বাংলাদেশের অমর একুশে গ্রন্থমেলা

ভাষার নাম বাংলা, দেশের নাম বাংলাদেশ। দেশ স্বাধীন হবার পরপর বিরাট একটি ঘটনা ঘটে গিয়েছিল। সে ঘটনা বিশাল ব্যাপ্তি পেয়ে বাংলাদেশী বাঙালিদের কাছে এক মহত্তম প্রাপ্তি হয়ে উঠেছে। আর সে প্রাপ্তির নাম ' অমর একুশে গ্রন্থমেলা'। বাংলায় এ মেলার প্রিয় পরিচিত নাম 'একুশে বইমেলা'। এখন ওদেশে এর চেয়ে বড় এবং গরিমার কোন মেলা নেই মনে হয়। এও মনে হয় সারাটা বছর ধরে এ মেলার প্রস্তুতি পর্ব ভেতর ভেতর চলতে থাকে। বললে অত্যুক্তি হবে না মনে হয়। একুশে বইমেলাকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের সাহিত্যচর্চা বর্তমানে অনেকাংশেই পরিচালিত হচ্ছে। বই লেখা, বই প্রকাশ, কেনাকাটা ও পড়া এবং তার সাথে সংস্কৃতিচর্চা মিলেমিশে একাকার। ভালো লাগে বাঙালির এই উদ্যম ও উদ্যোগ।
১৯৫২ সালে একুশে ফেব্রুয়ারি বাংলাভাষার জন্য আন্দোলনে যে আত্মোৎসর্গ হয়েছিল, তারই স্মৃতিকে শ্রদ্ধা জানানোর জন্য নামকরণ অমর একুশে গ্রন্থমেলা।
এই মেলার ইতিহাস স্বাধীন বাংলার ইতিহাসের মতোই মহান। জানা গেছে ১৯৭২ সালের ৮ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণে বটতলায় চিত্তরঞ্জন সাহা এক টুকরো চটের উপর কলকাতা থেকে আনা ৩২টি বই সাজিয়ে বইমেলার সূচনা করেন।চিত্তরঞ্জন সাহা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন স্বাধীন বাংলা সাহিত্য পরিষদ, যার বর্তমান নাম মুক্তধারা। এখান থেকেই প্রকাশিত এই বত্রিশটি বই বাংলাদেশী শরণার্থী লেখকগণ লিখেছিলেন। বইগুলি স্বাধীন বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্পের প্রথম অবদান। তিনি একাই ১৯৭২সাল থেকে এই বইমেলা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। অবশেষে ১৯৭৬ সাল থেকে অন্যান্যরা অণুপ্রাণিত হয়ে যোগদান করেন।
১৯৭৮ সালে তখনকার বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক আশরাফ সিদ্দিকী বইমেলাকে সরাসরি বাংলা একাডেমীর সঙ্গে মিলিয়ে নিলেন। পরের বছর চিত্তরঞ্জন সাহা প্রতিষ্ঠিত 'বাংলাদেশ পুস্তক বিক্রেতা ও প্রকাশক সমিতি' নামক সংস্থাটিও মেলার সাথে যুক্ত হয়। বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কাজী মওলা মনজুরে ১৯৮৩ সালে বাংলা একাডেমিতে প্রথম "অমর একুশে গ্রন্থমেলা"র আয়োজন করেন।কিন্তু এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে শিক্ষা ভবনের সামনে ছাত্রদের বিক্ষোভ মিছিলে ট্রাক তুলে দিলে দুজন ছাত্র নিহত হয়। মর্মান্তিক বেদনাবহ এই ঘটনার জেরে সে বছর আর বইমেলা হলো না। ১৯৮৪ সালে সাড়ম্বরে বর্তমানের অমর একুশে গ্রন্থমেলার সূচনা হয়। কালানুক্রমে এই বইমেলা বাংলার প্রাণের মেলাতে পরিণত হয়েছে। বাংলা একাডেমী চত্বরে স্থানাভাব হওয়ায় ২০১৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে বইমেলা সুহরাওয়ার্দ্দী উদ্যানে সম্প্রসারিত হয়েছে। এ বছর ২৯৯টি অংশগ্রহণকারী প্রকাশকের মধ্যে ২৩২জনকে সুহরাওয়ার্দ্দী উদ্যানে স্টল বরাদ্দ করা হয়। ২০০২ খ্রিস্টাব্দে মেলায় ২৪০জন এবং ২০১২ খ্রিস্টাব্দে সর্বোচ্চ ৪২৫ জন প্রকাশক অংশগ্রহণ করেছিলেন।
বেশ কিছুকাল পয়লা ফেব্রুয়ারি শুরু হয়ে একুশে ফেব্রুয়ারি অব্দি বইমেলা চলতো। বর্তমানে ক্রেতা - বিক্রেতা, প্রকাশক, দর্শক সর্বশ্রেণীর মানুষের চাহিদা ও আবেদনে প্রতি বছর সারাটা ফেব্রুয়ারি মাস জুড়ে এই বইমেলা চলে বাংলা একাডেমীর প্রাঙ্গণে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় মেলার নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনার সব দায়িত্ব পালন করেন। স্টলগুলিকে প্রকাশক এলাকা, প্রকাশক-বিক্রেতা এলাকা, শিশু কর্ণার, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, লিটল ম্যাগাজিন ইত্যাদি এলাকায় বিভাজন করে স্থান দেয়া হয়। এছাড়া মেলা চত্বরকে ভাষা শহীদ সালাম,রফিক, জব্বার , বরকত, শফিউর,ররীন্দ্রনাথ ঠাকুর,কাজী নজরুল ইসলাম,ড.মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, ড. আব্দুল করিম সাহিত্য বিশারদ প্রমুখ উজ্জ্বল ব্যক্তিত্বের নামে বিভাগ করা হয়।
বইমেলা প্রাঙ্গনকে ভাষা-শহীদ,বরেণ্য লেখক,সাহিত্যিক,কবি ও বুদ্ধিজীবীদের নামে নয়টি চত্বরে বিন্যাস করা হয়েছে। যেমন-ভাষা শহীদ চত্বর,রবীন্দ্র চত্বর,ড.মুহম্মদ শহীদুল্লাহ চত্বর,নজরুল চত্বর,সাহিত্য বিশারদ চত্বর, সুফিয়া কামাল চত্বর, ধীরেন্দ্রনাথ চত্বর, সোমেন চন্দ চত্বর ও রোকেয়া চত্বর প্রভৃতি। এছাড়া শিশু কর্ণারে রয়েছে শিশু বিষয়ক প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান। প্রতিবারের মতো এবারও নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচনের ব্যবস্থা রয়েছে নজরুল মঞ্চে।
এই মেলায় দেশের খ্যাতনামা সব প্রকাশনী, বই বিক্রেতা ছাড়াও বহির্দেশীয় ভারত, রাশিয়া, জাপান এসব দেশ থেকেও নানা প্রকাশনা সংস্থা তাঁদের বই ও প্রকাশনা নিয়ে অংশগ্রহণ করেন। এই মেলায় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারেরও বহু রাষ্ট্রায়ত্ব প্রতিষ্ঠান, যেমন: বাংলাদেশ পর্যটন দপ্তর, বাংলদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর তাঁদের স্টল নিয়ে মেলায় যোগ দেন । এছাড়া বিভিন্ন বেসরকারি সেবামূলক প্রতিষ্ঠানও অংশ নেয়। ইদানিং বিভিন্ন ডিজিটাল প্রকাশনা যেমন সিডি, ডিভিডি ইত্যাদিও স্থান করে নিয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন মোবাইল ফোন সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানও তাদের সেবার বিবরণসহ উপস্থিত হয়। বেশ জনপ্রিয়তার সাথে স্থান করে নিয়েছে নানাপ্রকার লিটল ম্যাগাজিন। মেলার মিডিয়া সেন্টারে থাকে ইন্টারনেট ও ফ্যাক্স ব্যবহারের সুবিধা। এছাড়া থাকে লেখক কর্ণার এবং তথ্যকেন্দ্র। মেলা প্রাঙ্গণ পলিথিন ও ধূমপানমুক্ত। মেলায় বইয়ের বিক্রয়ে ২০-২৫ শতাংশ পর্যন্ত ছাড় থাকে। এছাড়া মেলায় শিক্ষাসহায়ক পরিবেশ ও তথ্যের নিরাপত্তার জন্য বিশেষ টাস্কফোর্স রাখা হয়, যাঁরা বইয়ের কপিরাইট বা মেধাসত্ত্ব আইন লঙ্ঘন করা হচ্ছে কি-না শনাক্ত করেন ও যথাযোগ্য ব্যবস্থা নেন। মেলায় প্রবেশের জন্য ছুটির দিন ও ছুটির দিন বাদে অন্যান্য দিন আলাদা প্রবেশ সময় থাকে। মেলায় প্রবেশের জন্য কোনো প্রবেশ ফি ধার্য করা হয় না।
মেলা চলাকালীন প্রতিদিনই মেলাতে বিভিন্ন আলোচনা সভা,কবিতা পাঠের আসর বসে; প্রতি সন্ধ্যায় থাকে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এছাড়া মেলাতে লেখককুঞ্জ রয়েছে, যেখানে লেখকেরা উপস্থিত থাকেন এবং তাঁদের বইয়ের ব্যাপারে পাঠক ও দর্শকদের সাথে মত বিনিময় করেন। এছাড়া মেলার তথ্যকেন্দ্র থেকে প্রতিনিয়ত নতুন মোড়ক উন্মোচিত বইগুলোর নাম, সেগুলির লেখক ও প্রকাশকের নাম ঘোষণা করা হয় ও দৈনিক প্রকাশিত বইয়ের সামগ্রিক তালিকা লিপিবদ্ধ করা হয়। এছাড়া বিভিন্ন রেডিও ও টিভি চ্যানেল মেলার মিডিয়া স্পনসর হয়ে মেলার তাৎক্ষণিক খবরাখবর দর্শক-শ্রোতাদেরকে অবহিত করে। এছাড়াও মেলার প্রবেশদ্বারের পাশেই স্টল স্থাপন করে বিভিন্ন রক্ত সংগ্রাহক প্রতিষ্ঠান সেবামূলক কাজ করে।
চিত্তরঞ্জন সাহার নামে একটি পদক প্রবর্তন করা হয় ২০১০ সালে । আগের বছরে প্রকাশিত বইয়ের গুণমান বিচারে সেরা বইয়ের জন্য প্রকাশককে এই পুরস্কার দেয়া হয়।পুরস্কারটির নাম 'চিত্তরঞ্জন সাহা স্মৃতি পুরস্কার '। স্টলের সজ্জা -শৃঙ্খলার জন্য দেওয়া হয়, 'সরদার জয়েনউদদিন স্মৃতি পুরস্কার '। গ্রন্থ ক্রয়ের জন্য সেরা ক্রেতাকে দেয়া হয় 'পলান সরকার পুরস্কার'। তাছাড়া বইমেলার প্রবর্তক চিত্তরঞ্জন সাহার স্মৃতি রক্ষার্থে বাংলা একাডেমী ২০১০ সালে যে পুরস্কার প্রবর্তন করে তার ধারাবাহিকতায় এবারের বইমেলায় অংশগ্রহনকারী প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্য থেকে গুণগতমান বিচারে সেরা গ্রন্থের জন্য প্রকাশককে ‘চিত্তরঞ্জন সাহা স্মৃতি পুরস্কার’ এবং বইমেলায় সর্বাধিক সংখ্যক মানসম্মত বই প্রকাশের জন্য শ্রেষ্ঠ তিনটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানকে ‘মুনীর চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার’ প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
মেলায় কোন কোন প্রকাশনা সংস্থার স্টল স্থান পাবে, কেমন স্টল করতে পারবে, তার জন্য বাংলা একাডেমীর তত্ত্বাবধানে আলাদা কমিটি গঠিত হয়। ২০১০ খ্রিস্টাব্দ থেকে এই নির্বাচন প্রক্রিয়ায় কিছুটা কড়াকড়ি আরোপ করা হয়। প্রকাশিত বইয়ের কপি জাতীয় আর্কাইভ ও জাতীয় গণগ্রন্থাগারে জমা দেওয়া হয়েছে কিনা, কর-নির্দেশক-নম্বর (TIN) ঠিক আছে কিনা যাচাই করার পাশাপাশি প্রকাশিত নতুন বইয়ের কপি বাংলা একাডেমীর তথ্যকেন্দ্রে জমা দেওয়ার বিষয়টিও বাধ্যতামূলক করা হয়।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসকে সামনে রেখে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় প্রতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাস জুড়ে চলে অমর একুশে বইমেলা। প্রতি বছরই মেলার পরিসর এবং বিক্রি বাড়ছে। মূলত লেখক-পাঠক এবং প্রকাশকের মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরি করে এই মেলা।
বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে বাংলা একাডেমি চত্বরেই এতদিন এই মেলার আয়োজন হত। তবে এবার মেলার পরিসর বাড়িয়ে নেয়া হয়েছে একাডেমি ভবনের উল্টো দিকে সুহরাওয়ার্দী উদ্যানে। মেলার আমেজ টের পাওয়া যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র বা টিএসসির মোড় থেকেই। রাস্তার দুপাশের ফুটপাথজুড়েই নানারকম পণ্যের পসরা। বাচ্চাদের খেলনা থেকে শুরু করে ঘরের সৌন্দর্য বাড়ায়, এমন জিনিসও আছে। ছোট ছোট স্টলে বিক্রি হচ্ছে কবিতার ক্যাসেটও।
শুরু হওয়ার পর থেকে অমর একুশে বইমেলা আপামর বাঙালীর কাছে প্রাণজোয়ার সৃষ্টিকারী এক মেলায় পরিনত হয়েছে। বাঙালী লেখক, প্রকাশক এবং পাঠকদের কাছে বইমেলা এক মিলনমেলা। বইমেলায় জড়ো হতে থাকে দূর-দূরান্তের চেনা মুখগুলি। ভাষা আন্দোলনের মাস ফেব্রুয়ারী পার হলে ভাঙে এ মিলন মেলা। বইমেলা মানুষের অন্তরে যে অমিয় বন্ধন তৈরি করে তা ভাঙে না কখনই। দেশের প্রতি ভালোবাসা সৃষ্টি করে। অনুপ্রেরনা জোগায়। বাঙালী অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’ আবার কবে ফিরে আসবে আনন্দ সাগরের জোয়ার নিয়ে!
অমর একুশে বইমেলা বাঙালীর প্রাণের মেলা। বাঙালির সাহিত্য ও বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশ. মনন ও মানসিকতার বিকাশ এ মেলাকে কেন্দ্র করে স্বাধীন বাংলাদেশে বিকসিত হচ্ছে । ভাষা, সংস্কৃতিবোধ ও ঐতিহ্য হলো অমর একুশে বই মেলার ভিত্তি। লেখক, পাঠক এবং প্রকাশকদের কাছে অমর একুশে বইমেলা এক মহান উৎসব। সবারই মিলন মেলা বাংলা একাডেমীর বই মেলা প্রকৃত অর্থে নিখিল বাঙালির মিলনমেলা। অমর একুশে বইমেলার প্রতীক্ষায় বাঙালী পাঠক, লেখক প্রকাশক কী উদ্গ্রীব হয়ে না থাকেন।
ভাষা আন্দোলন, বাংলা একাডেমী আর একুশের বইমেলা একই সূত্রে গাঁথা। একুশের ভাষা আন্দোলনের অন্যতম প্রধান সম্পদ বাংলা একাডেমী। একুশে বইমেলা বিকশিত হয়েছে বাংলা একাডেমীকে কেন্দ্র করে। নবগঠিত বাংলাদেশে সাংস্কৃতিক সাহিত্যিক জাগরণের পথপ্রদর্শক একুশের বইমেলা।
১৯৭৯ সালে বাংলা একাডেমীর বইমেলার সাথে যুক্ত হয় বাংলাদেশ পুস্তক বিক্রেতা ও প্রকাশক সমিতি। সে বছরই বাংলা একাডেমীর সাথে বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতি যৌথভাবে বইমেলার আয়োজন করে। ১৯৮৪ সালে বাংলা একাডেমী কর্তৃক গ্রন্থমেলার জন্য বিধিবদ্ধ নীতিমালা প্রনয়ণ করা হয়। একই সাথে এই বইমেলার নামকরণ করা হয় ‘অমর একুশে বইমেলা’। তখন থেকে গৌরবের সাথে প্রতিবছর অমর একুশে বইমেলা আয়োজিত হয়ে আসছে। গুটি কয়েক বই নিয়ে যে মেলা শুরু হয়েছিল তা আজ বাঙালীর প্রাণের মেলা। অমর একুশে বইমেলা এখন বাঙালির ঐতিহ্যের এক প্রদীপ্ত মশাল।
আশির দশকে মেলার পরিধি, চিত্র এবং আয়োজনের ব্যাপকতা বৃদ্ধি পেতে থাকে দ্রুত,বাড়তে থাকে অংশগ্রহনকারী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা।১৯৮০ সালে বইমেলায় অংশগ্রহনকারী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ছিল ৩০। ১৯৮৫ সালে এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৮২ তে এবং ১৯৯১ সালে এ সংখ্যাটি ১৯০ তে উন্নীত হয়। বইপ্রেমীদের জোয়ারে বাঁধ ভেঙে যায় সকল প্রতিবন্ধকতার ১৯৯২ সালে অমর একুশে বইমেলায় অংশগ্রহন করে মোট ২৭০ টি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান। অংশগ্রহনকারী প্রতিষ্ঠান ও বইপ্রেমীদের সংখ্যা বৃদ্ধির প্রেক্ষিতে বইমেলার পরিধি সম্প্রসারণ করা হয়। বাংলা একাডেমীর দেয়াল ভেঙে বৃদ্ধি করা হয় এ মেলার স্থান। জনগণের প্রবেশদ্বার হয় প্রসারিত। সুহরাওয়ার্দী উদ্যান সংলগ্ন দু পাশের রাস্তা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মিলন চত্বর থেকে দোয়েল চত্বর পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করে অমর একুশে বইমেলার পরিধি। স্বাধীনতার পর বাংলা একাডেমী প্রাঙ্গনে বইমেলার আয়োজন শুরু হলেও তা পূর্ণতা পায় মূলত নব্বইয়ের দশকে। ১৯৯৩ সালে অমর একুশে বইমেলায় অংশগ্রহনকারী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ছিল ৩৩৮। ১৯৯৪ সালে ছিল ৬৫৩,১৯৯৫সালে ছিল ৪৬৭, ১৯৯৬ সালে ছিল ৪৮৬, ১৯৯৭ সালে ছিল ৫২০ টি। ২০০৬ সালে ৩১৭,২০০৮ সালে ২৩৬,২০০৯ সালে ৩২৬। ২০১০ সালে অংশগ্রহনকারী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ছিল ৫০৫টি। ২০১১ সালে ’অমর একুশে বই মেলায়’ অংশগ্রহন করছে ৩৭৬টি প্রতিষ্ঠানের ৫৫৬টি স্টল। এর মধ্যে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ছাড়াও স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাসহ সরকারী-বেসরকারী, সামাজিক-সাংস্কৃতিক, সেবমূলক ও গণমাধ্যম রয়েছে। এছাড়া ৩০টি লিটল ম্যাগাজিনের জন্য রয়েছে লিটল ম্যাগ কর্ণার। ক্ষুদ্র প্রকাশনা সংস্থা এবং ব্যক্তিগত উদ্যোগে যাঁরা বই প্রকাশ করছেন তাঁদের বই বিক্রির জন্য জাতীয় গ্রন্থ কেন্দ্রের সহায়তার ব্যবস্থা রয়েছে। গ্রন্থমেলায় বাংলা একাডেমী প্রকাশিত বই একাডেমী প্রচলিত কমিশনে এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের বই ২৫ ভাগ কমিশনে বিক্রির ব্যবস্থা করা হয়েছে। এ বছর অমর একুশে বইমেলা প্রাঙ্গনকে ভাষা-শহীদ,বরেণ্য লেখক,সাহিত্যিক,কবি ও বুদ্ধিজীবীদের নামে নয়টি চত্বরে বিন্যাস করা হয়েছে। যেমন-ভাষা শহীদ চত্বর,রবীন্দ্র চত্বর,ড.মুহম্মদ শহীদুল্লাহ চত্বর,নজরুল চত্বর,সাহিত্য বিশারদ চত্বর, সুফিয়া কামাল চত্বর, ধীরেন্দ্রনাথ চত্বর, সোমেন চন্দ চত্বর ও রোকেয়া চত্বর প্রভৃতি। এছাড়া শিশুকর্ণারে রয়েছে শিশু বিষয়ক প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান। অমর একুশে বইমেলা ২০১১ প্রচার কার্যক্রমের জন্য তথ্যকেন্দ্র ছিল বর্ধমান ভবনের পশ্চিম বেদিতে। মিডিয়া কেন্দ্রের ব্যবস্থা করা হয় তথ্য কেন্দ্রের উত্তর পাশে। তাৎক্ষনিকভাবে মেলা সংক্রান্ত তথ্য সরবরাহের জন্য ফ্যাক্সসহ ই-মেইলের ব্যবস্থা করা হয় মিডিয়া সেন্টারে। মেলায় প্রবেশের জন্য পুষ্টি ভবনের সামনে এবং আণবিক শক্তি কমিশনের সামনের প্রবেশ পথ ছিল। পহেলা ফেব্রুয়ারী থেকে ২৭ পর্যন্ত প্রতিদিন বিকেল ৪টায় সেমিনারের ব্যবস্থা ছিল গ্রন্থমেলার মুক্তমঞ্চে। রবীন্দ্রনাথের সার্ধশত জন্মবার্ষিকী পালনের অংশ হিসেবে এ বছর সেমিনারে রবীন্দ্রনাথের জীবন, সাহিত্য, নাটক প্রভৃতি নিয়ে আলোচনার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এছাড়া প্রতিসন্ধ্যায় ছিল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা।বলা যায় সে বছরের মত এমন জমজমাট আয়োজন কমই দেখা গেছে।
বর্তমান বছরের বইমেলা আসছে।সর্বত্রই পুরোদমে তোড়জোড় চলছে।এই মুহূর্তে মনে পড়ছে, বাংলাদেশের প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের মতে এই মেলার বার্তা : “বইমেলা এখন জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়েছে। এখানে এখন মানুষ বই কিনতে আসে, বই নাড়া-চাড়া করতে আসে। কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা হচ্ছে বইমেলা এখন মানুষের মিলন মেলায় পরিণত হয়েছে”।
© সুনীতি দেবনাথ
কাজরী,
৯ জানুয়ারি, ২০১৭
[ Photo collected from internet]
0 comments: