লেখা-লেখি

জন্মদিন পালন রীতির প্রচলন

৬:৪৯:০০ PM 0 Comments






© সুনীতি দেবনাথ

সারা পৃথিবীতেই নানা স্থানে বর্তমানে জন্মদিন পালন করা হয় প্রায় সকল সমাজে। একসময় জন্মদিন পালনের প্রথা ছিলো না। এখন জন্মদিন পালন করার পেছনে আনন্দ প্রাপ্তিকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। একসময় জ্ঞানী গুণীজনদের জন্মদিন পালন করা হতো। এখন ব্যক্তিমাত্রেরই জন্মদিন পালন করার রেওয়াজ চালু হয়েছে। জন্মদিন পালনের প্রয়োজন কেন হলো তার উত্তর কিন্তু কেবল আনন্দ নয় বা সহজ নয়।

  বেশ কয়েক হাজার বছর থেকে জন্মদিন পালনের রেওয়াজ চলে আসছে। আমাদের দেশে কিন্তু সুপ্রাচীন কাল থেকে জন্মদিন পালনের প্রথা ছিলো না। জন্মদিন পালনের প্রথা প্রধানত একটি ধর্মীয় গোষ্ঠীর বিশ্বাস থেকে  শুরু হয়েছিল। পৌত্তলিকতা এর মূলে । পৌত্তলিক (pagan) বিশ্বাস ও সংস্কৃতি জন্মদিন পালনের প্রথাকে চালু করেছে।

প্রাচীন মিশরে ৩০০০ খ্রীস্ট পূর্বাব্দে ফেরাউনদের জন্মদিন পালন করা হতো। কারণ ফেরাউনরা দেবদেবী হিসেবে জন্মগ্রহণ করতেন মনে করা হতো। কেক মোমবাতির প্রচলন তখনও হয়নি।

আসল  জন্মদিন পালন শুরু হয় প্রাচীন গ্রীসে। প্যাগানরা বিশ্বাস করতো প্রতিটি মানুষই একটি আত্মা নিয়ে জন্মায় এবং মৃত্যুর পর তাদের আত্মা আলো হয়ে পৃথিবীতে থেকে যায়।
তারা কেক মোম জ্বালাতো এবং পুরোটা জ্বলে যাবার আগেই তা নিভিয়ে দিতো, এতে বোঝাতো যে জীবন সায়াহ্নের এখনো সময় হয়নি।

গ্রীকদের জম্মদিনের কেক সবসময় গোল করে বানানো হতো, এর একটা কারন আছে,চন্দ্র অধিষ্ঠাত্রী দেবী আর্টেমিস কে সম্মান প্রদর্শন করে চন্দ্রের আকৃতিতে গোল করে এটি বানানো হতো। উল্লেখ্য দেবী আর্টেমিস- দেবতা জিউস ও দেবী লেটোর কন্যা, অ্যাপোলো'র সহোদরা। গ্রীকরা গোল কেক এর উপর বিশেষ পদ্ধতিতে মোমবাতি জ্বালাতো যার দ্বারা চাঁদের আলোর বিচ্ছুরণ বুঝানো হতো।
.

"Cake" শব্দটা viking শব্দ "Kaka" থেকে এসেছে। যার দ্বারা একধরণের বিশেষ রুটিকে বোঝানো হতো। ২০০০ বছর পূর্বে প্রাচীন গ্রীসে জন্মদিন পালিত হত গোলাকার মোটা একখণ্ড রুটির দ্বারা, যার দুই দিকই ছিলো শক্ত। যা বানানো হতো গমের আটা, জলপাই তেল, মধু এবং গুড়ো গুড়ো পনির দ্বারা।

"Happy Birthday to You" গান কিভাবে আসে জানা দরকার।
১৯৯৮ সালের গিনিজ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস অনুসারে এটি বিশ্বে সবচেয়ে বেশিবার গাওয়া গান।
১৮৯৩ সালে দুই বোন “প্যাটি হিল” এবং “মিলড্রেড জে হিল” দুজনে মিলে “good morning to all” শিরোনামে গানটি লেখেন ও সুর করেন। যা স্কুলে বাচ্চারা ক্লাস শুরু হওয়ার আগে গাইতো।
১৯১২ সালে তাঁরা লিরিকগুলো পরিবর্তন করে "Happy birthday to you" গান রচনা করেন।
.
বিভিন্ন ধর্মের দৃষ্টিতে এটি খুবই নিষিদ্ধ ব্যাপার। এই বিষয়ে বহু প্রামাণ্য লেখা নানা উৎসে চোখে পড়ে।
খ্রিষ্টীয় সমাজে বিভিন্ন সময়ে বহু খৃস্টানকে একে এড়িয়ে যেতে দেখা গেছে শুধুমাত্র প্যাগানের রীতি থেকে এসেছে বলে। শুরুতে এর ঘোর বিরোধীতা হলেও চতুর্থ শতাব্দীর পর খৃষ্টীয় সমাজে যিশু খৃষ্টের জন্মদিন পালন শুরু হয়।

জুলিয়াস সিজারকে মৃত্যুর দুই বছর আগেও  ১৩ জুলাই ৪২ খৃস্ট পূর্বাব্দে জন্মদিন পালন করতে দেখা যায়। সিজার ৫৫ বছর বয়সে  রোমে মৃত্যুবরণ করেন।জন্মদিন মূলত পুরুষরা পালন করত, নারীদের জন্য এটি ছিলো নিষিদ্ধ। ১২০০ খৃষ্টাব্দের পর নারীরাও জন্মদিন পালন শুরু করে।

বাংলায় জন্মদিন পালন রীতি  প্রচলন করেন জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের দ্বিতীয় পুত্র সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী "জ্ঞানদানন্দিনী দেবী"।জ্ঞানদানন্দিনী দেবী প্রতিভাময়ী ছিলেন। বাংলায় নানা কিছুর প্রবর্তন তিনি করেন। যেমন বাঙালি নারীদের বর্তমান শাড়ি পরার রীতি।
আগে  বাংলায় বিখ্যাত মানুষদের জন্ম- মৃত্যুর হিসেব রাখা হলেও কখনো জন্মদিন পালন হতো না। সাধারণ মানুষদের মধ্যে বেশিরভাগই তাঁদের জন্ম তারিখ মনে রাখতেন না।
১৮৭৭ সালে গর্ভবতী অবস্থায় জ্ঞানদানন্দিনী দেবী ইংল্যান্ডে যান, তিনিই প্রথম ভারতীয় নারী যিনি সাগর পাড়ি দিয়েছিলেন তাও কোন পুরুষ সঙ্গী ছাড়া ।
ব্রিটেনে তিনি জন্মদিন পালন দেখেন এবং তা তাঁকে অনুপ্রাণিত করে। কলকাতায় ফিরে আসার পর তিনি তাঁর পুত্র সুরেনের জন্মদিন প্রথম পালন  করেন।জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি বঙ্গ সংস্কৃতির পীঠস্থান এবং এই বাড়িতে প্রতিভার ছড়াছড়ি, জ্ঞানী গুণীজনদের প্রবাদ প্রতিম অবস্থান লক্ষণীয়। প্রথম জন্মদিনের উৎসব থেকে ফেরার পর জোড়াসাঁকোর শিশুদের মাঝে একধরণের উন্মাদনা জেগে উঠে এবং শুধু তাই না শিশুরা তাদের জন্ম কবে হয়েছিল তার খোঁজ নিতে শুরু করলো। জন্মদিন প্রথা দ্রুত ছড়িয়ে যেতে থাকে, শেষে ব্রাহ্ম সমাজও এটিকে গ্রহণ করেছিল। (সূত্র: সরলা দেবী চৌধুরানী, জীবনের ঝরাপাতা)।
আজ জন্মদিন প্রথা সমগ্র কলকাতা ছাড়িয়ে বাংলা দেশেও গিয়ে  পৌঁছে গেছে ।যদিও এর শুরুটা ছিলো ধর্মীয় বিশ্বাস, দেবতাদের সন্তুষ্ট করার নিমিত্তে।
কিন্তু বর্তমান যুগে কেউ কোন দেবতা বা বিশ্বাস থেকে পালন করেনা, স্রেফ আনন্দ আর স্মরণীয় করে রাখার জন্যই জন্মদিন পালন করে, তাই বর্তমান জন্মদিন আর পূর্বের জন্মদিনের সাথে বিশ্বাসগত সম্পর্ক বা নিষিদ্ধতা খোঁজা বৃথা।

কাজরী,
২১ সেপ্টেম্বর ,২০১৭

SUNITI Debnath

আমি সুনীতি দেবনাথ, অবসরপ্রাপ্ত সরকারি শিক্ষিকা। কবিতা, প্রবন্ধ ও ছোটগল্প লিখি। কবিতা আমার প্রিয়ভূমি, শৈশব থেকেই হেঁটে চলেছি...

0 comments: