লেখা-লেখি

ফেসবুকীয় কবিতার বাজার

১০:০৭:০০ PM 1 Comments





© সুনীতি দেবনাথ


ফেসবুকীয় সাহিত্যে এখন কবিতার রমরমা। সাহিত্যের অন্যান্য শাখার চর্চা বিরল। কারণ এতে বেশ পরিশ্রম দরকার। হয়তো বা অনেকের ধারণা কবিতা লেখাই সহজ, এতে বিস্তৃত পরিসরে যেতে হয় না বলে টাইপ করাও পরিশ্রমের নয়। মোটামুটি চার পাঁচ লাইনে একটা কিছু দাঁড় করাতে পারলেই কিস্তি মাত্! নামও হলো কামও। আর যদি পেঁচিয়ে কবিতাটিকে কিছুটা জটিল করে তোলা যায় তাহলে  তো আর কথাই নেই! অসাধারণ, অপূর্ব, অনন্য, অনবদ্য, দারুণ ইত্যাদি এক শাব্দিক কমেন্টে কমেন্টের ঝুড়ি পূর্ণ হয়ে উপচে পড়বে। আরো আছে সংক্ষিপ্ততম কমেন্ট বাঃ, বাহ্, বেশ ইত্যাদি। কমেন্টের বন্যায় ভেসে গিয়ে কৃতার্থ কবি নতুন উদ্যমে নিজের ওয়াল ভরিয়ে বিশ্বভ্রমণে বের হন। হরেক রকমের সাহিত্য চর্চার গ্রুপ ওদিকে কবি শিকারের জন্য ফাঁদ পেতে বসে আছেন খাতা খুলে। চটপট আট দশটা গ্রুপে কপি - পেস্ট একদমে করে নিয়ে এবার কিছুক্ষণের জন্য বিশ্রাম। তারপর কমেন্টের জবাব দেওয়া। কমেন্ট গুলি হতাশাজনকভাবে কবিতা বিষয়ক নয়, ব্যক্তিগত বার্তালাপ! এই পর্যায়ে উল্লসিত হবার কিছু নেই।
   কবিতা লেখার সময় বিষয় নির্বাচনে কবির স্বাধীনতা কিংবা স্টাইল বা আঙ্গিকের বিষয়েও বলার কিছু থাকে না সেও কবির স্বকীয় নির্মাণ। কিন্তু ভাষার বিশুদ্ধতা, বানানোর বিশুদ্ধতা সম্পর্কে বলার থাকে বটে। একজন কবি কবিতা লিখবেন স্ব ইচ্ছায় স্বাধীনভাবে। কিন্তু তাঁর লেখার প্রাথমিক শর্ত হবে ভাষার বিশুদ্ধ ব্যবহার এবং আলঙ্কারিক সমৃদ্ধ ভাষা প্রয়োগ সাহিত্য তথা কবিতার ক্ষেত্রে অবশ্য প্রয়োজন। স্কুল ছাত্রও বানান ভুল করলে মার্জনা পায় না, সেক্ষেত্রে একজন কবি কিভাবে দিনের পর দিন ভুল বানানে কবিতা লিখে যাবেন এবং আমরা তা পড়ে যাবো? অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে বলছি ফেসবুকের তথাকথিত অনেক নামীদামি কবির বানান ভুল যেমন চক্ষুপীড়ার কারণ হয়, তেমনি বিস্মিত হতে হয় বানান ভুল শুদ্ধ করে দেবার জন্য ইনবক্সে কবিতা যখন পাঠানো হয়। এটা একদিনের ব্যাপার বা একজনের ব্যাপার নয়। আন্তরিকতা ও ভালোবাসার দাবি নিয়ে বহুদিন বহুজন এই কাণ্ড করে যাচ্ছেন। এঁরা কবিতার জন্য মিনিমাম পরিশ্রম করতে নারাজ। মহান কবিতা, কালজয়ী কবিতা লেখার জন্য এঁরা মানসিক ও ভাবনাগত সমৃদ্ধি থাকা সত্ত্বেও ভাষাগত দুর্বলতাকে কেন জয় করতে চাইবেন না? ভাষা যে ভাবনা ও ভাবের একমাত্র বাহন এ কথা জেনেও কেন তাঁরা ভাষার প্রতি যত্নশীল হবেন না সেটাই প্রশ্ন। আর এই অযত্নেই জন্ম নিচ্ছে প্রতিদিন কবিতা নামধেয় অনেক অনেক অকবিতা।
    নারী মুক্তি,  নারীর ক্ষমতায়ন, নারীকে বেআব্রু করে বিজ্ঞাপন ও বাণিজ্যের বিরুদ্ধে , নারীর সম্ভ্রম শালীনতার প্রতি অসৌজন্যমূলক লেখালেখি নিয়ে বহু কিছু বলা হচ্ছে দীর্ঘকাল ধরে। নারীর নগ্নতা নিয়ে বাণিজ্যের  তুমুল প্রতিবাদ হয়েছে। পথে মিছিলে হেঁটেছেন কত নারী! কিন্তু একুশ শতকের কাব্য সাহিত্যে অন্য একটা ট্রেণ্ড লক্ষ্য করা যাচ্ছে, নামীদামি কিছু মহিলা কবি নারী দেহকে এতোটাই উলঙ্গ করে তোলে ধরছেন যা পুরুষ কবিরা করেননি। আর এভাবেই এইসব মহিলা কবি লাইম লাইটে আসতে চাইছেন। বলাবাহুল্য ফেসবুকের মহিলা কবিদের মধ্যে একটা অংশ এই ধারার স্রোতে গা ভাসিয়ে দিচ্ছেন। মহিলা কবিদের এরকম প্রয়াস সহজে প্রচার পাবার কৌশল মাত্র। বলাটা বোধহয় বেঠিক হবে না সহজে খ্যাতি পাবার এই প্রক্রিয়া আত্মঘাতী। বলা যায় অনেকটা তুবড়ি বাজির জ্বলে ওঠার মত। মনে রাখা প্রয়োজন তুবড়ি বাজি সহজে যেমন জ্বলে ওঠে, নিভেও যায় সহজে। সর্বনাশা এই ট্রেণ্ডের অনুকরণ অনুসরণ সর্বকালীন খ্যাতি প্রাপ্তির পরিপন্থি। শাশ্বত সৃষ্টি এতে ব্যাহত হয়। সমাজ ও জীবনে অনেক কিছুই আছে যা কাব্যের বিষয় হতে পারে, সেসবকে বাদ দিয়ে নারীদের শালীনতাকে আহত করে নারীকে উলঙ্গ নাই বা করা হলো। এটা যদি অত্যাধুনিক হবার উপায় হয় আমরা তার বিরুদ্ধে যাবো।
     ' ভাবের ঘরে চুরি '— খুব সংক্ষেপে কিছু বলা হচ্ছে এ বিষয়ে। কবি হবার আর কবিতা লেখার একটা মোহ আছে বুঝিবা। আর এই মোহে মোহিত হয়ে অনেকটা লজ্জাশরম ত্যাগ করে কিছু সংখ্যক কবি (?) ভাবের ঘরে চুরি করেন। এঁরা বেপরোয়া হয়ে অন্যের কবিতার ভাব, পংক্তির টুকরো, শব্দ প্রয়োগের কৌশল চুরি করে কবিতা লেখেন। অন্যের অনুকরণ বা অনুসরণ করে যাঁরা কবিতা লেখেন তাঁদের কি কবি বলা যাবে? তাঁদের কবিতা কি মৌলিক কবিতা হবে? কবিতার ভাব আর ভাষার চুরি যে গর্হিত অপরাধ। দু 'চারদিন এভাবে চালিয়ে গেলেও একদিন না একদিন ধরা পড়ে যেতে হবেই — ' ....সেদিন ভয়ঙ্কর '। ফেসবুকে এমন অনেক কবির সাক্ষাৎ মেলে। এঁরা ভুলে যান ' সকলেই কবি নন কেউ কেউ কবি '।

কাজরী,
১৯ জুলাই, ২০১৬

SUNITI Debnath

আমি সুনীতি দেবনাথ, অবসরপ্রাপ্ত সরকারি শিক্ষিকা। কবিতা, প্রবন্ধ ও ছোটগল্প লিখি। কবিতা আমার প্রিয়ভূমি, শৈশব থেকেই হেঁটে চলেছি...

1 টি মন্তব্য: