লেখা-লেখি

রবীন্দ্র নাটক অচলায়তনের সমালোচনা ও রবীন্দ্রনাথের প্রত্যুত্তর

























— সুনীতি দেবনাথ


অচলায়তন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি রূপক-সাংকেতিক নাটক। প্রকাশকাল ২ অগস্ট, ১৯১২। ১৯১৮ সালে প্রকাশিত হয় এই নাটকের ‘অভিনয়যোগ্য’ সংক্ষিপ্ত সংস্করণ গুরু। প্রচলিত সংস্কার ও অন্ধবিশ্বাসের বিরুদ্ধে মুক্তবুদ্ধি ও স্বাধীন চিন্তার জয়গান গেয়েছেন কবি এই নাটকে। সমকালীন রক্ষণশীল হিন্দুসমাজ এই নাটকটি পড়ে বিরক্ত হয়েছিল।

অচলায়তন
গ্রন্থপরিচিতি
রবীন্দ্ররচনাবলী একাদশ খণ্ড (বিশ্বভারতী, আশ্বিন ১৩৯৩ মুদ্রণানুসারে)

    অচলায়তন ১৩১৮ সালে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়!
    ১৩১৮ সালের আশ্বিন মাসের প্রবাসীতে অচলায়তন সম্পূর্ণ মুদ্রিত হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ এই উপলক্ষে চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়কে একটি পত্রে (পোস্টমার্ক্: শান্তিনিকেতন ১৪ জুলাই ১৯১১) লেখেন—
    'শেষকালে নাটকটা প্রবাসীর কবলের মধ্যেই পড়ল। অনেক লোকের চক্ষে পড়বে এবং এই নিয়ে কাগজপত্রে বিস্তর মারামারি-কাটাকাটি চলবে এই আমার একটা মস্ত সান্ত্বনা।'
    এই অনুমান ব্যর্থ হয়নি।

    প্রবাসীতে নাটকটি প্রকাশিত হলে অধ্যাপক ললিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়'আর্য্যাবর্ত্ত' মাসিক পত্রে (কার্তিক ১৩১৮) এর একটি সমালোচনা প্রকাশ করেন; এতে  নাটকটির প্রশস্তি ও তিরস্কার দুইই ছিল। ললিতকুমার বন্দোপাধ্যায়কে লিখিত একটি পত্রে রবীন্দ্রনাথ এই সমালোচনার উত্তর দেন; পত্রটি 'আর্য্যাবর্ত্তে' (অগ্রহায়ণ ১৩১৮) প্রকাশিত হয়; নিচে তা মুদ্রিত হল—
    'নিজের লেখা সম্বন্ধে কোনোপ্রকার ওকালতি করিতে যাওয়া ভদ্ররীতি নহে। সে রীতি আমি সাধারণত মানিয়া থাকি। কিন্তু আপনার মতো বিচারক যখন আমার কোনো গ্রন্থের সমালোচনা করেন তখন প্রথার খাতিরে ঔদাসীন্যের ভান করা আমার দ্বারা হইয়া উঠে না।
    'সাহিত্যের দিক দিয়া আপনি অচলায়তনের উপর যে রায় লিখিয়াছেন তাহার বিরুদ্ধে আপনার নিকট আমি কোনো আপিল রুজু করিব না। আপনি যে ডিগ্রী দিয়াছেন সে আমার যথেষ্ট হইয়াছে।
    'কিন্তু ওই-যে একটা উদ্দেশ্যের কথা তুলিয়া আমার উপরে একটা মস্ত অপরাধ চাপাইয়াছেন সেটা আমি চুপচাপ করিয়া মানিয়া লইতে পারি না। কেবলমাত্র ঝোঁক দিয়া পড়ার দ্বারা বাক্যের অর্থ দুই-তিন-রকম হইতে পারে। কোনো কাব্য বা নাটকের উদ্দেশ্যটা সাহিত্যিক বা অসাহিত্যিক তাহাও কোনো কোনো স্থলে ঝোঁকের দ্বারা সংশয়াপন্ন হইতে পারে। পাখি পিঞ্জরের বাহিরে যাইবার জন্য ব্যাকুল হইতেছে ইহা কাব্যের কথা, কিন্তু পিঞ্জরের নিন্দা করিয়া খাঁচাওয়ালার প্রতি খোঁচা দেওয়া হইতেছে এমনভাবে সুর করিয়াও হয়তো পড়া যাইতে পারে। মুক্তির জন্য পাখির কাতরতাকে ব্যক্ত করিতে হইলে খাঁচার কথাটা একেবারেই বাদ দিলে চলে না। পাখির বেদনাকে সত্য করিয়া দেখাইতে হইলে খাঁচার বদ্ধতা ও কঠিনতাকে পরিস্ফুট করিতেই হয়।
    'জগতের যেখানেই ধর্মকে অভিভূত করিয়া আচার আপনি বড়ো হইয়া উঠে সেখানেই মানুষের চিত্তকে সে রুদ্ধ করিয়া দেয়, এটা একটা বিশ্বজনীন সত্য। সেই রুদ্ধ চিত্তের বেদনাই কাব্যের বিষয়, এবং আনুষঙ্গিক ভাবে শুষ্ক আচারের কদর্যতা স্বতই সেইসঙ্গে ব্যক্ত হইতে থাকে।
    'ধর্মকে প্রকাশ করিবার জন্য, গতি দিবার জন্যই, আচারের সৃষ্টি; কিন্তু কালে কালে ধর্ম যখন সেই-সমস্ত আচারকে নিয়মসংযমকে অতিক্রম করিয়া বড়ো হইয়া উঠে, অথবা ধর্ম যখন সচল নদীর মতো আপনার ধারাকে অন্য পথে লইয়া যায়, তখন পূর্বতন নিয়মগুলি অচল হইয়া শুষ্ক নদীপথের মতো পড়িয়া থাকে— বস্তুত তখন তাহা তপ্ত মরুভূমি, তৃষাহরা তাপনাশিনী স্রোতস্বিনীর সম্পূর্ণ বিপরীত। সেই শুষ্ক পথটাকেই সনাতন বলিয়া সম্মান করিয়া নদীর ধারার সন্ধান যদি একেবারে পরিত্যাগ করা যায় তবে মানবাত্মাকে পিপাসিত করিয়া রাখা হয়। সেই পিপাসিত মানবাত্মার ক্রন্দন কি সাহিত্যে প্রকাশ করা হইবে না, পাছে পুরাতন নদীপথের প্রতি অনাদর দেখানো হয়?
    'আপনি যাহা বলিয়াছেন সে কথা সত্য। সকল ধর্মসমাজেই এমন অনেক পুরাতন প্রথা সঞ্চিত হইতে থাকে যাহার ভিতর হইতে প্রাণ সরিয়া গিয়াছে। অথচ চিরকালের অভ্যাস-বশত মানুষ তাহাকেই প্রাণের সামগ্রী বলিয়া আঁকড়িয়া থাকে— তাহাতে কেবলমাত্র তাহার অভ্যাস তৃপ্ত হয়, কিন্তু তাহার প্রাণের উপবাস ঘুচে না— এমনি করিয়া অবশেষে এমন একদিন আসে যখন ধর্মের প্রতিই তাহার অশ্রদ্ধা জন্মে—এ কথা ভুলিয়া যায় যাহাকে সে আশ্রয় করিয়াছিল তাহা ধর্মই নহে, ধর্মের পরিত্যক্ত আবর্জনা মাত্র।
    'এমন অবস্থায় সকল দেশেই সকল কালেই মানুষকে কেহ-না-কেহ শুনাইয়াছে যে, আচারই ধর্ম নহে, বাহ্যিকতায় অন্তরের ক্ষুধা মেটে না এবং নিরর্থক অনুষ্ঠান মুক্তির পথ নহে, তাহা বন্ধন। অভ্যাসের প্রতি আসক্ত মানুষ কোনো দিন এ কথা শুনিয়া খুশি হয় নাই এবং যে এমন কথা বলে তাহাকে পুরস্কৃত করে নাই—কিন্তু ভালো লাগুক আর না লাগুক এ কথা তাহাকে বারংবার শুনিতেই হইবে।
    'প্রত্যেক মানুষের একটা অহং আছে। সেই অহং'এর আবরণ হইতে মুক্ত হইবার জন্য সাধকমাত্রের একটা ব্যগ্রতা আছে। তাহার কারণ কী। তাহার কারণ এই, মানুষের নিজের বিশেষত্ব যখন তাহার আপনাকেই ব্যক্ত করিতে থাকে, আপনার চেয়ে বড়োকে নহে, তখন সে আপনার অস্তিত্বের উদ্দেশ্যকেই ব্যর্থ করে। আপনার অহংকার, আপনার স্বার্থ, আপনার সমস্ত রাগদ্বেষকে ভেদ করিয়া ভক্ত যখন আপনার সমস্ত চিন্তায় ও কর্মে ভগবানের ইচ্ছাকে ও তাঁহার আনন্দকেই প্রকাশ করিতে থাকেন তখন তাঁহার মানবজীবন সার্থক হয়।
    'ধর্মসমাজেরও সেইরূপ একটা অহং আছে। তাহার অনেক রীতি-পদ্ধতি নিজেকেই চরমরূপে প্রকাশ করিতে থাকে। চিরন্তনকে আচ্ছন্ন করিয়া নিজের অহংকারকেই সে জয়ী করে। তখন তাহাকে পরাভূত করিতে না পারিলে সত্যধর্ম পীড়িত হয়। সেই পীড়া যে সাধক অনুভব করিয়াছে সে এমন গুরুকে খোঁজে যিনি এই-সমস্ত সামাজিক অহংকে অপসারিত করিয়া ধর্মের মুক্ত স্বরূপকে দেখাইয়া দিবেন। মানবসমাজে যখনই কোনো গুরু আসিয়াছেন তিনি এই কাজই করিয়াছেন।
    'আপনি প্রশ্ন করিয়াছেন, উপায় কী। 'শুধু আলো, শুধু প্রীতি' লইয়াই কি মানুষের পেট ভরিবে। অর্থাৎ আচার-অনুষ্ঠানের বাধা দূর করিলেই কি মানুষ কৃতার্থ হইবে। তাই যদি হইবে তবে ইতিহাসে কোথাও তাহার কোনো দৃষ্টান্ত দেখা যায় না কেন।
    'কিন্তু এরূপ প্রশ্ন কি অচলায়তনের লেখককে জিজ্ঞাসা করা ঠিক হইয়াছে। অচলায়তনের গুরু কি ভাঙিবার কথাতেই শেষ করিয়াছেন। গড়িবার কথা বলেন নাই? পঞ্চক যখন তাড়াতাড়ি বন্ধন ছাড়াইয়া উধাও হইয়া যাইতে চাহিয়াছিল তখন তিনি কি বলেন নাই 'না, তা যাইতে পারিবে না— যেখানে ভাঙা হইল এইখানেই আবার প্রশস্ত করিয়া গড়িতে হইবে'? গুরুর আঘাত নষ্ট করিবার জন্য নহে, বড়ো করিবার জন্যই। তাঁহার উদ্দেশ্য ত্যাগ করা নহে, সার্থক করা। মানুষের স্থূল দেহ যখন মানুষের মনকে অভিভূত করে তখন সেই দেহগত রিপুকে আমরা নিন্দা করি, কিন্তু তাহা হইতে কি প্রমাণ হয় প্রেতত্ব লাভই মানুষের পূর্ণতা। স্থূল দেহের প্রয়োজন আছে। কিন্তু সেই দেহ মানুষের উচ্চতর সত্তার বিরোধী হইবে না, তাহার অনুগত হইবে, এ কথা বলার দ্বারা দেহকে নষ্ট করিতে বলা হয় না।
    'অচলায়তনে মন্ত্রমাত্রের প্রতি তীব্র শ্লেষ প্রকাশ করা হইয়াছে এ কথা কখনোই সত্য হইতে পারে না, যেহেতু মন্ত্রের সার্থকতা সম্বন্ধে আমার মনে কোনো সন্দেহ নাই। কিন্তু মন্ত্রের যথার্থ উদ্দেশ্য মননে সাহায্য করা। ধ্যানের বিষয়ের প্রতি মনকে অভিনিবিষ্ট করিবার উপায় মন্ত্র। আমাদের দেশে উপাসনার এই-যে আশ্চর্য পন্থা সৃষ্ট হইয়াছে, ইহা ভারতবর্ষের বিশেষ মাহাত্ম্যের পরিচয়।
    'কিন্তু সেই মন্ত্রকে মনন-ব্যাপার হইতে যখন বাহিরে বিক্ষিপ্ত করা হয়, যখন তাহার উদ্দেশ্যকে অভিভূত করিয়া নিজেই চরম পদ অধিকার করিতে চায়, তখন তাহার মতো মননের বাধা আর কী হইতে পারে। কতকগুলি বিশেষ শব্দসমষ্টির মধ্যে কোনো অলৌকিক শক্তি আছে এই বিশ্বাস যখন মানুষের মনকে পাইয়া বসে তখন সে আর সেই শব্দের উপরে উঠিতে চায় না। তখন মনন ঘুচিয়া গিয়া সে উচ্চারণের ফাঁদেই জড়াইয়া পড়ে। তখন চিত্তকে যাহা মুক্ত করিবে বলিয়াই রচিত তাহাই চিত্তকে বদ্ধ করে। এবং ক্রমে দাঁড়ায় এই, মন্ত্র পড়িয়া দীর্ঘ জীবন লাভ করা, মন্ত্র পড়িয়া শক্র জয় করা ইত্যাদি নানাপ্রকার নিরর্থক দুশ্চেষ্টায় মানুষের মূঢ় মন প্রলুব্ধ হইয়া ঘুরিতে থাকে। এইরূপে মন্ত্রই যখন মননের স্থান অধিকার করিয়া বসে তখন মানুষের পক্ষে তাহা অপেক্ষা শুষ্ক জিনিস আর কী হইতে পারে। যেখানে মন্ত্রের এরূপ ভ্রষ্টতা সেখানে মানুষের দুর্গতি আছেই। সেই সমস্ত কৃত্রিম বন্ধন-জাল হইতে মানুষ আপনাকে উদ্ধার করিয়া ভক্তির সজীবতা ও সরলতা লাভের জন্য ব্যাকুল হইয়া উঠে, ইতিহাসে বারংবার ইহার প্রমাণ দেখা গিয়াছে। যাগযজ্ঞ মন্ত্রতন্ত্র যখনই অত্যন্ত প্রবল হইয়া মানুষের মনকে চারি দিকে বেষ্টন করিয়া ধরে তখনই তো মানবের গুরু মানবের হৃদয়ের দাবি মিটাইবার জন্য দেখা দেন; তিনি বলেন, পাথরের টুকরা দিয়া রুটির টুকরার কাজ চালানো যায় না, বাহ্য অনুষ্ঠানকে দিয়া অন্তরের শূন্যতা পূর্ণ করা চলে না। কিন্তু তাই বলিয়া এ কথা কেহই বলে না যে, মন্ত্র যেখানে মননের সহায়, বাহিরের অনুষ্ঠান যেখানে অন্তরের ভাবস্ফুর্তির অনুগত, সেখানে তাহা নিন্দনীয়। ভাব তো রূপকে কামনা করে, কিন্তু রূপ যদি ভাবকে মারিয়া একলা রাজত্ব করিতে চায় তবে বিধাতার দণ্ডবিধি অনুসারে তাহার কপালে মৃত্যু আছেই। কেননা, সে যত দিনই বাঁচিবে তত দিনই কেবলই মানুষের মনকে মারিতে থাকিবে। ভাবের পক্ষে রূপের প্রয়োজন আছে বলিয়াই রূপের মধ্যে লেশমাত্র অসতীত্ব এমন নিদারুণ। যেখানেই সে নিজেকে প্রবল করিতে চাহিবে সেইখানেই সে নির্লজ্জ, সে অকল্যাণের আকর। কেননা, ভাব যে রূপকে টানিয়া আনে সে যে প্রেমের টান, আনন্দের—রূপ যখন সেই ভাবকে চাপা দেয় তখন সে সেই প্রেমকে আঘাত করে, আনন্দকে আচ্ছন্ন করে— সেইজন্য যাহারা ভাবের ভক্ত তাহারা রূপের এইরূপ ভ্রষ্টাচার একেবারে সহিতে পারে না। কিন্তু রূপে তাহাদের পরমানন্দ, যখন ভাবের সঙ্গে তাহার পূর্ণ মিলন দেখে। কিন্তু শুধু রূপের দাসখত মানুষের সকলের অধম দুর্গতি। যাঁহারা মহাপুরুষ তাঁহারা মানুষকে এই দুর্গতি হইতেই উদ্ধার করিতে আসেন। তাই অচালায়তনে এই আশার কথাই বলা হইয়াছে যে, যিনি গুরু তিনি সমস্ত আশ্রয় ভাঙিয়া চুরিয়া দিয়া একটা শূন্যতা বিস্তার করিবার জন্য আসিতেছেন না; তিনি স্বভাবকে জাগাইবেন, অভাবকে ঘুচাইবেন, বিরুদ্ধকে মিলাইবেন; যেখানে অভ্যাসমাত্র আছে সেখানে লক্ষ্যকে উপস্থিত করিবেন, এবং যেখানে তপ্ত বালু-বিছানো খাদ পড়িয়া আছে মাত্র সেখানে প্রাণপরিপূর্ণ রসের ধারাকে বহাইয়া দিবেন। এ কথা কেবল যে আমাদেরই দেশের সম্বন্ধে খাটে তাহা নহে; ইহা সকল দেশেই সকল মানুষেরই কথা। অবশ্য এই সর্বজনীন সত্য অচলায়তনে ভারতবর্ষীর রূপ ধারণ করিয়াছে; তাহা যদি না করিত তবে উহা অপাঠ্য হইত।
    'মনে করিয়াছিলাম সংক্ষেপে বলিব। কিন্তু'নিজের কথা পাঁচ কাহন' হইয়া পড়ে; বিশেষত শ্রোতা যদি সহৃদয় ও ক্ষমাপরায়ণ হন। ইতিপূর্বেও আপনার প্রতি জুলুম করিয়া সাহস বাড়িয়া গেছে; এবারেও প্রশ্রয় পাইব এ ভরসা মনে আছে। ইতি ৩রা অগ্রহায়ণ ১৩১৮, শান্তিনিকেতন। '

    আর্য্যাবর্ত্তের যে সংখ্যাতে (অগ্রহায়ণ ১৩১৮) রবীন্দ্রনাথের এই প্রত্যুত্তর মূদ্রিত হয় সেই সংখ্যাতেই অক্ষয়চন্দ্র সরকার, ললিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'ফোয়ারা' গ্রন্থের সমালোচনা-প্রসঙ্গে, পূর্বসংখ্যা আর্য্যাবর্ত্তে প্রকাশিত তাঁর অচলায়তন আলোচনার ও রবীন্দ্রনাথের বিরূপ সমালোচনা করেন। অক্ষয়চন্দ্রের আলোচনা সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথ ললিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়কে পত্রোত্তর লেখেন—
    'আমার লেখা পড়িয়া অনেকে বিচলিত হইবেন এ কথা আমি নিশ্চিত জানিতাম; আমি শীতলভোগের বরাদ্ধ আশাও করি নাই। অচলায়তন লেখায় যদি কোনো চঞ্চলতাই না আনে তবে উহা বৃথা লেখা হইয়াছে বলিয়া জানিব। সংস্কারের জড়তাকে আঘাত করিব, অথচ তাহা আহত হইবে না, ইহাকেই বলে নিস্ফলতা। অবস্থাবিশেষে ক্রোধের উত্তেজনাই সত্যকে স্বীকার করিবার প্রথম লক্ষণ, এবং বিরোধই সত্যকে গ্রহণ করিবার আরম্ভ। যদি কেহ এমন অদ্ভুত সৃষ্টিছাড়া কথা বলেন ও বিশ্বাস করেন যে, জগতের মধ্যে কেবল আমাদের দেশেই ধর্মে ও সমাজে কোথাও কোনো কৃত্রিমতা ও বিকৃতি নাই, অথচ বাহিরে দুর্গতি আছে, তবে সত্যের সংঘাত তাঁহার পক্ষে সুখকর হইবে না, তিনি সত্যকে আপনার শত্রু বলিয়া গণ্য করিবেন। তাঁহাদের মন রক্ষা করিয়া যে চলিবে হয় তাহাকে মূঢ় নয় তাহাকে ভীরু হইতে হইবে। নিজের দেশের আদর্শকে যে ব্যক্তি যে পরিমাণে ভালোবাসিবে সে'ই তাহার বিকারকে সেই পরিমাণেই আঘাত করিবে, ইহাই শ্রেয়স্কর। ভালোমন্দ সমস্তকেই সমান নির্বিচারে সর্বাঙ্গে মাখিয়া নিশ্চল হইয়া বসিয়া থাকাকেই প্রেমের পরিচয় বলিতে পারি না। দেশের মধ্যে এমন অনেক আবর্জনা স্তূপাকার হইয়া উঠিয়াছে যাহা আমাদের বুদ্ধিকে শক্তিকে ধর্মকে চারি দিকে আবদ্ধ করিয়াছে; সেই কৃত্রিম বন্ধন হইতে মুক্তি পাইবার জন্য এ দেশে মানুষের আত্মা অহরহ কাঁদিতেছে—সেই কান্নাই ক্ষুধার কান্না, মারীর কান্না, অকালমৃত্যুর কান্না, অপমানের কান্না। সেই কান্নাই নানা নাম ধরিয়া আমাদের প্রত্যেকের মধ্যে এমন একটা ব্যাকুলতার সঞ্চার করিয়াছে, সমস্ত দেশকে নিরানন্দ করিয়া রাখিয়াছে, এবং বাহিরের সকল আঘাতের সম্বন্ধেই তাহাকে এমন একান্তভাবে অসহায় করিয়া তুলিয়াছে। ইহার বেদনা কি প্রকাশ করিব না। কেবল মিথ্যা কথা বলিব এবং সেই বেদনার কারণকে দিনরাত্রি প্রশ্রয় দিতেই থাকিব? অন্তরে যে-সকল মর্মান্তিক বন্ধন আছে বাহিরের শৃঙ্খল তাহারই স্থূল প্রকাশ মাত্র। অন্তরে সেই পাপগুলোকে কেবলই বাপু বাছা বলিয়া নাচাইব, আর ধিক্‌কার দিবার বেলায় ঐ বাহিরের শিকলটাই আছে? আমাদের পাপ আছে বলিয়াই শাস্তি আছে। যত লড়াই ঐ শাস্তির সঙ্গে? আর, যত মমতা ঐ পাপের প্রতি? তবে কি এই কথাই সত্য যে আমাদের কোথাও পাপ নাই, আমরা বিধাতার অন্যায় বহন করিতেছি? যদি তাহা সত্য না হয়, যদি পাপ থাকে, তবে সে পাপের বেদনা আমাদের সাহিত্যে কোথায় প্রকাশ পাইতেছে? আমরা কেবলই আপনাকে ভুলাইতে চেষ্টা করিতেছি যে, সমস্ত অপরাধ বাহিরের দিকেই। আপনার মধ্যে যেখানে সকলের চেয়ে বড়ো শত্রু আছে, যেখানে সকলের চেয়ে ভীষণ লড়াই প্রতীক্ষা করিতেছে, সেদিকে কেবলই আমরা মিথ্যার আড়াল দিয়া আপনাকে বাঁচাইবার চেষ্টা করিতেছি। কিন্তু আমি আপনাকে বলিতেছি, আমার পক্ষে প্রতিদিন ইহা অসহ্য হইয়া উঠিয়াছে। আমাদের সমস্ত-দেশ-ব্যাপী এই বন্দীশালাকে একদিন আমিও নানা মিষ্ট নাম দিয়া ভালোবাসিতে চেষ্টা করিয়াছি; কিন্তু তাহাতে অন্তরাত্মা তৃপ্তি পায় নাই—এই পাষাণ প্রাচীরের চারি দিকেই তাহার মাথা ঠেকিয়া সে কোনো আশার পথ দেখিতেছে না। বাস রে! এমন নীরক্ষ বেষ্টন, এমন আশ্চর্য পাকা গাঁথনি! বাহাদুরি আছে বটে, কিন্তু শ্রেয় আছে কি। চারি দিকে তাকাইয়া শ্রেয় কোন্‌খানে দেখা যাইতেছে জিজ্ঞাসা করি। ঘরে বাহিরে কোথায় সে আছে। অচলায়তনে আমার সেই বেদনা প্রকাশ পাইয়াছে। শুধু বেদনা নয়, আশাও আছে। ইতিহাসে সর্বত্রই কৃত্রিমতার জাল যখন জটিলতম দৃঢ়তম হইয়াছে তখন গুরু আসিয়া তাহা ছেদন করিয়াছেন। আমাদেরও গুরু আসিতেছেন। দ্বার, রুদ্ধ, পথ দুর্গম, বেড়া বিস্তর, তবু তিনি আসিতেছেন। তাঁহাকে আমরা স্বীকার করিব না, বাধা দিব, মারিব; তবু তিনি আসিতেছেন, ইহা নিশ্চিত। দোহাই আপনাদের, মনে করিবেন না, অচলায়তনে আমি গালি দিয়াছি বা উপদেশ দিয়াছি। আমি প্রাণের ব্যাকুলতায় শিকল নাড়া দিয়াছি; সে শিকল আমার, এবং সে শিকল সকলের। নাড়া দিলে হয়তো পায়ে বাজে। বাজিবে না তো কী! শিকল যে শিকলই সেই কথাটা যেমন করিয়া হউক জানাইতেই হইবে। যে নিজে অনুভব করিতেছে সে অনুভব না করাইয়া বাঁচিবে কী করিয়া। ইহাতে মার খাইতে হয় তো মার খাইব। তাই বলিয়া নিরস্ত হইতে পারিব না। গালিকেই আমার চেষ্টার সার্থকতা মনে করিয়া আমি মাথায় করিয়া লইব, আর-কোনো পুরস্কার চাই না। ইতি ২৭শে অগ্রহায়ণ ১৩১৮। '

ললিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়ের পুত্র শ্রীযুক্ত সলিলকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় এই চিঠিগুলি রক্ষা করেছিলেন, তাই পরবর্তীতে  এগুলি ব্যবহার করা সম্ভব হয়।
    অধ্যাপক এড্‌ওআর্ড্ টমসন র। হয়বীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে তাঁর পুস্তকে অচলায়তনে কোনো কোনো ইংরেজি গ্রন্থের ছায়া আছে, এমন উক্তি করেন। রামানন্দ চট্রোপাধ্যায় মহাশয়কে একটি চিঠিতে (৩ আষাঢ় ১৩৩৪) রবীন্দ্রনাথ এ সম্বন্ধে লেখেন—
    'Castle of Indolence Faerie এবং Queen আমি পড়ি নি- Princess এর সঙ্গে অচলায়তনের সুদূরতম সাদৃশ্য আছে বলে আমার বোধ হয় না। আমাদের নিজেদের দেশে মঠ-মন্দিরের অভাব নেই-আকৃতি ও প্রকৃতিতে অচলায়তনের সঙ্গে তাহাদেরই মিল আছে।'

'আমার ধর্ম' প্রবন্ধে অচলায়তন-প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন—
‌    'যে বোধে আমাদের আত্মা আপনাকে জানে সে বোধের অভ্যুদয় হয় বিরোধ অতিক্রম করে, আমাদের অভ্যাসের এবং আরামের প্রাচীরকে ভেঙে ফেলে। যে বোধে আমাদের মুক্তি 'দুর্গং পথস্তৎ কবয়ো বদন্তি'— দুঃখের দুর্গম পথ দিয়ে সে তার জয়ভেরী বাজিয়ে আসে— আতঙ্কে সে দিগ্‌দিগন্ত কাঁপিয়ে তোলে। তাকে শত্রু বলেই মনে করি; তার সঙ্গে লড়াই করে তবে তাকে স্বীকার করতে হয়। কেননা, নায়মাত্মা বলহীনেন লভ্যঃ অচলায়তনে এই কথাটাই আছে।
    মহাপঞ্চক। তুমি কি আমাদের গুরু।
    দাদাঠাকুর। হাঁ। তুমি আমাকে চিনবে না, কিন্তু আমিই তোমাদের গুরু।
    মহাপঞ্চক। তুমি গুরু? তুমি আমাদের সমস্ত নিয়ম লঙ্ঘন করে এ কোন্ পথ দিয়ে এলে। তোমাকে কে মান্‌বে।
    ‌দাদাঠাকুর। আমাকে মানবে না জানি, কিন্তু আমিই তোমাদের গুরু।
    মহাপঞ্চক। তুমি গুরু? তবে এই শত্রুবেশে কেন।
    দাদাঠাকুর। এই তো আমার গুরুর বেশ। তুমি যে আমার সঙ্গে লড়াই করলে— সেই লড়াই আমার গুরুর অভ্যর্থনা।...
    মহাপঞ্চক। আমি তোমাকে প্রণাম করব না।
    দাদাঠাকুর। আমি তোমার প্রণাম গ্রহণ করব না, আমি তোমাকে প্রণত করব।
    মহাপঞ্চক। তুমি আমাদের পূজা নিতে আস নি?
    দাদাঠাকুর। আমি তোমাদের পূজা নিতে আসি নি, অপমান নিতে এসেছি।

    আমি তো মনে করি আজ য়ুরোপে যে যুদ্ধ বেধেছে সে ঐ গুরু এসেছেন বলে। তাঁকে অনেক দিনের টাকার প্রাচীর, মনের প্রাচীর, অহংকারের প্রাচীর ভাঙতে হচ্ছে। তিনি আসবেন বলে কেউ প্রস্তুত ছিল না। কিন্তু তিনি যে সমারোহ করে আসবেন, তার জন্যে আয়োজন অনেক দিন থেকে চলছিল।'

—সবুজ পত্র। আশ্বিন-কার্তিক ১৩২৪

    অচলায়তনের দুইখানি রবীন্দ্র-পাণ্ডলিপি শান্তিনিকেতনের রবীন্দ্র ভবনে সংরক্ষিত। তন্মধ্যে যেটি প্রথম পাঠ বলে গণ্য তার শেষে রচনার স্থান-কালের উল্লেখ আছে: ১৫ই আষাঢ়। ১৩১৮। শিলাইদা

জন্মদিনের নিজস্ব অনুভূতিতে রবীন্দ্রনাথ ...

















রবীন্দ্রনাথের আশি বছরের জীবনে প্রথম চল্লিশ বছর কোন জন্মজয়ন্তী জাঁকজমকপূর্ণভাবে পালিত হয়নি। জীবনের প্রথমদিকে জন্মদিন নিয়ে কবির তেমন উৎসাহও ছিল না; তাই সে সব জন্মদিনের স্মৃতি কবিচিত্তকে তেমনভাবে আলোড়িত করতে পারেনি। মূলত চল্লিশ বছরের পর থেকেই বেশ সাড়ম্ববরে কবিগুরুর জন্মজয়ন্তী পালন শুরু হয়। রবীন্দ্রনাথ নিজেও তাঁর জন্মজয়ন্তীতে অনেক ভাষণ দিয়েছেন, অনেক কবিতা লিখেছেন।১৩১৭ সালে বোলপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের সংবর্ধনায় কবি প্রথম নিজের জন্মদিনের কথা উল্লেখ করে ভাষণ দেন। ভাষণে তিনি বলেছিলেন যে ,  জন্মদিন সম্বন্ধে তখনো তাঁর কোনো গভীর অনুভূতি ছিলোনা!
"কতো পঁচিশে বৈশাখ চলে গিয়েছে, তারা অন্য তারিখের চেয়ে নিজেকে কিছুমাত্র বড়ো করে আমার কাছে প্রকাশ করেনি।"
  ৫০তম জন্মদিবসে কবি নিজেকে আলোক প্রভায় প্রকাশ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, "আজ আমার জন্মদিনে তোমরা যে উৎসব পালন করছো তার মধ্যে যদি সেই কথাটি থাকে তোমরা যদি আমাকে আপন করে পেয়ে থাকো আজ প্রভাতে সেই পাওয়ার আনন্দকেই যদি তোমাদের প্রকাশ করবার ইচ্ছে হয়ে থাকে তাহলেই এই উৎসব সার্থক। আমার এই পঞ্চাশ বৎসর বয়সেও আমাকে তোমরা নতুনভাবে পেয়েছ, আমার সঙ্গে তোমাদের সম্বন্ধের মধ্যে জরাজীর্ণতার লেশমাত্র লবণ নেই। তাই আজ সকালে তোমাদের আনন্দ উৎসবের মাঝখানে বসে আমার এই নবজন্মের নবীনতা অন্তরে  বাইরে উপলব্ধি করছি।"
   কবির ৫৯তম জন্মজয়ন্তী পালন করা হয় শান্তিনিকেতন আশ্রমে। পঁচিশে বৈশাখের আগের দিন অর্থাৎ ২৪শে বৈশাখ তিনি রচনা করেন, 'আমার জীর্ণ পাতা যাবার বেলায়'।
   ১৩২৮ সালের পঁচিশে বৈশাখে কবি ছিলেন জেনেভায়। সেখানে বাংলার শ্যামল প্রকৃতি ও মাটির আকর্ষণে কবি ব্যাকুল হয়েছিলেন। তিনি এন্ড্রুজকে লিখেছিলেন, "আজিকার দিন যথার্থভাবে আমার জন্য নহে। যাহারা আমাকে ভালবাসে তাদেরই জন্য আনন্দের দিন। তোমাদের কাছ হইতে দূরে আজিকার এই দিন আমার কাছে পুস্তিকার তারিখ মাত্র। আজ একটু নিরালা থাকিতে ইচ্ছা করিতেছে কিন্তু তাহা হইবার নয়।
   এ দিন জার্মান জাতির পক্ষ  থেকে কবিকে সংবর্ধনা জানানো হয়। কবির জন্য টমাসম্যান, অরকন, কাউন্ট কেইসার লিড প্রমুখকে নিয়ে গঠিত হয় সংবর্ধনা কমিটি। কবিকে উপহার দেয়া হয় জার্মান ভাষার সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থসমূহ।
    ১৩২১ সনে কবির ৬২তম জন্মজয়ন্তী পালন করা হয় শান্তিনিকেনে। কবি তখন শান্তিনিকেতনের ছায়ায় গ্রীষ্মের দিনগুলোর সঙ্গে গল্পমগ্ন ছিলেন। এই জন্মদিনে কবি উপহার দিয়েছিলেন 'পঁচিশে বৈশাখ' কবিতা;

'রাত্রি হল ভোর
আজি মোর
জন্মের স্মরণ পূর্ণবাণী,
প্রভাতের রৌদ্রে-লেখা লিপিখানি
হাতে করে আমি
দ্বারে আসি দিল ডাক
পঁচিশে বৈশাখ।'

১৯৩১ সনে কবির ৬৪তম জন্মোৎসবে কবি ছিলেন চীনে। সাথে ছিলেন নন্দলাল বসু, এলমাহার্স্ট, ক্ষিতিমোহন সেন প্রমুখ। অনেক দিন পর কবি সেই পঁচিশে বৈশাখের স্মরণে লিখেছিলেন,

'একদা গিয়েছি চীনদেশে
অচেনা যাহারা
ললাটে দিয়েছে চিহ্ন,
তুমি আমাদের চেনা বলে
যেখানেই বন্ধু পাই সেখানেই নবজন্ম ঘটে।...'

   ১৩৩২-এর পঁচিশে বৈশাখে বিপুল উদ্দীপনায় কবির ৬৫তম জন্মোৎসব পালন করা হলো শান্তিনিকেতনে। এতোদিন যে জন্মদিন শুধু ঘরের মানুষের কাছে ছিল। এবার তা বিশ্বসভার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। কবি এ সময় ইন্দিরা দেবীকে একটি চিঠিতে লিখেছিলেন, "এমন একদিন ছিল যখন আমার জন্মদিনের সার্থকতা তোদের কাছে ছাড়া আর কোথাও ছিল না। ক্রমে এখন এক সময়ে আমার জীবনের ক্ষেত্র বহু বিস্তীর্ণ হয়ে পড়লো সেটা যেন আমার জন্মান্তরের মতো। সেই আমার নবজন্মের জন্মদিন এতদিন চলে এসেছে। যেটাকে আমার জন্মান্তর বললুম তাকে আমার পরলোকও বলা চলে। অর্থাৎ যারা পর ছিল তাদের মধ্যেই একদিন আমার অভ্যর্থনা শুরু হয়েছিলো। তোদের লোক থেকে লোকান্তরগতকে তোরা হয়তো সুষ্ঠু করে দেখতে পাসনি। যে ঘাট থেকে জীবনযাত্রা প্রথম শুরু করেছিলাম আমার কাছেও মাঝে মাঝে তা ঝাপসা হয়ে আসছিল। কিন্তু এটা হলো মধ্যাহ্নকালের কথা। এখন অপরাহ্নের মুলতানী সুর হাওয়ায় বেজে উঠেছে।"

কবির ৬৬তম জন্মদিবসও পালন করা হয় শান্তিনিকেতনে। এই জন্মদিনটি দেশী-বিদেশীদের মিলন মেলায় পরিণত হয়। জন্মদিনে কবি উপহার দিলেন, 'নটীর পূজা' ও 'পরিশেষ' কাব্যের 'দিনাবসান' কবিতা—

'বাঁশি যখন থামবে ঘরে
নিভবে দীপের শিখা।
এই জনমের লীলার পরে
পড়বে যবনিকা
সেদিন যেন কবির তরে
ভিড় না জমে সবার ঘরে
হয় না যেন উচ্চস্বরে
শোকের সমারোহ।'

এই অনুষ্ঠানে কবি ভাষণ দিয়েছিলেন, 'জন্মদিন' নাম দিয়ে তা প্রবাসীতে (জ্যৈষ্ঠ-১৩৩৩ সংখ্যা) প্রকাশিত হয়। "এই শ্যামল ধরণী, এই নদী, প্রান্তর, অরণ্যের মধ্যে আমার বিধাতা আমাকে অন্তরঙ্গতার অধিকার দিয়েছেন, এর মধ্যে নগ্ন শিশু হয়ে এসেছিলুম। আজও যখন দৈববীণা অনাহূত সুরে আকাশে বাজে তখন সেদিনকার সেই শিশু জেগে ওঠে, বলতে চায় কিছু, সব কথা বলে উঠতে পারে না। আজ আমার জন্মদিন সেই কবির জন্মদিন, প্রবীণের না।"

১৩৩৬ সালে জাপানের পথেই হয় কবির জন্মোৎসব। জাহাজের কাপ্তান ও যাত্রীরা কবিকে সম্বর্ধনা জানান।

১৩৩৭ সালে কবির ৬৯তম জন্মজয়ন্তী বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই জন্মদিনে তিনি আত্মপ্রকাশ করেন চিত্রশিল্পীরূপে। প্যারিসের দুই মহিলার উদ্যোগে তাঁর ছবির প্রদর্শনীও হয়। ফ্রান্স থেকেই কবি ইন্দিরা দেবীকে লেখেন, "ধরাতলে যে রবিঠাকুর বিগত শতাব্দীর ২৫শে বৈশাখে অবতীর্ণ হয়েছেন তাঁর কবিত্ব সম্প্রতি আচ্ছ্ন্ন, তিনি এখন চিত্রকররূপে প্রকাশমান।... এই বার আমার চৈতালি বর্ষ শেষের ফসল সমুদ্রপারের ঘাটে সংগ্রহ হলো।

১৩৩৮ সনে কবির ৭০তম জন্মজয়ন্তীতে সমগ্র জাতির পক্ষ থেকে কলকাতায় তাঁকে সম্বর্ধনা দেয়া হয়। সভাপতির ভাষণে শরৎচন্দ্র কবিকে মানবাত্মার কবি হিসেবে অভিহিত করেন। জন্মদিনের ভাষণে কবি বলেন- "একটি মাত্র পরিচয় আমার আছে, যে আর কিছুই নয়, আমি কবি মাত্র। আমার চিত্ত নানা কর্মের উপলক্ষে ক্ষণে ক্ষণে নানা জনের গোচর হয়েছে। তাতে আমার পরিচয়ের সমগ্রতা নেই। আমি তত্ত্বজ্ঞানী, শাস্ত্রজ্ঞানী, গুরু বা নেতা নই-কদিন আমি বলেছিলাম 'আমি চাইনে হতে নববঙ্গে নবযুগের চালক- সে কথা সত্য বলেছিলাম।... এই ধুলো মাটি ঘাসের মধ্যে আমি হৃদয় ঢেলে দিয়ে গেলাম, বনস্পতি, ঔষধির মধ্যে। যারা মাটির কোলের কাছে আছে, যারা মাটির হাতে মানুষ, যারা মাটিতেই হাঁটতে আরম্ভ করে, শেষকালে মাটিতেই বিশ্রাম করে, আমি তাদের সকলের বন্ধু-আমি কবি।... "
কবি ৭১তম জন্মদিনে ছিলেন ইরানে। সেখানে তিনি রচনা করেছিলেন,
'ইরান, তোমার সম্মান মালে
নব গৌরব বহি নিজ ভালে
সার্থক হলো কবির জন্মদিন।'
   ১৩৪২ সালে কবির ৭৪তম জন্মদিবস পালিত হয়। এ দিবসে পাওয়া যায় তাঁর নতুন উপলব্ধি জীবন ও জগৎ এবং মানুষ ও বিশ্বপ্রকৃতি সম্পর্কে  । কবি রচনা করেন 'পঁচিশে বৈশাখ চলেছে।' কবিতাটি উৎসর্গ করেন, অমিয়চন্দ্র চক্রবর্তীকে—
 পঁচিশে বৈশাখ চলেছে
জন্মদিনের ধারাকে বহন করে
মৃত্যু দিনের দিকে।
সেই চলতি আসনের উপর বসে
কোন কারিগর গাঁথছে মালা
ছোটো ছোটো জন্ম মৃত্যুর সীমানায়
নানা রবীন্দ্রনাথের একখানা মালা।'

১৩৪৪ সালে কবির ৭৭তম জন্মদিবস পালিত হয় আলমোড়ায়। জন্মদিনের তিনদিন আগেই কবি 'জন্মদিন' নামে কবিতা রচনা করেছিলেন।
১৩৪৫ সনে কবির ৭৮ তম জন্মজয়ন্তীতে তাঁর কবিতা যুদ্ধবিরোধী চেতনায় মুখর হয়েছিলো।
একদিকে কি অমানুষিক স্পর্ধা আর একদিকে কি অমানুষিক কাপুরুষতা। তিনি কালিম্পং থেকে বেতারে পড়ে শোনান সেঁজুতির 'জন্মদিন' কবিতাটি
'আজ মম জন্মদিন।
জন্মদিন মৃত্যুদিন, একাসনে দোহে বসিয়াছে,
দুই আলো মুখোমুখি মিলিছে জীবন প্রান্তে মম,
...
হে মানুষ, হে ধরণী—
তোমার আশ্রয় ছেড়ে যাবে যবে, নিও তুমি গণি
------------------------------'
কবির ৭৯তম জন্মোৎসব পালিত হয় পুরীতে। সেখানে সরকারীভাবে কবিকে সংবর্ধনা দেয়া হয়। অনুষ্ঠানে কবি ভাষণ দেন, কবিতা পাঠ করেন। তিনি রচনা করেন, 'নবজাতকের' 'জন্মদিন' কবিতা।
'তোমরা যাকে রবীন্দ্রনাথ বলে জানো সে আমি নই'।
১৩৪৭ সালের ২৫শে বৈশাখে কবি মংপুতে ছিলেন মৈত্রেয়ী দেবীর অতিথি হিসেবে।
কবির আশিতম জন্মজয়ন্তীতে লিখলেন, 'জন্মদিনে' কাব্য—
'সেদিন আমার জন্মদিন।
প্রভাতের প্রণাম লইয়া
উদয় দিগন্ত পানে মেলিলাম আঁখি।'
এ জন্মোৎসব যেমন কবির জীবদ্দশায় সর্বশেষ জন্মোৎসব, তেমনি সভ্যতার সংকটও কবির শেষ অভিভাষণ। পহেলা বৈশাখ শান্তিনিকেতনে জন্মদিনের উৎসবে লেখা। ভাষণের শেষদিকে কবি বলেছিলেন, 'আজ আশা করে আছি, পরিত্রাণকর্তার জন্মদিন আসছে আমাদের এই দারিদ্র্য লাঞ্ছিত কুটীরের মধ্যে, অপেক্ষা করে থাকবো, সভ্যতার দৈববাণী নিয়ে আসবে, মানুষের চরম আশ্বাসের কথা মানুষকে বসে শোনাবে এই পূর্বদিগন্ত থেকে। আজ পারের দিকে যাত্রা করেছি, পিছনের ঘাটে কি দেখে এলুম, কি রেখে এলুম, ইতিহাসের কি অকিঞ্চিৎকর উচ্ছিষ্ট সভ্যতাভিমানের পরিকীর্ণ ভগ্নস্তুপ কিন্তু মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ, সে বিশ্বাস শেষ পর্যন্ত রক্ষা করবো। আশা করবো, মহাপ্রলয়ের পরে বৈরাগ্যের মেঘমুক্ত আকাশে ইতিহাসের একটি নির্মল আত্মপ্রকাশ হয়তো আরম্ভ হবে এই পূর্বাচলের সূর্যোদয়ের দিগন্ত থেকে। আর একদিন অপরাজিত মানুষ নিজের জয়যাত্রার অভিযানে সকল বাধা অতিক্রম করে অগ্রসর হবে তার মহৎ মর্যাদা ফিরে পাবার 'পথে। মনুষ্যত্বের অন্তহীন প্রতিকারহীন পরাভবকে চরম বলে বিশ্বাস করাকে আমি অপরাধ মনে করি।'

— সুনীতি দেবনাথ

★  সহায়তা : গীতবিতান / Facebook

জন্মদিনে লহো প্রণাম হে বিপ্লবী কবি






















নজরুল সাহিত্যে পর্তুগিজ ও স্প্যানিস ভাষায় অনুুবাদ
— সুনীতি দেবনাথ

দুই বাংলার প্রাণের কবি কাজী নজরুলের মহাপ্রয়াণের পর তাঁকে, তাঁর সাহিত্যকে বিশ্বময় ছড়িয়ে দেবার একটা প্রয়াস পরিলক্ষিত হয়। আর এই কাজে নজরুল সাহিত্যের অনুবাদ সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হবে বলে অনেকেই মনে করেন। নজরুল দৌহিত্রী খিলখিল কাজী ও অনিন্দিতা কাজীর এ বিষয়ে বিশেষ উদ্যোগের কথা আমাদের আশান্বিত করে। তেমনি নজরুল পরিবারের বাইরে বহির্বিশ্বে নজরুল প্রেমীদের উদ্যোগও আমাদের উৎসাহিত করে।
  বৈভবময় সৃষ্টির আলোয় আলোকিত  কবি কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্যকর্ম। প্রেম, দ্রোহ ও সাম্যের এই কবির নির্বাচিত কিছু সৃষ্টিকর্ম এবার অনূদিত হলো পর্তুগিজ ও স্প্যানিশ ভাষায়। ফলে এখন থেকে বিশ্বের উল্লেখযোগ্য এই দুই ভাষার পাঠকরাও সুযোগ পেলেন এই কবির কালজয়ী গান, কবিতা বা গদ্যের স্বাদ আস্বাদনের।
    বাংলাদেশের  জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের নির্বাচিত সাহিত্যকর্ম অনূদিত হয়েছে পর্তুগিজ ও স্প্যানিশ ভাষায়। পর্তুগিজ ভাষায় বইটির নাম নজরুল: প্রোজাই পোয়েসিয়া সিলেসোনাডোস। অনুবাদ করেছেন পর্তুগালের লেখিকা ওনা হিটা বাপটিসস্টা হোদরিগেজো সিনতো। এতে নজরুলের বিদ্রোহী, ধূমকেতুসহ মোট ৭৮টি কবিতা, গান ও প্রবন্ধ স্থান পেয়েছে।
অন্যদিকে স্প্যানিশ ভাষায় নজরুল: প্রোসা ই পোয়েমাস সিলেকতোস বইটি অনুবাদ করেছেন ইকুয়েডরের লেখিকা, গবেষক ও সাংবাদিক মারিয়া এলেনা বাররেরা আগরওয়াল। এতে স্থান পেয়েছে নজরুলের বিদ্রোহী, ধূমকেতুসহ দেড় শ কবিতা, গদ্য ও গান।
   অনুবাদের পরপর ঢাকার  নজরুল ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে বই দুটির মোড়ক উন্মোচন করা হয়। নজরুল ইনস্টিটিউটের বোর্ড অব ট্রাস্টিজের সভাপতি ইমেরিটাস অধ্যাপক রফিকুল ইসলামের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, বিশেষ অতিথি পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম, ঢাকার ব্রাজিল দূতাবাসের ডেপুটি চিফ অব মিশন হুলিয়া সিসার সিলভা এবং স্পেন দূতাবাসের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স প্যাত্রিক স্যান্ডোভাল নিকোলস। স্বাগত বক্তব্য রাখেন  ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ইকরাম আহমেদ।
সংস্কৃতিমন্ত্রী বলেন, ‘কাজী নজরুল ইসলাম অসাম্প্রদায়িক চেতনার কবি। অন্যায়-অবিচারকে রুখে দিয়ে কীভাবে শির উঁচু করে অগ্রসর হতে হয়, তিনি আমাদের শিখিয়েছেন।’ তিনি বলেন, জাতীয় কবির নির্বাচিত সাহিত্যকর্ম পর্তুগিজ ও স্প্যানিশ ভাষায় অনূদিত হওয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এর মাধ্যমে নজরুল ও তাঁর সৃষ্টিকর্মকে পৃথিবীব্যাপী তুলে ধরা সম্ভব হবে।
রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘ইতিমধ্যে ইংরেজি, উর্দু, ফরাসি, ইতালিয়ান, চীনা ও জাপানি ভাষায় নজরুলের নির্বাচিত সাহিত্য অনূদিত হয়েছে। আজ আরও নতুন দুটি ভাষায় অনূদিত হলো। এখন আরবি ভাষায় নজরুলসাহিত্য অনুবাদের চেষ্টা চলছে। বাংলাদেশের জাতীয় কবির সাহিত্য সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দিতে আমরা কাজ করে যাচ্ছি।’
    আলোচনার পর নজরুলের বিদ্রোহী ও ধূমকেতু কবিতা দুটি আবৃত্তি করেন শাহাদাত হোসেন নিপু। এ ছাড়া পর্তুগিজ ও স্প্যানিশ ভাষায়ও কবিতা দুটি আবৃত্তি করা হয়। অনুষ্ঠানে নজরুলের গান গেয়ে শোনান ফেরদৌস আরা ও ইয়াকুব আলী খান।

কাজরী,
২৫ মে, ২০১৮

কবিতার কান্না




© সুনীতি দেবনাথ

কবিতাটা  উড়িয়ে দিলাম আকাশে
প্রলয়ঙ্কর আকাশে তখন মেঘের সজ্জা
দৃষ্টির সীমান্ত পেরিয়ে মেঘের গা ছুঁয়ে ছুঁয়ে
কবিতা একে একে বাতাসের স্তর পেরিয়েছে
মহাকাশে উড়ছে মনে হয়
তাকে আর দেখতে না পেয়ে
বুকটা কি এক বেদনায় হু হু কেঁদে উঠলো
অথচ কবিতার সঙ্গে শর্ত ছিলো
মেঘের সঙ্গে খেলে ফিরে আসার
মেঘের সঙ্গে শর্ত ছিলো বৃষ্টি দিয়ে
সারা পৃথিবীতে কবিতা ছড়িয়ে দেবার
কথা রাখেনি কেউ তাই বেদনা
আজ রাতের আঁধারে ঘুম আসেনি
চাপা যন্ত্রণায় কেবল এপাাশ ওপাশ
হঠাৎ করে কবিতা এলো রক্ত মেখে
কি হয়েছে কোথায় ছিলে জবাব নেই
এতো রক্ত কেন এতো কান্না কেন
 সব মানুষের রক্ত লাল
সারা দেশটা রক্তে  লাল
রাজপথ গলিপথ বাড়ির অঙ্গন
ঘরদোর  সব লালে লাল
ওগো বৃষ্টি ঝরো তুুমি ধুয়ে নাও সব রক্ত
মিশরে স্ফিংক্স অট্টহাসি হেসে উঠলো
শেষ মমি গলে প্যাপিরাসে মিশে গেলো

কাজরী,
২২মে, ২০১৮

মণিপুরী নৃত্যগুরু ও গবেষক বিপিন সিংহ



















© সুনীতি দেবনাথ

ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলের একমাত্র ক্ল্যাসিকাল নৃত্য বলা চলে মণিপুরী নৃত্য। আর গুরু বিপিন সিংহ কিংবদন্তী নৃত্যশিল্পী, গুরু ও গবেষক। নিঃসন্দেহে বিপিন সিংহের সমতুল্য গুরু, গবেষক তথা সংগঠক মণিপুরী নৃত্যের জগতে আর জন্মগ্রহণ করেছেন বলে মনে হয়না।
   বিপিন সিংহের পিতা ছিলেন একজন ট্রাডিশনাল বৈদ্য ও গায়ক। গত শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে অর্থাৎ ১৯১৮ সালের ২৩ শে আগষ্ট বিপিন সিংহের  জন্ম হয়। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর  যখন সিলেটে এসে প্রথমবারের মতো মণিপুরী নৃত্য দেখে যান তার ঠিক পনেরো মাস পর গুরু বিপিন সিংহ জন্মগ্রহণ করেন, পুণ্য মাতৃভূমি সিঙ্গারী গ্রামে,পুণ্য লেইখমসেনা সিংহ ও পুণ্যবতী গর্ভধারিনী মাতা ইন্দুবালা দেবীর কোলে। শৈশবাবস্থায়ই তিনি মণিপুরী নৃত্য এবং সঙ্গীত বিষয়ে শিক্ষা  নিতে শুরু করেন। পাশাপাশি তিনি মণিপুরী নৃত্যের জন্যই সঙ্গীত ও নৃত্য সম্পর্কে গভীর পড়াশোনা করতে লাগলেন। তিনি গুরু আমোদন শর্মার নিকট শিক্ষা নিতে লাগলেন।মণিপুরের রাজাও বিপিন সিংহকে যথেষ্ট সাহায্য করতে লাগলেন।  পরে মণিপুরী নৃত্যের জন্য মণিপুুরের ইম্ফলে মণিপুরী নর্তনালয় স্থাপন করেন। ১৯৭২ সালে কলকাতায় তিনি মণিপুরী নর্তনালয় নামে নৃত্য শিক্ষার বিদ্যালয় স্থাপন করেন। তিনি বহু ছাত্রীকে উপযুক্ত নৃত্য ও সঙ্গীতে পারদর্শী করে তুলেন। যেমন জাভেরী  ভগ্নীদের মত( দর্শনা জাভেরী ), বিনোদিনী দেবী, গুণেশ্বরী দেবী, প্রীতি প্যাটেল, শ্রুতি ব্যানার্জি, লতাসনা দেবী, লায়লী বসু, ইন্দ্রানী দেবী, মনোরমা দেবী, পৌষালী চাটার্জি, সোহিনী রায়, বিম্বাবতী দেবী, রঞ্জিনী বসুদের মত ছাত্রী তাঁর কাছে শিক্ষা নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হন। জীবিকা নির্বাহের জন্য তিনি কোরিওগ্রাফি করতেন। তিনি অনেক নৃত্যনাট্যের কোরিওগ্রাফী করেন এবং একক নৃত্যের জন্যও। কোরিওগ্রাফি, নির্দেশনা এবং গবেষণা তিনি প্রভূত পরিশ্রম করে একই সঙ্গে সুদক্ষভাবে করে গেছেন।

 নৃত্যগুরু বিপিন সিংহ বিগত ৬০ বছর ধরে মণিপুরী গীত-নৃত্যের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গবেষণা করে গেছেন। পাশাপাশি তিনি বৈষ্ণব পদাবলীরও চর্চা করে গেছেন। তিনি বহু প্রচলিত এবং বিখ্যাত গীত-নৃত্যের সংগ্রহ করে এগুলোকে বিশুদ্ধ করে ব্যবহার করেছিলেন। গুরু বিপিন সিংহ ধ্রুপদী ভারতীয় গীত-নৃত্যের সাথে জড়িত বিভিন্ন লিরিক তাঁর কলকাতা এবং মণিপুরের ঘরে ব্যক্তিগতভাবে সংগ্রহ করে রেখেছেন। গুরু বিপিন সিংহ খুবই সাফল্যের সহিত মন্দির এবং সমাজের গণ্ডীর ভিতরে আবদ্ধ হয়ে থাকা মণিপুরী নৃত্যকে তার ঐতিহ্য এবং বিশুদ্ধতা রক্ষা করে বিশ্বমঞ্চে উপস্হাপিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। মণিপুরী নৃত্যে নিজের সম্পূর্ণ জীবন উৎসর্গ করেছিলেন বলে এর অন্য নাম গুরু বিপিন সিংহ। ঋষিতুল্য এই পুরুষ ধ্রুপদী পরম্পরা রক্ষা করে মণিপুরী নৃত্যকে জনপ্রিয় করে উপস্থাপন করতে আপ্রাণ চেষ্টা করে গেছেন। গুরুর আরেকটি উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে ছিল- আট/দশ ঘণ্টা দীর্ঘ রাসনৃত্যকে মাত্র ঘণ্টা-দেড়ঘণ্টার ভিতরে সংক্ষেপ করা সত্ত্বেও এর ভিতরে প্রভূত উপকরণ এবং নাটকীয়তা বজায় রেখে নতুনরূপ দিয়ে মঞ্চোপযোগী করেছিলেন। শাস্ত্রীয় মণিপুরী নৃত্যে যে মাধুর্য আছে তা গুরু নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে আবিষ্কার করেছিলেন। বৈষ্ণব পদাবলী এবং পুরাণ নিয়ে গুরুর রচনাসমগ্র আত্মিক অনুধাবন করে এগুলোর উপর নতুন ধরণের গীত রচনা করেছিলেন। যে গীতের ভিতর শাস্ত্রীয় মণিপুরী গীতের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য প্রকটভাবে ফুটে উঠার পাশাপাশি বর্তমান যুগের সাংস্কৃতিক চেতনারও উন্মেষ ঘটে।
গুরু বিপিন সিংহ যে কত সুদক্ষ পরিচালক ছিলেন তা Bengal Music Festival -এর পরিচালনায় অনুভব করা যায়।
‘নৃত্য চিরন্তন : মণিপুরী, ভরতনাট্যম, কত্থক নৃত্যার্ঘ’ শীর্ষক দুই পর্বের নৃত্য পরিবেশনার মধ্য দিয়ে শুরু হয় চতুর্থ দিনের আয়োজন। এ পরিবেশনার নৃত্য পরিচালনায় ছিলেন গুরু বিপিন সিংহ, পণ্ডিত বিরজু মহারাজ, শিবলী মহম্মদ; এবং নৃত্য ভাবনা, সার্বিক নৃত্য পরিচালনা ও সমন্বয়কারী হিসেবে ছিলেন শর্মিলা বন্দ্যোপাধ্যায়। মণিপুরী নৃত্যে তাল-তানচেপ-৪ মাত্রায় রাধা রূপ বর্ণন করেন সুদেষ্ণা স্বয়ম্প্রভা; নৃত্য ও সঙ্গীত পরিচালনায় ছিলেন গুরু বিপিন সিংহ, কণ্ঠে গুরু কলাবতী দেবী। এরপর তাল-সপ্ততাল ২০ মাত্রায় কালীয় দমন পরিবেশন করেন সুইটি দাস; নৃত্য ও সঙ্গীত পরিচালনা করেন বিপিন সিংহ, কণ্ঠে ছিলেন দ্রৌপদী দেবী। মণিপুরী নৃত্যের সর্বশেষ অংশের পরিবেশনায় ছিলেন শিব স্তুতি। নৃত্য পরিচালনায় ছিলেন বিম্বাবতী দেবী, সঙ্গীত পরিচালনায় গুরু লাকপতি সিং এবং কণ্ঠে দ্রৌপদী দেবী।

এখানে প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায় কলাবতী দেবী গুরু বিপিন সিংহের দ্বিতীয়া পত্নী এবং পূর্বে ছাত্রী ছিলেন। তাঁদের দুজনের কন্যা এবং ছাত্রী বিম্বাবতী দেবী। মণিপুরী নৃৃত্যে যেমন সুুুুদক্ষা ছিলেন বিম্বাবতী দেবী ,তেমনি ছিল তাঁঁর সুুুুগভীর পাণ্ডিত্য। বিপিন সিংহের প্রথমা পত্নীর ছয় সন্তান। তাঁরা বিপিন সিংহের পৈতৃক বাড়িতে থাকেন। এঁরা সবাই আর্য বিষ্ণুপুরী ভাষায় কথা বলেন। বিপিন সিংহরা বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী, তাঁদের সংস্কৃতি মেইতেই মণিপুরীদের থেকে আলাদা। প্রথম পত্নী এবং তাঁর সন্তানেরা কোনদিন সরকারি সম্মান পাননি। বিপিন নর্তনালয়ের উত্তরসূরীর খ্যাতিও ভোগ করেননি। পিতা জীবিত থাকতে তাঁরা গ্রামের মণ্ডপে মাঝে মাঝে নৃত্যের অনুষ্ঠান করেছেন। প্রকৃতপক্ষে এখন ক্লাসিক্যাল মণিপুরী নৃত্যের লাগাম বিষ্ণুপ্রিয়াদের হাতছাড়া হয়ে গেছে। মেইথেইরা এর উপর কর্তৃত্ব করছে।

 মণিপুরী নৃত্যের একজন লিজেণ্ড  ও ন়ৃত্যবিশারদ গুরু বিপিন সিংহ তাঁর প্রতিভা ও কৃতিত্বের স্বীকৃতি হিসেবে জীবনে বহু পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন। সেগুলির একটি তালিকা উপস্থাপন করা হচ্ছে।

সম্মান এবং পুরস্কার
-----——--------------—-
তিনি জীবনে বহু সম্মান এবং পুরস্কার অর্জন করেছেন। এর ভিতরে উল্লেখযোগ্য কিছু–

১. নর্তনাচার্য (১৯৫৯ ইংরেজিতে),

২. হাঞ্জাবা (১৯৬১ ইং),

৩. জাতীয় সঙ্গীত নাটক একাডেমি পুরস্কার  (১৯৬৫ ইং),

৪. শ্রীহট্ট সম্মেলন পুরস্কার (১৯৮১ ইং),

৫. বিশ্ব উন্নয়ন সংসদ পুরস্কার (১৯৮২ ইং),

৬. কলাভারতী (১৯৮৩ ইং),

৭. প্রতিশ্রুতি পরিষদ পুরস্কার (১৯৮৪ ইং),

৮. সারঙ্গদেব ফেলোশিপ (১৯৮৪ ইং),

৯. উদয় শঙ্কর পুরস্কার (১৯৮৬ ইং),

১০. ওজা রত্ন (১৯৮৮ ইং),

১১. সঙ্গীত শ্যামলা পুরস্কার (১৯৮৮ ইং),

১২. এমিরেটাস ফেলোশিপ (১৯৮৯ ইং),

১৩. কালিদাস সম্মান (১৯৯০ ইং),

১৪. বহুলকা পুরঙ্কার (১৯৯১ ইং),

১৫. অনামিকা কলা সঙ্গম -পুরস্কার (১৯৯২ ইং),

১৬. পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য একাডেমি এওয়ার্ড (১৯৯২ ইংরেজিতে)।

সম্মান জানানো সংস্হা এবং সাল যথাক্রমে -

১. রূপকার ডান্স একাডেমি (১৯৯৪ ইং),

২. নুপূর ডান্স একাডেমি (১৯৯৫ ইং),

৩. সুরনন্দন ভারতী (১৯৯৫ ইং),

৪. শিরোমণি পুরস্কার (১৯৯৬ ইং),

৫. নিখিল বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী পুরস্কার (১৯৯৭ ইং),

৬. অঙ্গাহার ডান্স একাডেমী (১৯৯৮ ইং), ইত্যাদি
গুরু বিপিন সিংহ প্রয়াত। গতবছর তাঁর জন্ম শতবার্ষিকী কলকাতায় এবং বর্তমান আসামের কাছাড় জেলার শিলচরের কাছে তাঁঁর জন্ম ভিটেতে উদযাপন করা হয়। গুরু বিপিন সিংহ নৃত্যবিশারদের জন্য ভারতবাসী গর্ব অনুভব করে।

কাজরী,
১জুন, ২০১৮

ক্লান্তি






© সুনীতি দেবনাথ

দুপুরের খরতাপও শেষ
ছায়া ছায়া অপরাহ্ন
ক্লান্তির ডানা ঝাপটায়
নীরবতা একাকীত্ব বিষাদে বিলীন
দুচোখের কোলে কালো ছোপ
তবু ওষ্ঠে গোধূলির সোনা কুচি
এখনো চিলিক দেয়
বিকেলের শেষ আলো ক্লান্ত
বকের উড়ন্ত সারিতে লুকোচুরি খেলে
অনামিকা
এই অশোক তরুর তলে বসে
দুজনে মিলে কবিতা পড়ি চলো
নাহয় তোমার গলায় শুনি
ক্লান্তি আমার ক্ষমা করো প্রভু...
আর হঠাৎ ঝরা দু ' ফোঁটা অশ্রু
গোপনে মুছি অপরাহ্নিক আঁচলে

কাজরী,
২ মে, ২০১৮

জ্যোৎস্নার প্লাবন







© সুনীতি দেবনাথ

উঠোনে সশব্দে পড়লো জ্যোৎস্না
চমকে জেগে উঠলাম আমি

জানলা খুলে দেখি শব্দ নেই
উঠোনটা বাড়িটা ভাসছে
থৈথৈ চাঁদ ভাঙা রূপসী জোৎস্নায়
বাড়িশুদ্ধ লোক ঘুমের গহীনে
কেউ জানলো না শুনলো না
চাঁদে আজ প্রলয় মেতেছে
সব জোৎস্না তাই পৃথিবীর বুকে
ঝাঁপিয়ে দাপিয়ে তরঙ্গিত সমুদ্র
চাঁদ শুধু কলঙ্ক বুকে কাঁদে অনিবার
এমন চাঁদনি রাত
এমন কল্লোলিত জ্যোৎস্নার প্লাবন
কদাচিৎ আসে ভাসে পৃৃথিবী

কাজরী,
১২ মে, ২০১৮