জন্মদিনের নিজস্ব অনুভূতিতে রবীন্দ্রনাথ ...
রবীন্দ্রনাথের আশি বছরের জীবনে প্রথম চল্লিশ বছর কোন জন্মজয়ন্তী জাঁকজমকপূর্ণভাবে পালিত হয়নি। জীবনের প্রথমদিকে জন্মদিন নিয়ে কবির তেমন উৎসাহও ছিল না; তাই সে সব জন্মদিনের স্মৃতি কবিচিত্তকে তেমনভাবে আলোড়িত করতে পারেনি। মূলত চল্লিশ বছরের পর থেকেই বেশ সাড়ম্ববরে কবিগুরুর জন্মজয়ন্তী পালন শুরু হয়। রবীন্দ্রনাথ নিজেও তাঁর জন্মজয়ন্তীতে অনেক ভাষণ দিয়েছেন, অনেক কবিতা লিখেছেন।১৩১৭ সালে বোলপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের সংবর্ধনায় কবি প্রথম নিজের জন্মদিনের কথা উল্লেখ করে ভাষণ দেন। ভাষণে তিনি বলেছিলেন যে , জন্মদিন সম্বন্ধে তখনো তাঁর কোনো গভীর অনুভূতি ছিলোনা!
"কতো পঁচিশে বৈশাখ চলে গিয়েছে, তারা অন্য তারিখের চেয়ে নিজেকে কিছুমাত্র বড়ো করে আমার কাছে প্রকাশ করেনি।"
৫০তম জন্মদিবসে কবি নিজেকে আলোক প্রভায় প্রকাশ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, "আজ আমার জন্মদিনে তোমরা যে উৎসব পালন করছো তার মধ্যে যদি সেই কথাটি থাকে তোমরা যদি আমাকে আপন করে পেয়ে থাকো আজ প্রভাতে সেই পাওয়ার আনন্দকেই যদি তোমাদের প্রকাশ করবার ইচ্ছে হয়ে থাকে তাহলেই এই উৎসব সার্থক। আমার এই পঞ্চাশ বৎসর বয়সেও আমাকে তোমরা নতুনভাবে পেয়েছ, আমার সঙ্গে তোমাদের সম্বন্ধের মধ্যে জরাজীর্ণতার লেশমাত্র লবণ নেই। তাই আজ সকালে তোমাদের আনন্দ উৎসবের মাঝখানে বসে আমার এই নবজন্মের নবীনতা অন্তরে বাইরে উপলব্ধি করছি।"
কবির ৫৯তম জন্মজয়ন্তী পালন করা হয় শান্তিনিকেতন আশ্রমে। পঁচিশে বৈশাখের আগের দিন অর্থাৎ ২৪শে বৈশাখ তিনি রচনা করেন, 'আমার জীর্ণ পাতা যাবার বেলায়'।
১৩২৮ সালের পঁচিশে বৈশাখে কবি ছিলেন জেনেভায়। সেখানে বাংলার শ্যামল প্রকৃতি ও মাটির আকর্ষণে কবি ব্যাকুল হয়েছিলেন। তিনি এন্ড্রুজকে লিখেছিলেন, "আজিকার দিন যথার্থভাবে আমার জন্য নহে। যাহারা আমাকে ভালবাসে তাদেরই জন্য আনন্দের দিন। তোমাদের কাছ হইতে দূরে আজিকার এই দিন আমার কাছে পুস্তিকার তারিখ মাত্র। আজ একটু নিরালা থাকিতে ইচ্ছা করিতেছে কিন্তু তাহা হইবার নয়।
এ দিন জার্মান জাতির পক্ষ থেকে কবিকে সংবর্ধনা জানানো হয়। কবির জন্য টমাসম্যান, অরকন, কাউন্ট কেইসার লিড প্রমুখকে নিয়ে গঠিত হয় সংবর্ধনা কমিটি। কবিকে উপহার দেয়া হয় জার্মান ভাষার সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থসমূহ।
১৩২১ সনে কবির ৬২তম জন্মজয়ন্তী পালন করা হয় শান্তিনিকেনে। কবি তখন শান্তিনিকেতনের ছায়ায় গ্রীষ্মের দিনগুলোর সঙ্গে গল্পমগ্ন ছিলেন। এই জন্মদিনে কবি উপহার দিয়েছিলেন 'পঁচিশে বৈশাখ' কবিতা;
'রাত্রি হল ভোর
আজি মোর
জন্মের স্মরণ পূর্ণবাণী,
প্রভাতের রৌদ্রে-লেখা লিপিখানি
হাতে করে আমি
দ্বারে আসি দিল ডাক
পঁচিশে বৈশাখ।'
১৯৩১ সনে কবির ৬৪তম জন্মোৎসবে কবি ছিলেন চীনে। সাথে ছিলেন নন্দলাল বসু, এলমাহার্স্ট, ক্ষিতিমোহন সেন প্রমুখ। অনেক দিন পর কবি সেই পঁচিশে বৈশাখের স্মরণে লিখেছিলেন,
'একদা গিয়েছি চীনদেশে
অচেনা যাহারা
ললাটে দিয়েছে চিহ্ন,
তুমি আমাদের চেনা বলে
যেখানেই বন্ধু পাই সেখানেই নবজন্ম ঘটে।...'
১৩৩২-এর পঁচিশে বৈশাখে বিপুল উদ্দীপনায় কবির ৬৫তম জন্মোৎসব পালন করা হলো শান্তিনিকেতনে। এতোদিন যে জন্মদিন শুধু ঘরের মানুষের কাছে ছিল। এবার তা বিশ্বসভার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। কবি এ সময় ইন্দিরা দেবীকে একটি চিঠিতে লিখেছিলেন, "এমন একদিন ছিল যখন আমার জন্মদিনের সার্থকতা তোদের কাছে ছাড়া আর কোথাও ছিল না। ক্রমে এখন এক সময়ে আমার জীবনের ক্ষেত্র বহু বিস্তীর্ণ হয়ে পড়লো সেটা যেন আমার জন্মান্তরের মতো। সেই আমার নবজন্মের জন্মদিন এতদিন চলে এসেছে। যেটাকে আমার জন্মান্তর বললুম তাকে আমার পরলোকও বলা চলে। অর্থাৎ যারা পর ছিল তাদের মধ্যেই একদিন আমার অভ্যর্থনা শুরু হয়েছিলো। তোদের লোক থেকে লোকান্তরগতকে তোরা হয়তো সুষ্ঠু করে দেখতে পাসনি। যে ঘাট থেকে জীবনযাত্রা প্রথম শুরু করেছিলাম আমার কাছেও মাঝে মাঝে তা ঝাপসা হয়ে আসছিল। কিন্তু এটা হলো মধ্যাহ্নকালের কথা। এখন অপরাহ্নের মুলতানী সুর হাওয়ায় বেজে উঠেছে।"
কবির ৬৬তম জন্মদিবসও পালন করা হয় শান্তিনিকেতনে। এই জন্মদিনটি দেশী-বিদেশীদের মিলন মেলায় পরিণত হয়। জন্মদিনে কবি উপহার দিলেন, 'নটীর পূজা' ও 'পরিশেষ' কাব্যের 'দিনাবসান' কবিতা—
'বাঁশি যখন থামবে ঘরে
নিভবে দীপের শিখা।
এই জনমের লীলার পরে
পড়বে যবনিকা
সেদিন যেন কবির তরে
ভিড় না জমে সবার ঘরে
হয় না যেন উচ্চস্বরে
শোকের সমারোহ।'
এই অনুষ্ঠানে কবি ভাষণ দিয়েছিলেন, 'জন্মদিন' নাম দিয়ে তা প্রবাসীতে (জ্যৈষ্ঠ-১৩৩৩ সংখ্যা) প্রকাশিত হয়। "এই শ্যামল ধরণী, এই নদী, প্রান্তর, অরণ্যের মধ্যে আমার বিধাতা আমাকে অন্তরঙ্গতার অধিকার দিয়েছেন, এর মধ্যে নগ্ন শিশু হয়ে এসেছিলুম। আজও যখন দৈববীণা অনাহূত সুরে আকাশে বাজে তখন সেদিনকার সেই শিশু জেগে ওঠে, বলতে চায় কিছু, সব কথা বলে উঠতে পারে না। আজ আমার জন্মদিন সেই কবির জন্মদিন, প্রবীণের না।"
১৩৩৬ সালে জাপানের পথেই হয় কবির জন্মোৎসব। জাহাজের কাপ্তান ও যাত্রীরা কবিকে সম্বর্ধনা জানান।
১৩৩৭ সালে কবির ৬৯তম জন্মজয়ন্তী বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই জন্মদিনে তিনি আত্মপ্রকাশ করেন চিত্রশিল্পীরূপে। প্যারিসের দুই মহিলার উদ্যোগে তাঁর ছবির প্রদর্শনীও হয়। ফ্রান্স থেকেই কবি ইন্দিরা দেবীকে লেখেন, "ধরাতলে যে রবিঠাকুর বিগত শতাব্দীর ২৫শে বৈশাখে অবতীর্ণ হয়েছেন তাঁর কবিত্ব সম্প্রতি আচ্ছ্ন্ন, তিনি এখন চিত্রকররূপে প্রকাশমান।... এই বার আমার চৈতালি বর্ষ শেষের ফসল সমুদ্রপারের ঘাটে সংগ্রহ হলো।
১৩৩৮ সনে কবির ৭০তম জন্মজয়ন্তীতে সমগ্র জাতির পক্ষ থেকে কলকাতায় তাঁকে সম্বর্ধনা দেয়া হয়। সভাপতির ভাষণে শরৎচন্দ্র কবিকে মানবাত্মার কবি হিসেবে অভিহিত করেন। জন্মদিনের ভাষণে কবি বলেন- "একটি মাত্র পরিচয় আমার আছে, যে আর কিছুই নয়, আমি কবি মাত্র। আমার চিত্ত নানা কর্মের উপলক্ষে ক্ষণে ক্ষণে নানা জনের গোচর হয়েছে। তাতে আমার পরিচয়ের সমগ্রতা নেই। আমি তত্ত্বজ্ঞানী, শাস্ত্রজ্ঞানী, গুরু বা নেতা নই-কদিন আমি বলেছিলাম 'আমি চাইনে হতে নববঙ্গে নবযুগের চালক- সে কথা সত্য বলেছিলাম।... এই ধুলো মাটি ঘাসের মধ্যে আমি হৃদয় ঢেলে দিয়ে গেলাম, বনস্পতি, ঔষধির মধ্যে। যারা মাটির কোলের কাছে আছে, যারা মাটির হাতে মানুষ, যারা মাটিতেই হাঁটতে আরম্ভ করে, শেষকালে মাটিতেই বিশ্রাম করে, আমি তাদের সকলের বন্ধু-আমি কবি।... "
কবি ৭১তম জন্মদিনে ছিলেন ইরানে। সেখানে তিনি রচনা করেছিলেন,
'ইরান, তোমার সম্মান মালে
নব গৌরব বহি নিজ ভালে
সার্থক হলো কবির জন্মদিন।'
১৩৪২ সালে কবির ৭৪তম জন্মদিবস পালিত হয়। এ দিবসে পাওয়া যায় তাঁর নতুন উপলব্ধি জীবন ও জগৎ এবং মানুষ ও বিশ্বপ্রকৃতি সম্পর্কে । কবি রচনা করেন 'পঁচিশে বৈশাখ চলেছে।' কবিতাটি উৎসর্গ করেন, অমিয়চন্দ্র চক্রবর্তীকে—
পঁচিশে বৈশাখ চলেছে
জন্মদিনের ধারাকে বহন করে
মৃত্যু দিনের দিকে।
সেই চলতি আসনের উপর বসে
কোন কারিগর গাঁথছে মালা
ছোটো ছোটো জন্ম মৃত্যুর সীমানায়
নানা রবীন্দ্রনাথের একখানা মালা।'
১৩৪৪ সালে কবির ৭৭তম জন্মদিবস পালিত হয় আলমোড়ায়। জন্মদিনের তিনদিন আগেই কবি 'জন্মদিন' নামে কবিতা রচনা করেছিলেন।
১৩৪৫ সনে কবির ৭৮ তম জন্মজয়ন্তীতে তাঁর কবিতা যুদ্ধবিরোধী চেতনায় মুখর হয়েছিলো।
একদিকে কি অমানুষিক স্পর্ধা আর একদিকে কি অমানুষিক কাপুরুষতা। তিনি কালিম্পং থেকে বেতারে পড়ে শোনান সেঁজুতির 'জন্মদিন' কবিতাটি
'আজ মম জন্মদিন।
জন্মদিন মৃত্যুদিন, একাসনে দোহে বসিয়াছে,
দুই আলো মুখোমুখি মিলিছে জীবন প্রান্তে মম,
...
হে মানুষ, হে ধরণী—
তোমার আশ্রয় ছেড়ে যাবে যবে, নিও তুমি গণি
------------------------------'
কবির ৭৯তম জন্মোৎসব পালিত হয় পুরীতে। সেখানে সরকারীভাবে কবিকে সংবর্ধনা দেয়া হয়। অনুষ্ঠানে কবি ভাষণ দেন, কবিতা পাঠ করেন। তিনি রচনা করেন, 'নবজাতকের' 'জন্মদিন' কবিতা।
'তোমরা যাকে রবীন্দ্রনাথ বলে জানো সে আমি নই'।
১৩৪৭ সালের ২৫শে বৈশাখে কবি মংপুতে ছিলেন মৈত্রেয়ী দেবীর অতিথি হিসেবে।
কবির আশিতম জন্মজয়ন্তীতে লিখলেন, 'জন্মদিনে' কাব্য—
'সেদিন আমার জন্মদিন।
প্রভাতের প্রণাম লইয়া
উদয় দিগন্ত পানে মেলিলাম আঁখি।'
এ জন্মোৎসব যেমন কবির জীবদ্দশায় সর্বশেষ জন্মোৎসব, তেমনি সভ্যতার সংকটও কবির শেষ অভিভাষণ। পহেলা বৈশাখ শান্তিনিকেতনে জন্মদিনের উৎসবে লেখা। ভাষণের শেষদিকে কবি বলেছিলেন, 'আজ আশা করে আছি, পরিত্রাণকর্তার জন্মদিন আসছে আমাদের এই দারিদ্র্য লাঞ্ছিত কুটীরের মধ্যে, অপেক্ষা করে থাকবো, সভ্যতার দৈববাণী নিয়ে আসবে, মানুষের চরম আশ্বাসের কথা মানুষকে বসে শোনাবে এই পূর্বদিগন্ত থেকে। আজ পারের দিকে যাত্রা করেছি, পিছনের ঘাটে কি দেখে এলুম, কি রেখে এলুম, ইতিহাসের কি অকিঞ্চিৎকর উচ্ছিষ্ট সভ্যতাভিমানের পরিকীর্ণ ভগ্নস্তুপ কিন্তু মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ, সে বিশ্বাস শেষ পর্যন্ত রক্ষা করবো। আশা করবো, মহাপ্রলয়ের পরে বৈরাগ্যের মেঘমুক্ত আকাশে ইতিহাসের একটি নির্মল আত্মপ্রকাশ হয়তো আরম্ভ হবে এই পূর্বাচলের সূর্যোদয়ের দিগন্ত থেকে। আর একদিন অপরাজিত মানুষ নিজের জয়যাত্রার অভিযানে সকল বাধা অতিক্রম করে অগ্রসর হবে তার মহৎ মর্যাদা ফিরে পাবার 'পথে। মনুষ্যত্বের অন্তহীন প্রতিকারহীন পরাভবকে চরম বলে বিশ্বাস করাকে আমি অপরাধ মনে করি।'
— সুনীতি দেবনাথ
★ সহায়তা : গীতবিতান / Facebook
0 comments: