এক অনন্যা — পণ্ডিতা রমাবাঈ
© সুনীতি দেবনাথ
বর্ণশাসিত সমাজে নয় বছরের বালিকা কন্যাকে বিয়ে দেবার প্রথা চালু ছিলো, এতে পিতার অশেষ পুণ্য হয় মনে করা হতো। বঙ্গদেশে এই প্রথাকে বলা হতো গৌরী দান। গৌরীদানে পিতার অশেষ পুণ্য, অপারগ হলে হাতেনাতে ফলপ্রাপ্তি সমাজচ্যুতি। বালিকার সম্মতি অসম্মতির প্রশ্ন নেই, বরং অবধারিতভাবে সৃষ্টি হতো বালবিধবার আরেকটি শ্রেণী। জীবনের সব হিসেব নিকেশ, দেনা পাওনার বহির্ভূত একটা শ্রেণী। যদিও বিদ্যাসাগরের প্রয়াসে ঔপনিবেশিক সরকার ১৮৫৬ সালে বালবিধবাদের পুনর্বিবাহের আইন চালু করেন, তার বাস্তবায়ন ছিলো সুদূর পরাহত। প্রচলিত ধারণা বালবিধবারা জন্ম জন্মান্তরের পাপীয়সী, এদের দায়-দায়িত্ব কারও নেই। তাই এরা অকথিতভাবে নির্যাতিত, অবহেলিত, সামান্য দোষে গৃহ-বহিষ্কৃত অসহায় কতগুলি প্রাণী মাত্র ছিলো। বরং নিম্নবর্ণে এ সমস্যা ছিলো না। বহুদিন আগেই মনুর অনুশাসন এদের নিচে ফেলেছে। প্রচলিত কোন আইনকানুন নারীশিক্ষার পক্ষে তো ছিলো না, অঞ্চল বিশেষে নারীশিক্ষা ছিলো দণ্ডনীয় অপরাধ। একটু বিস্তারিতভাবে রমা বাঈয়ের সমকালের কথা বলতে হলো। সমকালের প্রেক্ষিতে এই নারী আক্ষরিক অর্থে ছিলেন অনন্যা।
রমা বাঈয়ের সম্পূর্ণ জীবন যেন এক বিস্ময়কর কাহিনী। ভারতীয় অন্যান্য নারীর মত বাঁধা পথে তাঁর জীবন চলেনি, বেহিসেবী ঠিকানাহীন ঝড়োপথে এই নারী জীবনের প্রতিটি বাঁকেই ভিন্নতর মাত্রা সংযোজন করে চলেছিলেন। তাঁর যে ঝড়ো জীবন তা রূপকথা বা কল্পকথার কাহিনীকেও হার মানায়। তাঁর সারাটা জীবন কাহিনী যেন কোন অন্যলোকের অন্য আরেক বিধাতা অভূতপূর্ব এক আলেখ্যের মত নির্মাণ করেছেন। অবিরাম অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রাম আর সামগ্রিকভাবে ভারতীয় নারী সমাজের বন্ধন মুক্তির লড়াই আর ক্ষমতায়ন— এই যেন ছিলো তাঁর জীবনের লক্ষ্য। এমনটা দেখা যায় না। পদে পদে প্রিয় স্বজনদের মৃত্যু একে একে নিয়েছে কেড়ে, দুর্ভিক্ষপীড়িত, ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ, ক্ষতবিক্ষত এক জীবন, তবু অটল পদবিক্ষেপে অনন্যা হয়ে চলেছেন তিনি। সত্যিই এমন জীবন দুর্নিরীক্ষ্য। অথচ সেই নারী যতখানি পরিচিতি পাবার যোগ্যতা নিয়ে আশ্চর্য এক জীবন গড়ে তুলেছিলেন তা তিনি পাননি। সাম্প্রতিককালে যতই পর্দা সরে যাচ্ছে ততই কেবল স্বদেশে নয়, সারা পৃথিবীতেই একটা নাড়া পড়ে গেছে বললে অত্যুক্তি হবে না। পাশ্চাত্য জগতে নারী মুক্তি আর নারীর ক্ষমতায়নের প্রশ্নে ফেমিনিজম বা নারীবাদী আন্দোলন বহুদিন আগে বাঁধভাঙ্গা ঢেউয়ের মত আছড়ে পড়েছিল, দেরিতে হলেও বিশ শতকে আমাদের দেশে প্রায়োগিকভাবে না হলেও তাত্ত্বিক, পুঁথিগত, আলাপ - আলোচনা -বক্তৃতাদির মাধ্যমে আন্দোলনের যে প্রেক্ষিত গড়ে তুলেছে, সেটা রমাবাঈ উনিশ শতকের সেই দিনগুলিতে তাত্ত্বিকভাবে না হলেও ব্যক্তিগত জীবনে আন্দোলন আর ক্রিয়াকলাপে অনেকটাই বাস্তবায়িত করে গেছেন। অথচ এমন একজন নারীর পরিচিতি স্বদেশে যতটা হবার কথা তা হয়নি । যুগধর্ম থেকে বহুদূর এগিয়ে তিনি ভাবনা- চিন্তা করেছেন, জীবনের বড় বড় সিদ্ধান্ত নিতে বিন্দুমাত্র টলেননি, বিশাল মাপের কাজকর্মও করেছেন। একজন স্বাধীনচেতা, মননশীল, পূর্ণাঙ্গ ক্ষমতাশালিনী নারীর মত জীবন পরিক্রমা করেছেন। অথচ যে দেশে, এমনকি যে অঞ্চলে তিনি জন্মেছিলেন, সেখানে তাঁর পরিচিতি বা মূল্যায়ন সম্যকভাবে ঘটেনি। এর কারণ সনাতন হিন্দু ধর্ম ত্যাগ করে তিনি খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেছেন বলে অনুমিত হয়।
রমাবাঈ জন্মেছিলেন কর্ণাটকের দক্ষিণ ডিস্ট্রিক্টে মালা গঙ্গামূলে উচ্চবংশীয় ব্রাহ্মণ পরিবারে রমা ডোংগ্রে হয়ে। বেদ পুরাণে অপরিসীম জ্ঞানী, সংস্কৃত পণ্ডিত ও বুদ্ধিজীবী অনন্ত শাস্ত্রীর দ্বিতীয়া পত্নীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তাঁর বড় এক ভাই শ্রীনিবাস আর ছোট এক বোন ছিলেন। অনন্ত শাস্ত্রী বেদ পুরাণাদি ও নানা শাস্ত্র গ্রন্থ পাঠ করে সিদ্ধান্তে পৌঁছান নারীশিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। সেই অনুসারে তিনি প্রথমে পত্নী লক্ষ্মীবাঈকে সংস্কৃত পড়াতে লাগলেন। এ ব্যাপারে প্রচণ্ড দুঃসাহসী অনন্ত শাস্ত্রী পরে কন্যাকেও শিক্ষা দিতে লাগলেন। ফলতঃ প্রচলিত ট্রাডিশনের বাইরে চলাতে তাঁকে সমাজচ্যুত করা হয়। বাধ্য হয়ে তিনি সপরিবারে বনাঞ্চলে গিয়ে বাস করতে লাগলেন। পরবর্তী সময়ে তাঁদের স্থান থেকে স্থানান্তরে বসবাসের জন্য ঘুরে বেড়াতে হলো। জীবিকার উপায় হলো হিন্দু ধর্মশাস্ত্র, পুরাণাদি নানা জায়গায় মন্দিরে, মেলায়, জন সমাগমস্থানে পাঠ করে শোনানো। সারা ভারতের কত জায়গায় যে তাঁরা পায়ে হেঁটে ঘুরলেন তার ঠিকঠিকানা নেই। এমন কষ্টের জীবন যাপনকালেও অনন্ত শাস্ত্রী স্ত্রী কন্যাকে স্ত্রী শিক্ষা বিষয়ে আলোচনা করে শোনাতেন। রমাবাঈকে তিনি পড়তে ও লিখতে শেখালেন। শেখালেন প্রধান হিন্দু ধর্মশাস্ত্র বেদ পাঠ করার ও ব্যাখ্যা করার নিয়মনীতি। মাত্র বারো বছর বয়সে রমাবাঈ পুরাণ থেকে ১৮,০০০ কাব্য পাঠ কণ্ঠস্থ যেমন করলেন, তেমনি সেগুলি বুঝেও নিলেন। ক্রমে সংস্কৃত ভাষা ছাড়াও তিনি মারাঠী, কাণাড়ী, হিন্দুস্তানি এবং বাংলা ভাষাও শিখে নেন। পরবর্তীতে তিনি ইংরেজি, হিব্রু, টুলু ও গ্রীক ভাষা শিখে নেন ও পারঙ্গমতা অর্জন করেন। বহুভাষাবিদ এই নারী প্রতিটি ভাষার শিক্ষা^ এমন পর্যায়ে নেন যাতে করে সে ভাষার মৌলিক বৈশিষ্ট্য তাঁর আয়ত্বে আসে।
এভাবে স্থানান্তরে ঘুরে বেড়িয়ে জীবন যাপন করাতে অতিরিক্ত পরিশ্রমে ও খাদ্যাভাবে রমা বাঈয়ের মাবাবা খুব দুর্বল হন, তাঁদের স্বাস্থ্য ভেঙ্গে পড়ে। তাই ১৮৭৭ সালের দুর্ভিক্ষে তাঁরা পরলোকগত হলেন। অল্প ক' দিন পরে ছোট বোনটিও মারা যায়। রমাবাঈয়ের বয়স তখন ষোল বছর। সুসংস্থানহীন জীবনের কঠোর ভয়ঙ্কর রূপ এতো অল্প বয়সেই তিনি অনুভব করলেন। তবুও বাঁচার জন্য, জীবনের প্রয়োজনীয় সব পাবার জন্য বর্তমান পেশাই আঁকড়ে থাকলেন। ভিক্ষাবৃত্তি বা অন্য কোন কাজ করেননি। দুই ভাইবোন জীবিকার ব্যাপারে একমত হয়ে সারাদেশে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। রমাবাঈয়ের পাণ্ডিত্য বাড়তে লাগলো, সর্বত্র খ্যাতি ও সম্মান অর্জন করতে লাগলেন।ক'বছর পথচলা ও পাঠে কেটে গেলো।
রমাবাঈয়ের বয়স যখন বিশ বছর ততদিনে সুদূর বঙ্গদেশ পর্যন্ত তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে। বাংলার সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিতেরা তাঁকে কলকাতা যাবার আমন্ত্রণ জানালেন। রমাবাঈয়ের পাণ্ডিত্যে তাঁরা মুগ্ধ হলেন! এরপর কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিতেরাও তাঁর পাণ্ডিত্যে মুগ্ধ হলেন। রমাবাঈকে তাঁরা যাচাই করেছিলেন। দেখলেন তিনি কেবল বেদ পুরাণাদিতে ব্যুৎপত্তি সম্পন্না নন, সংস্কৃত ব্যাকরণেও তাঁর অগাধ পাণ্ডিত্য। ১৮৭৮ সালে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেনেট হলে তাঁকে সম্বর্ধনা দিয়ে ' পণ্ডিতা' উপাধি প্রদান করা হলো এবং বিভিন্ন সংস্কৃত গ্রন্থের ব্যাখ্যাতা হিসেবে দেশব্যাপী খ্যাতির জন্য দেওয়া হলো 'সরস্বতী ' উপাধি। রমাবাঈ হলেন " পণ্ডিতা রমাবাঈ সরস্বতী "। বাংলার বিখ্যাত জ্ঞানী ও সমাজ সংস্কারক কেশবচন্দ্র সেন মহাশয় হিন্দুদের আদি পবিত্র ধর্মগ্রন্থ তথা আদি সাহিত্য ' বেদ ' উপহার স্বরূপ তাঁর হাতে তুলে দিলেন এবং বেদপাঠ ও বিশ্লেষণের জন্য সস্নেহ উৎসাহ দিলেন।
রমাবাঈ জীবনের শুরুতে অজস্র দুঃখ কষ্টে জর্জরিত হয়েছেন, অগাধ পাণ্ডিত্যও অর্জন করেছেন। কিন্তু কলকাতায় যে সম্মান সমাদর পেলেন তা তাঁর কাছে পরম সম্মানের ছিলো। তাঁর সমকালে অভাবনীয় ঘটনা এসব। শুধু সম্মানিত উপাধি লাভ নয়, বাংলার নানা জ্ঞানকেন্দ্রে এরপর তাঁকে আমন্ত্রণ জানানো হতে লাগলো ভাষণ প্রদান ও সংস্কৃত শাস্ত্রাদির আলোচনা ও ব্যাখ্যার জন্য। সেই সময়কালে একজন ভারতীয় নারীর এমন প্রাপ্তি অভাবনীয় ! কিন্তু এতো জ্ঞানের বিশ্লেষণ, নিয়ত চর্চা তাঁকে যেন এক শূন্যতার দিকে ঠেলে দিচ্ছিলো, নিয়ত এক অশান্তি তাঁকে অনন্ত শূন্যের বেদনার দিকে নিয়ে যাচ্ছিলো। তেমনি ঈশ্বরকেও তিনি অনুভবে পেলেন না। এক প্রচণ্ড সংগ্রামের মধ্যে দুটি ভাইবোন জীবন কাটাচ্ছিলেন। এরই মাঝে তাঁর বড়ভাই গুরুতর অসুস্থ হয়ে একদিন প্রাণত্যাগ করলেন। সারা বিশ্বে রমাবাঈ তখন একা এক নারী।
এমন সময় তাঁর কয়েকজন বন্ধুবান্ধবই একমাত্র সান্ত্বনাস্থল ছিলেন। তেমনি একজন বন্ধু ছিলেন কলিকাতা হাইকোর্টের উকিল সমাজের একেবারে নিম্নস্তরের শূদ্রবর্ণের বিপিন বিহারী মেধ্বী। মেধ্বী মুক্তমনা রমাবাঈকে ভালবাসতেন এবং বিবাহ প্রস্তাব দিলেন। উচ্চবংশীয়া, সুশিক্ষিতা, উদারমনা নারী রমাবাঈ উদারমনস্ক ও আগ্রহী মেধ্বীর প্রস্তাব অগ্রাহ্য করতে পারেননি। সমকালীন সমাজ ও তাঁর বন্ধুবান্ধবী এই অসম বিবাহের প্রতিকূলে গিয়ে তাঁকে নানাভাবে এই বিবাহে সম্মত না হতে চাপ দিচ্ছিলেন। কিন্তু রমাবাঈ ভাবলেন স্বামী হিসেবে মেধ্বী একজন ভালো ব্যক্তি হবেন ও দায় দায়িত্ব পালন করবেন। ১৩ নভেম্বর, ১৮৮০ সালে তাঁদের বিবাহ হয়ে গেলো। বৈবাহিক জীবনে সুখী দম্পতির একটি কন্যা সন্তান জন্ম নিলো, ডাকা হতো মনো বলে, নাম মনোরমা। এই ঘটনা প্রমাণ করে রমাবাঈ জাতপাতের ঊর্ধ্বে প্রকৃত মানবিকতার জ্ঞান অর্জন করেছিলেন। তাঁর সমকালের এটি বিরল ঘটনা। প্রকৃত জ্ঞান তিনি লাভ করেন।
বিবাহের পর রমাবাঈ ভারতীয় নারীদের সামাজিক অবস্থান নিয়ে অনুসন্ধিৎসু হলেন। নতুন ভাবনা স্পষ্টমূর্তিতে প্রকাশ পেলো। ট্রাডিশনাল নিয়মকানুন, রীতিনীতি, আচার অনুষ্ঠান, নানা অন্ধবিশ্বাস পর্বতপ্রমাণ প্রতিবন্ধকতা নিয়ে ভারতীয় নারীর জীবনকে ঘিরে রেখেছিল। সেসব নিয়ে তিনি ভাবতে শুরু করলেন। বিশেষ করে বাল্যবিবাহ ও বালবৈধব্য নিয়ে তাঁরা স্বামী স্ত্রী দুজনেই ভাবতে লাগলেন। রমাবাঈ তাঁর পিতার মতই নারীশিক্ষাকে সমাধানসূত্র নির্ণয় করলেন। স্বামী স্ত্রী দুজনেই বালবিধবাদের জন্য একটা বিদ্যালয় স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিলেন। কিন্তু তা আর হলো না। বিবাহের দুবছর পূর্ণ হবার আগেই মেধ্বীর কলেরায় মৃত্যু হলো। পারিবারিক সম্পত্তি সংক্রান্ত গণ্ডগোল শুরু হলে কন্যাকে নিয়ে রমাবাঈ পুনা চলে গেলেন। যে বাংলা তাঁকে অঢেল সম্মান দিয়েছিল, সেই প্রিয়ভূমি থেকে আরেকটি মৃত্যুর পথে হেঁটে বিদায় নিতে হলো।
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ প্রয়োজন বিবাহের পরে স্বামী গৃহে Gospel of St Luke - এর একটা বাংলা সংস্করণ পেয়ে তিনি পড়ে নেন। এরপর তাঁর কৌতূহল মেটাতে তাঁর স্বামী একজন মিশনারীকে নিয়ে এলে তিনি বইটির বিশদ আলোচনা করেন। রমাবাঈ তা শুনে খ্রিস্টান ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে তা গ্রহণ করতে চাইলে তাঁর স্বামী আপত্তি জানান। রমাবাঈ ধর্ম ও ঈশ্বর সম্পর্কে বিবাহের আগে থেকে সংশয়ে পড়ে মানসিক অশান্তির শিকার হয়েছিলেন এবং নিম্ন বর্ণের একজনকে বিবাহ করায় সামাজিকভাবে সমালোচিত হচ্ছিলেন। তাই হয়তো মানসিক শান্তি পাবার জন্য খ্রিস্টধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হন।
পুনাতে এসে রমাবাঈ প্রথম বছরেই তিনটি তাৎপর্যপূর্ণ কাজ করেন। প্রথমতঃ উচ্চবর্ণের প্রগতিমনস্কা যেসব নারী বালিকাদের শিক্ষা দিচ্ছিলেন এবং বাল্যবিবাহের বিরোধিতা করছিলেন, তাঁদের নিয়ে ' আর্য মহিলা সমাজ ' প্রতিষ্ঠা করলেন। দ্বিতীয়তঃ তাঁর লিখিত প্রথম বই মারাঠী ভাষায় ' স্ত্রী ধর্ম নীতি ', যেটার ইংরেজি অনুবাদ ' Morals for Women ', প্রকাশ করলেন। তৃতীয়তঃ ১৮৮২ সালে ভাইসরয় লর্ড রিপন কর্তৃক শিক্ষাব্যবস্থা খতিয়ে দেখার জন্য গঠিত ' Hunter Commission on Education ' - এ তিনি তাঁর সাক্ষ্য- প্রমাণ বা Testimony দাখিল করেন। তিনি এতে বলেন যে, দেশের শিক্ষিত পুরুষদের শতকরা নিরানব্বই জনই স্ত্রী শিক্ষার বিরোধী। এতে এদেশে স্ত্রী শিক্ষার হালহকিকৎ এবং সমাজে নারীর প্রকৃত অবস্থান সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হতে পারা যায়। নারী যদি সামান্য দোষ করে তাহলে সেটাকে ম্যাগনিফাইয়িং গ্লাস দিয়ে দেখে সর্ষেদানাকে পর্বত দেখানো হয় এবং নারী চরিত্রকে হনন করা হয়। তিনি শিক্ষক প্রশিক্ষণ ও নারী শিক্ষার বিদ্যালয়ে পরিদর্শক নিয়োগের সুপারিশ করেন। যেহেতু এদেশে নারীদের চিকিৎসা একমাত্র মহিলা ডাক্তার করতে পারেন, তাই নারীদের মেডিকেল কলেজগুলিতে ভর্তির সুযোগ দেবার কথাও তিনি বলেন। তাঁর কথা বড়সড় আলোড়ন সৃষ্টি করলো। তাঁর বক্তব্য ছাপা হয়ে বের হলে ইংলণ্ডেশ্বরী মহারাণী ভিক্টোরিয়া তা জেনে অত্যন্ত বিচলিত হলেন। এরই ফলে লেডী ডাফরিন পরবর্তীতে ' Women's Medical Movement ' শুরু করেন।
রমাবাঈ প্রতিষ্ঠিত ' আর্য মহিলা সমাজ ' সংস্কৃত শিক্ষার জন্য স্থাপিত হয়। 'Noble Women's Society ' স্থাপিত হয় নারীশিক্ষার পক্ষের কারণগুলিকে উদ্দীপিত করা এবং বালিকাদের মুক্তির জন্য বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে আন্দোলন সৃষ্টির জন্য। ইতিমধ্যে 'আর্য মহিলা সমাজ ' আহমেদনগর,থানে, বোম্বে, শোলাপুর, পান্ধারপুর, বর্শি প্রভৃতি স্থানে বিস্তার লাভ করে। কেবলমাত্র সংস্কৃত শিক্ষায় আর তা সীমাবদ্ধ রইলো না। সামাজিক ভয়ানক রীতিনীতি ও প্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলনে তা উত্তাল হলো। এই পরিস্থিতিতে রমাবাঈয়ের গ্রন্থ ' স্ত্রী ধর্ম নীতি ' প্রকাশিত হয়।
ঠিক এমনি সময়ে রমাবাঈ লণ্ডন যাবার জন্য একটা স্কলারশিপ পেলেন। মেডিসিন নিয়ে পড়াশুনা করে ডাক্তার হবার তাঁর বাসনা ছিলো। ১৮৮৩ সালে স্কলারশিপ পেয়ে তিনি ইংলণ্ড যান। কিন্তু ইংলন্ডে মেয়েদের ডাক্তারি পড়ার তেমন সুবিধা ছিলো না। যে ক'জন মহিলা ডাক্তারি পেশার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তাঁরা হয় ইউরোপের মূল ভূখণ্ডের দেশগুলি অথবা আমেরিকা থেকে ডাক্তারি পড়াশুনা করে এসেছেন। আর যে ক'জন এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডাক্তারি পড়েছেন, তাঁরাও ঘন ঘন কমিটির নিয়ম নীতির পরিবর্তন আর পুরুষ সহপাঠীদের অত্যাচারের শিকার হচ্ছিলেন। উনিশ শতকের মধ্য ও পরবর্তী সময়ে এসব ঘটনা ঘটছিলো। ১৮৭৪ সালে জেক্স ব্যাক ' London School of Medicine for Women ' স্থাপন করেন। কিন্তু ততদিনে রমাবাঈ দেশে ফিরে এসেছেন। তাছাড়া ডাক্তারি পড়ার মত শারীরিক ফিটনেস তাঁর ছিলো না। কারণ তিনি কানে কম শুনতেন। এজন্য ডাক্তারি পড়ার ইচ্ছে ছেড়ে তিনি 'ক্রিশ্চিয়ানিটি' শিক্ষায় মন দেন। এ বিষয়ে দেশেই তিনি চর্চা শুরু করেছিলেন। তিনি Cheltenham Ladies' College -এ সংস্কৃত শিক্ষাদান করতেন। এ সময় ওদেশের জীবনযাত্রার নানা বিষয় তাঁকে আকৃষ্ট করে। জীবনে অজস্র ঘাতপ্রতিঘাতে একটা বিষণ্ণ আবহে তিনি দীর্ঘ সময় কাটান। ঈশ্বর সম্পর্কে প্রশ্নাত্মক ভাবনা, বিবাহের পরে সমাজচ্যুতি এসব নানা কারণে হিন্দুধর্ম ও ঈশ্বর সম্পর্কে তাঁর মনের আস্থা হারিয়ে যায়। শেষ অবধি দেশে ফেরার আগে সকন্যা খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেন। তিনি ব্যাপটিস্ট অ্যাঙ্লিকান চার্চে যোগদান করলেন।
রমাবাঈ গভীরভাবে জীবনকে, জীবনের অভিজ্ঞতাকে দেখতে ও বিশ্লেষণ করতে জানতেন। স্বদেশে বিবাহ পরবর্তী সমাজ জীবনের সমাজচ্যুতি যেমন তাঁকে আহত করেছিল, তেমনি ইংলণ্ডের জনজীবনে যাজক সম্প্রদায়ের পরিচালিত সমাজব্যবস্থাও তাঁর অস্বস্তির কারণ হয়েছিল। লণ্ডন গমনকালের তাঁর এক প্রিয় সঙ্গিনী যখন আত্মহত্যা করলেন, তখন সেদেশের সম্পর্কে তাঁর ধারণা আরো অন্ধকারে ডুুবে গেলো। তবে এ সময়ই তিনি ভারতে ফিরে তাঁর ভবিষ্যৎ কর্মসূচি কি হবে তা স্পষ্ট করে অনুভব করেন। এমনকি কর্মপদ্ধতি সম্পর্কে সঠিক সিদ্ধান্তে আসেন। শিক্ষার সঙ্গে নানাপ্রকার হস্তকাজ সমন্বিত শিল্পশিক্ষার প্রয়োজনও অনুভব করেন। তিনি স্বপ্ন দেখতে থাকেন শিক্ষার সাথে সাথে শিক্ষার্থীদের জীবন- জীবিকার স্বাবলম্বিতার কথা। ভারতের শিক্ষা ব্যবস্থায় কিণ্ডারগার্টেন পদ্ধতির সংযোজনের প্রয়োজনও তিনি অনুভব করেন। ডাক্তার হতে গিয়ে ব্যর্থ হলেও রমাবাঈ স্বদেশে ফিরে সমাজ সংস্কারমূলক কাজে সম্পূর্ণরূপে আত্মনিয়োগ করলেন। এও বুঝলেন এসব করতে গেলে প্রচুর অর্থের প্রয়োজন। ঠিক এমনি সময় আমেরিকা যাবার একটা সুুযোগ এলো। তাঁর দূরসম্পর্কিতা আত্মীয়া আনন্দীবাঈ যোশী 'উইমেন 'স মেডিকেল কলেজ ইন ফিলাডেলফিয়া ' থেকে প্রথম ভারতীয় নারীরূপে ডাক্তারী পাশ করে তাঁর গ্র্যাজুয়েশন অনুষ্ঠানে আমেরিকা যাবার জন্য রমাবাঈকে আমন্ত্রণ জানান।
রমাবাঈ ভারতে সমাজ সংস্কারের নানা পরিকল্পনাকে বাস্তবায়নের জন্য অর্থ সংগ্রহের একটা সুযোগ পেয়ে গেলেন। অর্থ সংগ্রহের জন্য বেশ কিছুদিন আমেরিকা ও সামান্য কিছুদিন কানাডায় কাটান তিনি। রমাবাঈ তিন বছর ধরে আমেরিকার নারীর মুক্তি ও স্বাধিকার অর্জন এবং ভারতের বালবিধবাদের দুর্গতিপূর্ণ জীবন বৃত্তান্ত নিয়ে নানাস্থানে ভাষণ দিয়ে বেড়ালেন। আমেরিকাতে গড়ে ওঠে 'রমাবাঈ ফাউণ্ডেশন ', এর বিভিন্ন প্রোজেক্ট সম্পাদনের জন্য অর্থ সংগ্রহ চলতে লাগলো। আমেরিকায় সেখানকার স্থানীয় নানা বিষয় নিয়েও রমাবাঈ ভাষণ দিচ্ছিলেন। যেমন 'ম্যাসাচুসেটস্ সোসাইটির ' বিশেষ উদ্যোগ প্রাণী সংরক্ষণ এবং এ বিষয়ে সোসাইটির মতামত নিয়ে নানা সভায় আলোচনা করেন। আবার ১৮৮৮ সালে ' ইন্টারন্যাশনাল কাউন্সিল অফ উইমেন '-এর প্রথম মিটিং হলে সেখানেও ভাষণ দেন। এই সংস্থায় ব্রিটেন, আমেরিকা ও কানাডার সক্রিয় কর্মীরা ছিলেন। এর আগে 'ফিলাডেলফিয়া প্রকাশন' থেকে রমাবাঈয়ের বিশ্ব বিখ্যাত গ্রন্থ ' HIGH CASTE HINDU WOMEN ' প্রকাশিত হয়ে গিয়েছিল। বোস্টনের 'রমাবাঈ ফাউণ্ডেশন'এর উদ্যোগে ত্রিশ হাজার ডলারের বেশি অর্থ সংগৃহীত হলো। রমাবাঈয়ের বিখ্যাত গ্রন্থটির দশ হাজারেরও বেশি কপি আমেরিকাতে বিক্রি হলো। এর লভ্যাংশ ভারতের সমাজের গৃহপরিত্যক্তা আশ্রয়হীনা নারীদের জন্য ব্যয়িত হলো। তিনি কিণ্ডারগার্টেন শিক্ষা পদ্ধতিও শিখে নিলেন। আমেরিকার গনতান্ত্রিক পদ্ধতি ও নারী জীবনের অবস্থা দেখে তিনি সন্তুষ্ট হয়েছিলেন।
১৮৮৮সালেই তিনি দেশে ফিরে এলেন এবং পর বছর বোম্বেতে সহায়হীন বালবিধবাদের জন্য আবাস ও শিক্ষালয় ' সারদা সদন ' স্থাপন করেন। এটি মহারাষ্ট্রে বিধবাদের জন্য স্থাপিত প্রথম হোম। এখানে খ্রিস্টান ডক্ট্রিনস্ পড়ানো হলেও হিন্দু মহিলাদের ধর্ম বিষয়ে স্বাধীনতা ছিলো। যেহেতু রমাবাঈ নিজে খ্রিস্টান ও মিশনারীদের দ্বারা এটি পরিচালিত হতো, তাই স্থানীয় হিন্দুরা এটাকে সুনজরে দেখেনি। বরং সন্দেহ করতো। ফলাফল ভালো হলো না, তিনি নানা বিষয়ে সমালোচনার ঝড়ে পড়লেন। বাধ্য হলেন পুনে চলে যেতে এবং সেখানে " মুক্তি সদন " ( মুক্তি মিশন পরবর্তীকালে নাম হয়) প্রতিষ্ঠা করলেন।
রমাবাঈ খ্রিস্টান মিশনারীদের হয়ে কাজ করছিলেন বলে নানা প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে তাঁকে চলতে হয়। মুক্তি সদন গড়ে তোলা হয় আশ্রয়হীনা, সংসার পরিত্যক্তা যুবতীদের জন্য। KRUPA SADAN গড়ে তোলা হয় সমাজ বিতাড়িতা পতিতা নারীদের জন্য। এখানেও সারদা সদন গড়ে তোলা হয়। সারদা সদনে বসবাস, শিক্ষা, বৃত্তিমূলক শিক্ষার ব্যবস্থা এবং চিকিৎসার ব্যবস্থা ছিলো। এই সুযোগ পেতো দরিদ্র, বিধবা, অনাথ শিশু ও অন্ধেরা। ভোর চারটে থেকে রাত সাড়ে আটটা অব্দি টানা পরিশ্রম করে যেতেন রমাবাঈ। ১৮৯৬ সালে মহারাষ্ট্র ও মধ্যপ্রদেশের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষকালে তিনি গরুর গাড়ির একটা ক্যারাভান নিয়ে দুর্গত অঞ্চলের হাজার হাজার শিশু, শিশু বিধবা, অনাথ অন্যান্য দুর্গত নারীদের মুক্তিমিশন ও সারদাসদনের আশ্রয়ে নিয়ে আসতেন। এদের পুনর্বাসন ও শিক্ষার জন্য তিনি সর্বশক্তি নিয়ে নেমেছিলেন। মুক্তিমিশনে তিনি একটা গির্জা গড়েছিলেন। ' পণ্ডিতা রমাবাঈ মুক্তিমিশন' বর্তমানেও সক্রিয় আছে। তাঁর আদর্শে এখনো সেখানে দরিদ্র, নিঃস্ব অসহায় নারী, অনাথ ও অন্ধরা আশ্রয়, শিক্ষা, চিকিৎসা ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার সুযোগ পায়।
সারাজীবন রমাবাঈ অবহেলিতা অপমানিতা ও স্বাধিকার বঞ্চিতা নারীদের জন্য সংগ্রাম করে গেছেন। এই উদ্দেশ্যে সারা ভারতের নানাস্থানে, বিদেশে ভ্রমণ করেছেন, ভাষণ দিয়েছেন। এসব সত্ত্বেও সাতটি ভাষায় জ্ঞানী নারীটি কতগুলি অমর গ্রন্থ লিখে গেছেন। গ্রীক ও হিব্রু ভাষার মৌলিক সমগ্র বাইবেলের মারাঠী ভাষায় অনুবাদ করেছেন। জীবনের চরমতম ব্যস্ততার সময়ে তাঁর ইংরেজি ভাষার প্রথম ও বিশ্বখ্যাত বই High Caste Hindu Women লিখেছেন। বইটি উৎসর্গ করেছিলেন আরেক প্রতিভাময়ী ভারতীয় নারী ডা.আনন্দীবাঈ যোশীকে, যিনি প্রথম পাশ্চাত্য চিকিৎসাবিদ্যায় ডিগ্রিপ্রাপ্তা ভারতীয় নারী। এই নারী শিক্ষান্তে আমেরিকা থেকে ভারতে ফেরার ছয় মাসের মধ্যে ১৮৮৭ সালে পরলোক গমন করেন। রমাবাঈয়ের বিখ্যাত বইটি সম্পর্কে তাঁর অভিমত — হিন্দু নারীর জীবনের অন্ধকারময় কোণে কোণে রমাবাঈ আলোকপাত করেছেন। আরও আছে এতে বাল্যবিবাহ ও বালবিধবাদের করুণ কাহিনী। গ্রন্থটি ব্রিটিশ শাসিত সেকালীন হিন্দু প্রাধান্যপ্রাপ্ত সমাজের নারী নির্যাতনের অকথিত কাহিনী। রমাবাঈয়ের আমেরিকা ভ্রমণের কাহিনীটি প্রাচ্যসুলভ ইংরেজি থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন রীতি ও শৈলীর ইংরেজিতে লেখা হয়েছে। রমাবাঈয়ের মৃত্যুর অর্ধ শতাব্দীকাল পরে তাঁর সম্পর্কে A.B. Shah বলেন, "... the greatest woman produced by modern India and one of the greatest Indians in all history. " ব্রিটিশ সরকার রমাবাঈকে সমাজসেবামূলক কাজের জন্য 'KAISAR- I - HIND ' মেডেল প্রদান করেছিলেন।
সারাজীবন রমাবাঈ অবহেলিতা অপমানিতা ও স্বাধিকার বঞ্চিতা নারীদের জন্য সংগ্রাম করে গেছেন। এই উদ্দেশ্যে সারা ভারতের নানাস্থানে, বিদেশে ভ্রমণ করেছেন, ভাষণ দিয়েছেন। এসব সত্ত্বেও সাতটি ভাষায় জ্ঞানী নারীটি কতগুলি অমর গ্রন্থ লিখে গেছেন। গ্রীক ও হিব্রু ভাষার মৌলিক সমগ্র বাইবেলের মারাঠী ভাষায় অনুবাদ করেছেন। জীবনের চরমতম ব্যস্ততার সময়ে তাঁর ইংরেজি ভাষার প্রথম ও বিশ্বখ্যাত বই High Caste Hindu Women লিখেছেন। বইটি উৎসর্গ করেছিলেন আরেক প্রতিভাময়ী ভারতীয় নারী ডা.আনন্দীবাঈ যোশীকে, যিনি প্রথম পাশ্চাত্য চিকিৎসাবিদ্যায় ডিগ্রিপ্রাপ্তা ভারতীয় নারী। এই নারী শিক্ষান্তে আমেরিকা থেকে ভারতে ফেরার ছয় মাসের মধ্যে ১৮৮৭ সালে পরলোক গমন করেন। রমাবাঈয়ের বিখ্যাত বইটি সম্পর্কে তাঁর অভিমত — হিন্দু নারীর জীবনের অন্ধকারময় কোণে কোণে রমাবাঈ আলোকপাত করেছেন। আরও আছে এতে বাল্যবিবাহ ও বালবিধবাদের করুণ কাহিনী। গ্রন্থটি ব্রিটিশ শাসিত সেকালীন হিন্দু প্রাধান্যপ্রাপ্ত সমাজের নারী নির্যাতনের অকথিত কাহিনী। রমাবাঈয়ের আমেরিকা ভ্রমণের কাহিনীটি প্রাচ্যসুলভ ইংরেজি থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন রীতি ও শৈলীর ইংরেজিতে লেখা হয়েছে। রমাবাঈয়ের মৃত্যুর অর্ধ শতাব্দীকাল পরে তাঁর সম্পর্কে A.B. Shah বলেন, "... the greatest woman produced by modern India and one of the greatest Indians in all history. " ব্রিটিশ সরকার রমাবাঈকে সমাজসেবামূলক কাজের জন্য 'KAISAR- I - HIND ' মেডেল প্রদান করেছিলেন।
সমাজসেবা আর সমাজ বদলানোর কাজেে সারা জীবন ব্যস্ত থাকায় রমাবাঈ অল্প সময়ই নিজ পরিবারকে দিতে পেরেছেন। তবু স্বামীর মৃত্যুর পর শিশুকন্যা মনোরমাকে সব কাজের ভিড়ে গড়ে তুলতে তাঁর কোন ত্রুটি হয়নি। বোম্বে থেকে বি.এ.পাশ করে মনোরমা আমেরিকায় উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেন এবং দেশে ফিরে বোম্বের পুনঃপ্রতিষ্ঠিত সারদা সদনের প্রিন্সিপল নিযুক্ত হলেন। তখনকার দিনে গুলবর্গা পশ্চাদ্পদ স্থান ছিলো। মনোরমার সহায়তায় সেখানে রমাবাঈ ' ক্রিশ্চিয়ান হাই স্কুল ' স্থাপন করে মনোরমাকে এর প্রিন্সিপাল করেন। ১৯২০ সাল থেকেই তাঁর স্বাস্থ্য ভাঙ্গছিলো বলে মুক্তি মিশনের সব দায়িত্বও মনোরমাকে দিলেন। কিন্তু আজীবন প্রিয় স্বজনের মৃত্যুবেদনা রমাবাঈয়ের পিছু ছাড়েনি। তাই বুঝি প্রিয় কন্যার আকস্মিক অকাল মৃত্যুর বেদনাও তাঁকে পেতে হলো। রমাবাঈ সেপটিক ব্রঙ্কাইটিসে বেশ কিছুদিন ধরে ভুগছিলেন। কন্যার মৃত্যুর ঠিক নয়মাস পরে ৫এপ্রিল, ১৯২২ সালে এই অনন্যা নারী পণ্ডিতা রমাবাঈ সরস্বতী পরলোক গমন করলেন। পেছনে পড়ে রইলো রোদনভরা অগনিত বালবিধবাদের বোবা মূর্তি, ব্যক্তি রমাবাঈয়ের আশৈশব সংগ্রাম, প্রিয় আপনজনদের পর পর মৃত্যুর এক মহালেখ্য। তিনি অশ্রুর প্রান্তরে হেঁটে জ্ঞানার্জনে ছিলেন অক্লান্ত, বিতরণ করেছেন নিখাদ করুণা ও মমতা, আশ্রয় দিতে চেয়েছেন নির্যাতিতা আশ্রয়হীনাদের, স্বাবলম্বী ও স্বাধীন করতে চেয়েছেন তাদের। নিজের জন্য তাঁর কিছু চাওয়ার ছিলো না। এমন অনন্যা নারী ক্বচিৎ কদাচিত মেলে।
পাশ্চাত্য নারীবাদীরা রমাবাঈয়ের মত আত্মত্যাগী, সমর্পিতপ্রাণা সংগ্রামী নারীর কথা অল্প শুনেছেন বললে অত্যুক্তি হবে না, যদিও পাশ্চাত্য নারীবাদীদের নারীর ক্ষমতায়নের বিষয়ে সুদীর্ঘ সংগ্রাম ও আন্দোলনের অভিজ্ঞতা আছে। কিন্তু প্রায় সমকালে এদেশে প্রায় একক প্রয়াসে রমাবাঈ যে সংগ্রাম করে গেছেন তা কমই মেলে। তবে সাম্প্রতিককালে রমাবাঈ সম্পর্কে কিছু কিছু পাণ্ডিত্যপূর্ণ রচনা প্রকাশিত হচ্ছে বলে জানা যায়। ভারত ও পাশ্চাত্যে সেসব কিছু হলেও প্রকাশিত হচ্ছে। এতে রমাবাঈ সম্পর্কে অনেকেই কিছু কিছু জানতে পারছেন। ভারতীয় নারীবাদী সমাজতত্ত্ববিদ্ মীরা কোসাম্বির লেখালেখি হালে প্রাচ্য পাশ্চাত্যকে রমাবাঈকে চিনিয়ে দিচ্ছে। প্রকৃতপক্ষেই রমাবাঈ ভারতের অনন্যা বিস্ময় নারী। মীরা কোসাম্বি উনিশ শতকের নারীবাদী আন্দোলনকারী রমাবাঈয়ের রচনাসমূহ সংগ্রহ, সম্পাদনা ও মারাঠী থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন। এই বিশাল কাজ মীরা কোসাম্বির একটা বিরাট অবদান।
0 comments: