লেখা-লেখি

বিশ্বের প্রথম ভাষা শহীদ নারী : কমলা ভট্টাচার্য্য

১১:২২:০০ PM 0 Comments























© সুনীতি দেবনাথ

মাতৃভাষা বাংলার জন্য প্রথম নারী শহীদ হবার কাহিনীর সৃষ্টিকারিণী বিশ্বে ষোল বছরের নারী কমলা ভট্টাচার্য্যের নাম সমগ্র বিশ্ব  ইতিহাসে সোনার আখরে লেখা থাকবে।  নিদারুণ বেদনার্ত কাহিনীর বীরাঙ্গনা নায়িকা চিরদিনই শিলচরবাসীর মনে যেমন, তেমনি মাতৃভাষাপ্রেমী সকল মানুষের মনে জাগ্রত থাকবেন। ১৯৬১সালে রবীন্দ্র শতবার্ষিকী বর্ষে উনিশে মে অসমের কাছাড় জেলার সদর শিলচর শহরের রেলস্টেশনে বাংলা  ভাষার সরকারী স্বীকৃতি দাবীর আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে শহীদ হন এগার জন। সেই এগারোজন শহীদের একজন এবং একমাত্র নারী কমলা। কমলা ভট্টাচার্য্য ভাষার জন্য শহীদ পৃথিবীর প্রথম  নারী।  তথ্যটি পশ্চিমবাংলার বেশিরভাগ বুদ্ধিজীবী বিশেষ করে শিল্প সাহিত্যের সঙ্গে জড়িত মানুষদের অজানা। কিছুসংখ্যক যাঁরা জানেন তাঁরাও না জানার ভান করেন বা এড়িয়ে যান। তাই ভিয়েতনাম, লাতিন আমেরিকা, প্যালেস্তাইন,সিরিয়ার জন্য পাতা ভরানো বাঙালী কবির কলমে  মনীষ ঘটক বনফুলের মত দু' চারজন বাদে শিলচরের ঘটনা স্থান পায় নি। পশ্চিমবঙ্গে বা বাংলার কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন গবেষণাপত্র লেখা হয় নি। কলকাতায় ২১শে স্মরণে বেদী আছে কিন্তু ১৯শে সম্পর্কে লক্ষণীয়ভাবে  ঔদাসীন্য দেখি । আর বাংলাদেশে এমন উদাসীনতা বা অনুল্লেখ থাকাটা বিচিত্র বিষয় হতে পারে না।
   
 ১৮৭৪ সালে বাংলাভাষী শ্রীহট্ট জেলা অসম প্রদেশের সঙ্গে যুক্ত হয়। অসমে এক সময় সরকারী ভাষা ছিল বাংলা। পরে অসমীয়া ভাষা প্রধান সরকারী ভাষা ঘোষিত হলেও সমগ্র অসমে বাংলা চালু ছিল সরকারী স্তরে দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় এক বিতর্কিত গণভোটে শ্রীহট্ট জেলাকে অসম থেকে বিচ্ছিন্ন করে পূর্বপাকিস্তানের অন্তর্ভূক্ত করা হয়, শুধু কাছাড় অংশ ভারতে থেকে যায় অসমের একটি জেলা হিসেবে। একশ শতাংশ বাংলাভাষী কাছাড় জেলায় বাংলাই ছিল প্রধান সরকারী ভাষা। ১৯৬০ সালে অসম সরকার অসমীয়াকে একমাত্র সরকারী ভাষা হিসেবে ঘোষণা করে। এই ঘোষণার বিরুদ্ধে বাংলা ও অনান্য স্থানীয় ভাষার স্বীকৃতির দাবীতে কাছাড়কে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে এক প্রবল ভাষা আন্দোলন।

  প্রতিক্রিয়ায় অসমীয়া গরিষ্ঠ অঞ্চলে বাঙালীদের ওপর নেমে আসে প্রচণ্ড অত্যাচার। অসমের বাংলাভাষী মুসলমানেরা তাদের মাতৃভাষা অসমীয়া ঘোষণা না করলে তাদের পাকিস্তানে পাঠানো হবে এই ভয় দেখানো হয়।   ২০১১ সালের সেন্সাসে বাংলাভাষী মুসলমানরা যাতে তাঁদের মাতৃভাষা অসমীয়া ঘোষণা করেন তারজন্য সম্মেলনও হচ্ছিলো এবং অসমের বাংলাভাষী মুসলমানরা এই ব্যাপারে বর্তমানে কিছুটা দ্বিধা বিভক্ত।এই বিষয় সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র।  এটা বাংলাভাষার আন্দোলন নয় বাঙালী হিন্দুর মুসলিম বিরোধী কার্য্যকলাপ বলে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগানো হয়। দাঙ্গা, দমন পীড়নকে অগ্রাহ্য করে বাংলাভাষার দাবীতে রাস্তায় নামেন কাছাড় জেলার সর্বস্তরের মানুষ।

১৯৬১র ১৪ই এপ্রিল (১লা বৈশাখ)পালিত হয় সংকল্প দিবস। ১৯শে এপ্রিল থেকে পদযাত্রা শুরু হয় সারা জেলা জুড়ে। ১৮ই এপ্রিল ছাত্র সমাবেশ, বিশাল মশাল মিছিল হল করিমগঞ্জে, শিলচরে।  ফেব্রুয়ারীর আন্দোলনের মত এখানেও ছাত্ররা সামনের সারিতে। পরে ১৯শে মে, পালিত হবে অসহযোগ দিবস, স্তব্ধ হবে সারা রাজ্য বাংলা ভাষার জন্য।

    শ্রীহট্ট নন্দিনী কমলা ভট্টাচার্য্যের পিতা ছিলেন রামরমণ ভট্টাচার্য্য ও মাতা সুপ্রভাসিনী দেবী। দেশ ভাগের শিকার  কমলাদের পরিবার শ্রীহট্ট থেকে কাছাড়ে আসে ১৯৫০ সালে। পিতা মৃত। অভাবের পরিবারে দুবেলা পেটভরা অন্ন জুটতো না। চার বোন, কমলা তৃতীয়। তাঁর জন্ম হয়েছিল ১৯৪৫ সালে।  তিন ভাই – দু'জন কমলার বড়, বকুল ছোট। দ্বিতীয় বোন (সেজদি) প্রতিভা এক স্কুলের শিক্ষিকা, তাঁর আয়ে কোনমতে সংসার চলে। পড়ার ব্যয় নির্বাহের পথ ছিলো না। তবু জেদ ছিলো কমলার তিনি  গ্র্যাজুয়েট হবেনই।  সেই জেদ থেকে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় বসা, টাইপ রাইটিং শেখার উদ্যোগ নেওয়া  —আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে থেকেই।
 
 ম্যাট্রিক পরীক্ষা শেষ। পরদিনই পিকেটিংএ যাবার জন্য তৈরি কমলা। এ এক বিশেষ দিন, এই পিকেটিং সারা কাছাড়  স্তব্ধ করে দেবে ভাষার জন্য। বাঙালী সব কিছু করতে পারে। কমলাকে যেতে বাধা দেন মা সুপ্রভাসিনী। কমলা তা মানেননি। সেজদির স্কুলে যাবার জন্য কেঁচে ধুয়ে রাখা কাপড়টা পরে প্রস্তুত কমলা। দলবল এলো বলে। ২০-২২ জন মেয়ের একটা দল এসেছে বাড়িতে, কমলাকে ডাকতে। এবার সেজদিও মানা করে।ওরা বলে কিছু হবে না,  ওরা থাকবে রেলস্টেশনে। সকালের ট্রেন আটকে দিলে সারা দিন সব বন্ধ। পায়ে পায়ে বেরিয়ে আসে কমলা। ইতিমধ্যে ছোটবোন মঙ্গলাও সাথ নিয়েছে। 'চল, তুইও চল। কিছু খেয়ে গেলে হত না?' মার মুখ দেখে বুঝলেন ঘরে কিছু নেই। খাবার দিতে না পারলেও মা কমলাকে একটা বড় কাপড়ের টুকরো দিয়ে দিলেন। 'সাথে রাখিস, কাঁদানে গ্যাস ট্যাস ছোড়ে যদি'।কমলার সাথে বেরিয়ে পড়ে কমলার ছোট বোন মঙ্গলা, ছোট ভাই বকুল, ও বড়দির ছেলে বাপ্পা। দুপুরবেলা কমলার মা দুশ্চিন্তা করতে করতে স্টেশনে গেলেন   । যাবার পথে একটা পুলিশের গাড়ি তাঁকে ধূলি ধুসরিত করলো। মাকে দেখতে পেয়েই ছুটে আসেন কমলা, মায়ের ধূলিধুসরিত পা ধুয়ে দিয়ে, শরবত খেতে দেন। মায়ের সমস্ত দুশ্চিন্তা দূর  করে মাকে বাড়ী পাঠিয়ে দেন।
   
  কিছুক্ষণের মধ্যে স্টেশনে আবহাওয়া পালটে যায়। সকাল থেকে কতগুলো ট্রেন আটকানো হল। কোন গণ্ডগোল  নেই। সবাই মিলে বাংলাভাষা চালু করার স্লোগান দিয়ে রেললাইনে বসে পড়লেই হলো। এবার যেন অন্যরকম। পুলিশের সংখ্যা হঠাৎ বেড়ে গেছে স্টেশনে। ওরা লাঠি আর বন্দুকের বাট দিয়ে মারতে শুরু করল আন্দোলনকারীদের। কিন্তু পিকেটিং ছেড়ে নড়ছে না কেউ। মার, কত মারবি।সকালে রেল অবরোধ কর্মসূচী শান্তিপূর্ণভাবেই সমাধা হয়। যদিও অবস্থানের সময়সূচী ছিল সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা, কিন্তু শেষ ট্রেনটি ছিল বিকেল ৪টা নাগাদ, যার পরে  গণ অবস্থান স্বভাবতই শিথিল হয়ে যাবার  কথা। কিন্তু দুপুরের পর থেকেই অসম রাইফেলসের জওয়ানরা জায়গাটাকে ঘিরে ফেলতে শুরু করে। বেলা ২-৩৫ নাগাদ বিনা প্ররোচনায় তারা অবস্থানকারী ছাত্রছাত্রীদের নির্মমভাবে লাঠি ও বন্দুকের কুঁদো দিয়ে পেটাতে থাকে। এলোপাথাড়ি লাঠিচার্জে অবস্থানকারী জনতা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় ও দিকবিদিক জ্ঞানশুন্য হয়ে যে যেদিকে পারে পালাতে থাকে। কমলার ছোটবোন মঙ্গলা পুলিশের লাঠির ঘায়ে মাটিতে পড়ে যায় ও সাহায্যের জন্য কমলার উদ্দেশ্যে চিৎকার করতে থাকে। ইতিমধ্যে অসম রাইফেলসের জওয়ানরা পলায়নরত জনতার উপর গুলিবৃষ্টি শুরু করে। মঙ্গলাকে বাঁচাতে কমলা ছুটে গেলে একটি গুলি তাঁর ডান চোখ ভেদ করে  মাথা চুরমার করে দেয়। অন্যান্য আহত ও গুলিবিদ্ধ অবস্থানকারীদের সাথে কমলাকেও হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে সেখনেই তাঁর মৃত্যু হয়। মঙ্গলাকে সংজ্ঞাহীন অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এক মাস বাদে তার জ্ঞান ফিরলেও বাকি জীবনটা পঙ্গু  হয়ে  গেলো।
 
ছোট শহর শিলচর। রেলস্টেশনে গুলি চলেছে। নিহত অনেক, আহত আরো প্রচুর। মানুষ ভীড় করে হাসপাতালে। ইতিমধ্যে সবাই জেনে গেছে কমলার গুলি লেগেছে। জীবিত না মৃত নিশ্চিত নয় কেউ। হাসপাতাল ঘিরে রেখেছে পুলিশ, মেয়ের দেখা পেলেন না সুপ্রভাসিনী। কমলার সঙ্গীরা কান্নায় ভেঙে পড়ে তাঁর সামনে। 'নিয়ে গিয়েছিলাম আপনার মেয়েকে, ফেরত আনতে পারলাম না '। পাথরের মতন নীরব হয়ে বসে থাকেন তিনি। হঠাৎ মনে পড়ে মঙ্গলার কথা, মঙ্গলা কোথায়? মঙ্গলার কথা কেউ বলছে না কেন?
    মঙ্গলাও তখন হাসপাতালে। পুলিশের লাঠি ও বন্দুকের কুঁদোর আঘাতে বীভৎসভাবে আহত, সংজ্ঞাহীন। মঙ্গলার জ্ঞান ফিরলো একমাস পর, তারপর সারাজীবন বয়ে বেড়ালো পুলিশী অত্যাচারের যন্ত্রণা, বেঁচে থাকলো হাড় জিরজিরে রোগা শরীরে চিররুগ্ন হয়ে।
    কমলার মৃত্যুশোকে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছিলেন মা সুপ্রভাসিনী। ঘুম হতো না। ঘুমোলে স্বপ্নে ভেসে উঠত কমলার মুখ, তাঁর জেদী ঘোষণা-—গ্র্যাজুয়েশন তিনি নেবেনই। ঘুম ভেঙে উঠে বসতেন। কাছাড়ের ডিসি এসেছিলেন আর্থিক সাহায্যের প্রস্তাব নিয়ে, নেন নি। 'যারা গুলি করে মেরেছে আমার মেয়েকে তাদের হাত থেকে নেব সাহায্য? কখনও  নয়'। ছুটে যান বাড়ির ছাদে। মানসিক ভারসাম্য না থাকায় পড়ে যান ছাদ থেকে। সেই থেকে মনোবিকার চিরস্থায়ী। অবস্থার উন্নতি হবে ভেবে তাঁকে শিলচর থেকে গুয়াহাটি নিয়ে যান বড় ছেলে রামেন্দ্র ভট্টাচার্য্য। লাভ হয়নি। মানসিক ভারসাম্যহীন অবস্থায় মৃত্যু হয় শহীদ জননীর।

সেজদি ও মঙ্গলা দু'জনের বিয়ে হয়েছিল। তাঁরাও চলে গিয়েছিলেন গুয়াহাটি। পুলিশী অত্যাচারের যন্ত্রণা সঙ্গ ছাড়েনি সারা জীবন। যাঁর শাড়ি পরে শহীদ হয়েছিলেন কমলা, সেই সেজদিও পরবর্তী জীবনে মানসিক সমস্যার শিকার হন, বিশেষ করে কেউ কমলার কথা বললে সেই সমস্যা আরো প্রকট হত।
   বড়দি বেণু চক্রবর্তী পরে আবার চেষ্টা করেছিলেন কিছু সরকারী সাহায্য যোগাড় করতে এই বিধ্বস্ত পরিবারটির জন্য। পারেননি। তবে বড়দির আসল দুঃখ ছিলো স্বীকৃতির প্রশ্নে। বাংলাভাষার মূল স্রোতের কাণ্ডারীরা কমলার আত্মত্যাগকে কোনদিন যথোচিত সম্মান দেন নি। অনেক চেষ্টা করা হয় যাতে এগারো জন নিহতের ভাষা শহীদ স্বীকৃতি সরকারীভাবে প্রদান করা হয়। দীর্ঘদিন ধরে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক মঞ্চ শহীদদের সম্মান প্রদর্শনের জন্য শিলচর স্টেশনের নাম 'ভাষা শহীদ স্টেশন' রাখার দাবি করছিলেন। অবশেষে ২০১১ সালে ভারত সরকার সে দাবি মেনে নেন।

২০১১ সালে, ভাষা আন্দোলনের পঞ্চাশ বছর পূর্তি উপলক্ষে শহীদ কমলা ভট্টাচার্য্যের মূর্তি স্থাপন কমিটির পক্ষ থেকে গোপা দত্ত আইচ ছোটেলাল শেঠ ইন্ষ্টিটিউটের প্রাঙ্গণে কমলার একটি ব্রোঞ্জের আবক্ষ মূর্তি উন্মোচন করেন। এই বিদ্যালয়ের ছাত্রী ছিলেন কমলা।

  এমন দিন আসতে পারে হয়তো দুই বাংলার শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতির ধারক বাহকেরা অনুভব করতে পারবেন যে কমলা ও তাঁর দশ সাথীর জীবন বলিদান ২১শের চার শহীদের মতন চিরস্মরণীয়। হয়তো একদিন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ এবং অসম কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ ১৯৬১ -র ১৯ শে মে নিয়ে গবেষণা করার মতন প্রাজ্ঞতা অর্জন করবে, মহান কোন কবির কলমে শিলচর স্টেশনের মহাকাব্য রচিত হবে,হয়তো পশ্চিম বাংলা মে মাসকে বাংলা ভাষার মাস হিসেবে চিহ্নিত করবে, হয়তো কোন নারীবাদী সাহিত্যে কমলার কথা লেখা হবে, হয়তো  গৌহাটী -কলকাতা শহরের কোন রাস্তার নামফলকে শোভা পাবে কমলার নাম, হয়তো আরো শ্লাঘনীয় অনেক কিছু ঘটতে পারে, নাও পারে। আমরা বাংলা ভাষাভাষীদের প্রত্যাশা কিন্তু থেকেই যাবে।

কাজরী,
২০১৭

SUNITI Debnath

আমি সুনীতি দেবনাথ, অবসরপ্রাপ্ত সরকারি শিক্ষিকা। কবিতা, প্রবন্ধ ও ছোটগল্প লিখি। কবিতা আমার প্রিয়ভূমি, শৈশব থেকেই হেঁটে চলেছি...

0 comments: