লেখা-লেখি

বিশ্ব কবিতা দিবস।

১২:০৫:০০ AM 0 Comments























© সুনীতি দেবনাথ 


          
রাষ্ট্র সংঘের UNESCO - এর ডিরেক্টর জেনারেল ইরিনা বোকোভা বিশ্ব কবিতা দিবস সম্পর্কে তাঁর বাণী দিতে গিয়ে বলেছিলেন, 

"...  the men and women whose only instrument is free speech, who imagine and act, UNESCO recognizes in poetry its value as a symbol of the human spirit’s creativity. By giving form and words to that which has none – such as the unfathomable beauty that surrounds us, the immense suffering and misery of the world – poetry contributes to the expansion of our common humanity, helping to
increase its strength, solidarity and self-awareness."

ওপরপক্ষে বার্ণার্ড শ কবিতার গুরুত্ব বুঝাতে গিয়ে বলেছিলেন, " মানুষ যা কথায়
প্রকাশ করতে পারে না, তা প্রকাশ করে গানে,আর গানেও যার প্রকাশ সম্ভব নয়, তা প্রকাশ করে  কবিতায় "।

আদিম গুহামানব তখন গুটিকয়েক শব্দ সৃষ্টি করে অপার বিস্ময়ে দেখতো তার পরিপার্শ্বকে। একদিন জানা অজানা শব্দের মৌলিক ছবি এপাশ ওপাশ সাজিয়ে চাইলো মনের আকুলিবিকুলি ভাবের খেলা সাজিয়ে নিতে। চাইলো গুহার দেয়ালে ইচ্ছে মাফিক সাজাতে, অবাক এ কী সৃষ্টির অরূপ রতন! কবিতা মুচকি হেসে বললো আমাকে চেনো কি?তোমার মনে, তোমার ভাবনায় ঘুমিয়ে ছিলাম জেগে উঠেছি! অরণ্যানী বৃক্ষছায়া ফুলেল লতা বর্ণিল গুল্মের ঝোঁপ আকুল ঝর্ণা বহতা নদী সুরধুনী আকাশ মাখা নীলে সজ্জিতা ধরিত্রী নাতো নন্দনকানন!   কবিতা এখানে মৃদুল ছন্দে পরমানন্দে নৃত্যপরা ললিত লবঙ্গলতিকা! পৃথিবী বদলায় প্রকৃতি - সভ্যতা বদলায় বদলায় মানুষ। বদলায় মানুষের মনন চিন্তন অনুভবের জটিল ব্যাকরণ। কবিতাও অস্তিত্বের হেরফেরে কেবলই বদলে যায় নিত্য। তবু কালজয়ী সৃষ্টি যা অনন্তকালের পরিধিতে অমরত্বের উজ্জ্বল দিগন্তের 
এখানে ওখানে সেখানে চিরন্তনের সাক্ষর রেখে যায়। কবিতার কোন সীমানা নেই, কবির কোন নিজস্ব দেশ নেই, কাল নেই। সারাটা পৃথিবী জোড়া কবিতার মানচিত্র। আর সেই মানচিত্রে যখনই যেখানে দ্রোহ, প্রেম, বিপ্লব, প্রতিবাদ কিংবা মানুষের ন্যায়সঙ্গত দেনাপাওনার, মিলনের অভিব্যক্তি শৈল্পিক সৃষ্টিতে কবি প্রত্যয়ে প্রকাশ করেন, তখন তা সারা বিশ্বের জনগণের সম্পদ হয়ে ওঠে। পাবলো নেরুদা পশ্চিম গোলার্ধের কবি হয়েও তাই পূর্ব গোলার্ধের আমাদেরও কবি। রবীন্দ্রনাথ তাই বিশ্বকবি। তাই কালিদাস, শেক্সপিয়ার সকলের কবি। অনুন্নত ভাষাগোষ্ঠীর মানুষের দাবি যথার্থ উন্নত ভাষার কবিদের উজ্জ্বল সৃষ্টির সংস্পর্শে নিজেদের সৃষ্টির উন্নয়ন।তাই দাবি উঠলো রাষ্ট্রসঙ্ঘে একটা বিশেষ দিনকে ' বিশ্ব কবিতা দিবস ' উদযাপনের জন্য একটা দিন স্থির করতে। বিশেষ করে আমেরিকা এই প্রস্তাব উত্থাপন করে।
রাষ্ট্রসঙ্ঘ UNESCO - এর উদ্যোগে ১৯৯৯ সালে ২১ মার্চ তারিখটিকে ' বিশ্ব কবিতা দিবস ' হিসেবে ঘোষণা করে। এই দিনটি পালনের উদ্দেশ্য হল বিশ্বজুড়ে কবিতা পাঠ, কবিতা রচনা, প্রকাশনা ও শিক্ষাকে উৎসাহিত করা। UNESCO - এর বিশেষ  অধিবেশনে এই দিনটি ঘোষণা করার সময় বলা হয় , "এই দিবস বিভিন্ন জাতীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক কবিতা আন্দোলনগুলিকে নতুন করে স্বীকৃতি ও গতি দান করবে।"
আগে অক্টোবর মাসে বিশ্ব কবিতা দিবস পালন করা হত। প্রথম দিকে কখনো কখনো পাঁচ অক্টোবর এই দিবস পালিত হলেও বিশ শতকের শেষভাগে রোমান মহাকাব্য রচয়িতা ও সম্রাট অগস্টাসের রাজকবি ভার্জিলের জন্মদিন স্মরণ করে  পনেরো অক্টোবর কবিতা  দিবস পালনের প্রথা শুরু হয়। অনেক দেশে এখনো      অক্টোবর মাসের কোনো দিন জাতীয় বা আন্তর্জাতিক কবিতা দিবস পালন করা হয়। এই দিবসের বিকল্প হিসেবে অক্টোবর অথবা নভেম্বর মাসের কোনো দিন কবিতা দিবস পালনের প্রথাও চালু আছে। 
    যদি বলা হয় কবিতার সৃষ্টি হয় আর স্বচ্ছ -বিশুদ্ধ মনন ও যৌক্তিক চিন্তন থেকে হিরন্ময় আঙ্গিকে অনুভূতির বর্ণালি পথে আবগের আতিশয্যে সৃষ্ট হয়, দিব্য প্রকাশিত হয়,  ভুল বলা হবে না। অতীত কবিতার উদ্বোধনী পশ্চাদ্দেশের ভিত্তি, বর্তমান বা সমকাল মনন চিন্তনের প্রত্যক্ষ প্রসার আর অনাগত ভবিষ্যৎ অনুভূতির কল্পিত, স্বপ্নদর্শী ক্ষেত্র, তাহলেও ভুল বলা হবে না। সেই অর্থে কবি ত্রিকালদর্শী স্রষ্টা। ইচ্ছের লালন থেকে বেঁচে থাকা বেড়ে ওঠা স্বপ্ন দেখা সবই বিচিত্র আঙ্গিকে উপমা উৎপ্রেক্ষা চিত্রকল্প শব্দ প্রয়োগ কুশলতা নানা কিছুতে সেজে কবিতা জন্ম নেয়। কবিতার বিষয় সামগ্রিকভাবে জীবন, যাপন, প্রেম, বেদনা, প্রকৃতি, দ্রোহ, সংগ্রাম, বিপ্লব, আধিভৌতিক, আধিদৈবিক, আধ্যাত্মিক ইত্যাদি হরেক কিছু । বিজ্ঞান ইতিহাস দর্শন সমাজ রাজনীতি অর্থনীতি মনোবিজ্ঞান সবকিছুই কবিতার দখলে। তাই বিশ্ব কবিতা দিবস পালনের তাৎপর্য সুগভীর। আত্মোপলব্ধি ও প্রকাশের পথ বেয়ে কবিতা হয়ে ওঠে জীবন দর্শন। গুহামানব থেকে শুরু করে আজকের বিজ্ঞান প্রযুক্তির যুগে দাঁড়িয়ে মানুষ কবিতার কাছে প্রার্থনা জানাতে বাধ্য, " আমার হাত ধরে তুমি নিয়ে চলো সখা / আমি যে পথ চিনি না...।" 
   আজকের দারিদ্র্যক্লিষ্ট, সন্ত্রাসবাদ নিপীড়িত, বারুদের গন্ধে আচ্ছন্ন, অবক্ষয়ের পীড়নে আর্ত, মানুষপশুর দাপটে ভয়ার্ত পৃথিবীতে ব্যক্তি মানুষ যেমন, তেমনি সমষ্টি মানুষও একটা ভীতির কবলে উৎকণ্ঠিত। পরিত্রাণের পথ খুঁজছে মানুষ,মানুষের কবিতাও পথের অনুসন্ধানে। শিশু, যুবক- যুবতী, বৃদ্ধ -বৃদ্ধা নির্বিশেষে সকলেরই রক্তস্রোত  আজ রাজপথ জনপদে প্রবাহিত হয়। এইখানে কবিতা তীব্র তীক্ষ্ণ কণ্ঠে প্রতিবাদ ফুঁসে ওঠে। রক্তস্নাত কবিতা হত্যাকারীর প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করে, অসহায় মানুযের প্রতি ভালোবাসার হাত বাড়ায়। সাম্রাজ্যবাদীর দুর্বার ক্ষুধা যখন শক্তিমত্ততায় অপেক্ষাকৃত দুর্বল দেশগুলির স্বাধীন পতাকা ছিনিয়ে নিতে উদ্যত হয়, সার্বভৌমত্ব কেড়ে নিতে  চায়, কবিতা তখন অপ্রতিরোধ্য শক্তিতে দুর্বার প্রাচীর হয়ে দাঁড়ায়। কবিতা মানবিকতার সনদনামা। 'হিংসায় উন্মত্ত পৃত্থী '-তে শান্তিবারি বর্ষণ করতে পারে কবিতা। 
  মারুফ অমিত কবিতা সম্পর্কে ভারি সুন্দর বলেছেন,  "কবিতা ভালোবাসার ভাষা,কবিতা প্রতিবাদের ভাষা। কবিতা বলতে কী আবেগের বিজ্ঞানকে বুঝানো হয়ে থাকে? আবেগ ও বিজ্ঞান এ দুটির সমমিশ্রণ ঘটলেই পঙ্ক্তিমালাগুলো কবিতা রূপ ধারণ করে। কবিতা শিল্পের একটি শাখা যেখানে ভাষার নান্দনিক গুণাবলীর ব্যবহারের পাশাপাশি ধারণাগত এবং শব্দার্থিক বিষয়বস্তু ব্যবহার করা হয়। বিশ্লেষকদের মতে, কবিতা প্রতিমুহূর্তে আচরণে-আবরণে, আহ্বানে নিজের অস্তিত্ব তথা বোধজাত উপলব্ধি ঠিক রেখে নিজেকে ভাঙ্গে আবার গড়ে।"
    শক্তি ও আধিপত্য বিস্তারের লোলুপ অক্টোপাস আজ পৃথিবীর সকল সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার যন্ত্রসূত্র! মানুষ আজ হৃদয় আর বিবেকবোধ হারিয়েছে।যেন এক নখদন্ত বের করা ভয়াবহ সময়ের যন্ত্র মানব। মানব ইতিহাস আজ যেন এক বীভৎস ক্ষত! আজ বিশ্ব কবিতা দিবসে আবারো খুব গভীর ভাবে কবিতার প্রয়োজনে হৃদয়ে আলোড়ন জাগছে । বিবেকের জাগরণে, হৃদয়ের উজ্জীবনে, মানবতার সমূহ সংযোগে, জীবন-ভাবনার বিনির্মাণে কবিতার সার্বজনীন সৃষ্টি, পাঠ ও পরিক্রমা আজ মানুষের মানবিক বিকাশে বড় বেশি প্রয়োজন। একমাত্র কবিতাচর্চা-ই মানুষের জন্য এনে দিতে পারে মনুষ্য অস্তিত্বের মূল্যবোধ।
কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর “আমি কিংবদন্তীর কথা বলছি” কবিতা থেকে উদ্ধার করছি, 
“জিহ্বায় উচ্চারিত প্রতিটি সত্য শব্দ কবিতা,
কর্ষিত জমির প্রতিটি শস্যদানা কবিতা।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে ঝড়ের আর্তনাদ শুনবে।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে দিগন্তের অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে আজন্ম ক্রীতদাস থেকে যাবে"

।বিশ্ব কবিতা দিবসে আজ নতুন করে ভাবতে  হবে কবিতাচর্চার প্রয়োজনের কথা। মানুষের ' হৃদয় নন্দনবনে ' মানব মহিমার শতপুষ্পকে কবিতাই পারবে নব নব রূপে বিকসিত করতে।বিশ্ব মানবিকতা কবিতার উচ্চারণে বিজয়ী হবে, রবীন্দ্রনাথের কবিতা উচ্চারণ করে বলবো কবিতাই পারবে সেই মানব পৃথিবীকে গড়ে তুলতে। আর সেখানেই বিশ্ব কবিতা দিবস পালনের সার্থকতা। 
      
"চিত্ত যেথা ভয়শূন্য, উচ্চ যেথা শির,
জ্ঞান যেথা মুক্ত, যেথা গৃহের প্রাচীর
আপন প্রাঙ্গণতলে দিবসশর্বরী
বসুধারে রাখে নাই খণ্ড ক্ষুদ্র করি,
যেথা বাক্য হৃদয়ের উত্সমুখ হতে
উচ্ছ্বসিয়া উঠে, যেথা নির্বারিত স্রোতে
দেশে দেশে দিশে দিশে কর্মধারা ধায়
অজস্র সহস্রবিধ চরিতার্থতায়,
যেথা তুচ্ছ আচারের মরুবালুরাশি
বিচারের স্রোতঃপথ ফেলে নাই গ্রাসি---
পৌরুষেরে করে নি শতধা ..."।


কাজরী,
২১ মার্চ, ২০১৭

SUNITI Debnath

আমি সুনীতি দেবনাথ, অবসরপ্রাপ্ত সরকারি শিক্ষিকা। কবিতা, প্রবন্ধ ও ছোটগল্প লিখি। কবিতা আমার প্রিয়ভূমি, শৈশব থেকেই হেঁটে চলেছি...

0 comments: