরুষের অক্ষয় আলোর দুর্দম তরবারি মানুষের হাতে এলে বৈষম্যের ওই উঁচু দেয়াল ভেঙে চুরমার করতে পারবে । মানুষ আবার মানবাত্মার অভিযানে উড়াতে পারবে তাদের বিজয়নিশান । পৃথিবীতে মানবতার জয়ই কবিতাটির মূলসুর । কবির ভাষায় -

মানুষ আবার মহামানবাত্মার অভিযানে
উড়াবে জয় পতাকা অসীম সূর্যালোকে,

কবিতাটির শব্দশৈলী অপূর্ব । শব্দের সুনির্বাচনে কবিতাটি ভিন্নমাত্রা পেয়েছে । এ কবিতার বিশেষ আকর্ষণ নান্দনিকতা । কালপুরুষ তো আলো দিয়ে তৈরি যোদ্ধা - রাতের অন্ধকারে অপরূপ  আলোয় আলোকিত । এই আলোই পৃথিবীর যাবতীয় অন্ধকার দূর করে আলোয় আলোকময় করে তুলবে পৃথিবী ।

      নক্ষত্রের ঢাল হাতে নাক্ষত্রিক তরবারি

কী অপরূপ নান্দনিকতা ! আবার কল্পনায় চিত্র বা ছবি ভেসে আসছে তাই এটি চিত্রকল্প ।
কবিতাটি যুগের চাওয়া । মানুষের মুক্তির পথপ্রদর্শক । পৃথিবীতে মানবাত্মার শান্তি ফিরে আসুক, সাম্য আসুক - এটাই মূর্তিমান হয়ে দেখা দিয়েছে কবিতায় ।

কবিতায় আছে উপমা । যেমন -

তোমার অক্ষয় আলোর দুর্দম তরবারি

কবিতাটি ইমেজ বা চিত্রকল্পে আধুনিক কবিতার বৈশিষ্ট্য ধারণ করছে । যেমন -

1. মোলায়েম সুস্নিগ্ধ নরম বাতাস
    চঞ্চল পায়ে কেমন ঘুরে ঘুরে ঘুঙুরের মত
    বাজতো,

2. সফেন তরঙ্গে সমুদ্র খিলখিল হেসে
    আকাশ দেখে ঈর্ষাতুর আক্রোশে ফুঁসে
    ভীষণ গর্জনে উদ্বেলিত হয়ে উঠতো ।

3. মহাকাশ থেকে চূর্ণ আলোক কণা কণা
    অঝোর ধারায় ঝরে প্রাণের মহাপ্লাবনে

রয়েছে অনুপ্রাস । যেমন -

রক্তে আন্দোলিত হবে জরাজীর্ণ
সংকীর্ণ সংস্কারের সুউচ্চ মিনার ভাঙার
প্রতিজ্ঞা প্রখর অবলুণ্ঠিত আত্মার

সবশেষে বলবো, কবিতাটির শব্দবিন্যাস চমৎকার, নান্দনিকতায় অপূর্ব, চিত্রকল্পে অসাধারণ । সর্বোপরি মানবাত্মার বিজয়নিশানই কবিতাটিকে সার্থক করে তুলেছে । আন্তরিক ধন্যবাদ কবিকে এমন একটি নান্দনিক ও মানবতার জয়গানমুখরিত কবিতা উপহার দেওয়ার  জন্য ।

বক্ষ্যমান কবিতাটি -

কালপুরুষ
 =========
      © সুনীতি দেবনাথ

কোন্ যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়েছ তুমি
হে কালপুরুষ ! কালের অতন্দ্র প্রহরী !
সেজেছো কী অদ্ভুত অলৌকিক সাজে,
তোমার ভয়াবহ প্রস্তুতি কাঁপিয়ে দেয়
আমাকে আমার লৌকিক এই জগৎকে,
বিড়ম্বিত অস্তিত্ব নিয়ে আমি রুদ্ধশ্বাস !

নাক্ষত্রিক অত্যুজ্জ্বল দ্যুতি তোমার
চোখে
সারাটা অবয়বে কুচি কুচি কদম্বরেণু
নক্ষত্রের দানা সংখ্যাতীত নক্ষত্র সমাবেশে।
নক্ষত্রের ঢাল হাতে নাক্ষত্রিক তরবারি !
অন্ধকারে আলোর দৃষ্টিতে তবু নিরন্তর
মাটির পৃথিবী দেখো বিস্ময়ের দৃষ্টিতে,
যুগের পর যুগ চেয়েই আছো নিষ্পলক ।

এই আমার গ্রহকে ঘিরে বহুকাল আগে
মোলায়েম সুস্নিগ্ধ নরম বাতাস চঞ্চল পায়ে
কেমন ঘুরে ঘুরে ঘুঙুরের মত বাজতো,
সফেন তরঙ্গে সমুদ্র খিলখিল হেসে
আকাশ দেখে ঈর্ষাতুর আক্রোশে ফুঁসে
ভীষণ গর্জনে উদ্বেলিত হয়ে  উঠতো ।

আজ সবই আছে তবু কিছুই তো নেই,
প্রেম ভুলে মানুষ আজ পাল্লা দিয়ে
আদিম পশুত্বের কাছে দাসত্বের এক
অভিনব খতনামা নির্বিচারে দিচ্ছে সঁপে
অরাজকতার এই বিষম কালে একটা
অনিবার্য যুদ্ধ দামামার ক্ষীণ ধ্বনি
ইথারে ইথারে কেবলই ঘুরছে ভীষণ,
এবার একটা যুদ্ধ হবেই হবে নিশ্চিত ।

বিষম এই যুদ্ধে হে কালপুরুষ,
নির্ণিত হবেই পৃথিবীর অনাগত দিনের স্বরলিপি
মানুষ বিবেক মনুষ্যত্বে অধিষ্ঠান করবে
নাকি ধ্বংস হবে সব কিছু  পুরোনো সব
মূল্যবোধ বোধোদয়ের প্রাথমিক পাঠ,
অতীতের ছায়াচ্ছন্ন ঐতিহ্যের ইতিহাস,
দর্শনের প্রাজ্ঞবাণীর সুমিত উত্তরাধিকার
আরো সবকিছু সঞ্চিত সভ্যতার সম্পদ,
এই যুদ্ধে স্থির হবে মানুষের পৃথিবীর
উত্তরাধিকারের জয়যাত্রা নাকি বিনাশ ।

এই ভয়ঙ্কর ক্রান্তিকালে হে কালপুরুষ !
তোমার অক্ষয় আলোর দুর্দম তরবারি
দাও মানুষের হাতে, শীতল চেতনায়
মস্তিষ্কের কোষে জ্যোতিষ্কের কোলাহল,
ঐ উঁচু দেয়ালটা ভেঙে চুরমার করবে
চৈতন্য পথিক জনতা আত্মাকে  চিনে,
রক্তে আন্দোলিত হবে জরাজীর্ণ
সংকীর্ণ সংস্কারের সুউচ্চ মিনার ভাঙার
প্রতিজ্ঞা প্রখর আর অবলুণ্ঠিত আত্মার
পুনরুত্থানের আলোকিত অভিনব পথ ।
মানুষ আবার মহামানবাত্মার অভিযানে
উড়াবে জয়পতাকা অসীম সূর্যালোকে,
মহাকাশ থেকে চূর্ণ আলোক কণা কণা
অঝোর ধারায় ঝরে প্রাণের মহাপ্লাবনে
মহাকালের অবাধ স্রোতে আলোড়িত
স্পন্দিত হয়ে চল চঞ্চলতায় হাসবেই ?
হে কালপুরুষ, সিঁড়ি ভেঙ্গে স্বপ্নের সেই
পুনরুত্থান দ্রোহের কুচকাওয়াজে
ক্ষুদ্রতা পেরিয়ে যুদ্ধশেষে পৌঁছে যাবে
মানুষের কলোচ্ছ্বাসে মুখরিত সৈকতে ।■

SUNITI Debnath

আমি সুনীতি দেবনাথ, অবসরপ্রাপ্ত সরকারি শিক্ষিকা। কবিতা, প্রবন্ধ ও ছোটগল্প লিখি। কবিতা আমার প্রিয়ভূমি, শৈশব থেকেই হেঁটে চলেছি...

0 comments: