লেখা-লেখি

আ মরি বাংলা ভাষা

২:৩৬:০০ PM 3 Comments


© সুনীতি দেবনাথ 




 স্কুলে তৃতীয় শ্রেণীর পড়ুয়া আমার নাতনী মাঝেমধ্যে আমার জেনারেল নলেজ পরীক্ষা করে। হারের সংখ্যা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই জেতার চেয়ে বেশি হয় বলাবাহুল্য। গম্ভীর কমেন্ট শুনতে হয়, ' আম্মা কিছুই জানে না,আম্মা তোমরা কিচ্ছু শেখোনি।' এই হার সব সময় সত্যি না হলেও আনন্দের তো বটে! সে যাক, আজকের প্রশ্ন ছিলো 'বিশ্বের কোন দেশে অন্যতম সরকারি ভাষা বাংলা বলতো? '
    প্রশ্ন শুনে আয়েস করে চটপট জবাব দেবো ভাবছিলাম! আজ হারার ইচ্ছে মোটেই ছিলো না। বলতে গেছি, ' কেন আমাদের ত্রিপুরা ...'। কী হাসি ওর! বললো, ' এ মা! তুমি বড় অমনোযোগী ছাত্রী ছিলে গো! কোন দেশ বলেছি, আর অন্যতম বলেছি কিন্তু! ' আরে ঠিকই তো! খেয়ালই করিনি! আজ হার স্বীকার করতেই হলো। বললো গম্ভীর হয়ে ' সিয়েরা লিওন, আফ্রিকার দেশ'। 'দ্যুৎএ হয় কী করে? ' ও বললো, ' সত্যি গো, মজা করছি না। ' এবার আমার ভাবনার পালা। আমাকে ভাবতে দেখে ও বিরক্ত হয়ে পুতুল খেলতে চলে গেলো গজগজ করে। 'পারবে না কিছুই আবার গাল ফোলাবে ', হ্যাঁ! ওদিকে কান না দিয়ে ভাবতে লাগলাম। 
   স্কুলে বাংলার পাশাপাশি ভূগোল পড়াতাম। সেইসূত্রে এটুকু মনে পড়লো সিয়েরা লিওন আফ্রিকার পশ্চিম উপকূলের  আটলান্টিক মহাসাগরের পার্শ্ববর্তী একটা ছোট্ট নগন্য দেশ। ১৯৬১ সালে এদেশ স্বাধীন হয়। টাইটানিয়াম আর বক্সাইট উৎপাদন করে বলে বিখ্যাত। এছাড়া সোনা, হীরের উৎসও আছে এদেশে । কিন্তু না, এদেশের একটি লোকও বাংলা বলে না। তাহলে? তাহলেটাই জানতে হলো। আমার নাতনী ঠিকই বলেছে। একটা শব্দ শুধু লাগাতে হবে। সাম্মানিক। ' অন্যতম সাম্মানিক সরকারি ভাষা ' এদেশের বাংলা।
    ১৯৬১ সালে স্বাধীন হয় দেশটি। স্বাধীনতার ৩০ বছরের মাথায়, ১৯৯১ সালে, আটলান্টিক  প্রবল দুর্নীতি এবং দেশের সম্পদ নয়ছয়ের প্রতিবাদে গৃহযুদ্ধ শুরু হয় সিয়েরা লিওনে। ২০০২ সাল অব্দি এই গৃহযুদ্ধ চলতে থাকে! গৃহযুদ্ধ থামাতেই রাষ্ট্রসংঘ হস্তক্ষেপ করলো। রাষ্ট্রসংঘের প্রতিনিধি হয়ে ৫৩০০ জন বাংলাদেশী সৈনিক এখানে পীসকর্প বাহিনী হিসেবে নিয়োজিত হলেন।
         পীসকর্পের জন্যই শেষ অব্দি শান্তি ফিরে আসে সিয়েরা লিওনে। এই অবদানের স্বীকৃতি হিসেবেই সেদেশের রাষ্ট্রপতি আলহাজ আহমেদ তেজান কাবাহ্ ‘বাংলা’ ভাষাকে সিয়েরা লিওনের ‘সাম্মানিক সরকারি ভাষা’ হিসেবে স্বীকৃতি দেন।
     এই হচ্ছে প্রকৃত ঘটনা। আমার কথা হচ্ছে আমার মত অল্প জনই এই ঘটনা জানি। সুদূর বিদেশে আমাদের মাতৃভাষার গৌরবের কথা আমরা প্রায় জানি না। আমরা যাঁরা সাহিত্য কর্মের সঙ্গে যুক্ত, বাংলা সাহিত্যের অগ্রগতির কথা বলি বা ভাবি, আমাদের বদৌলতে বাংলা ভাষার এমন সম্মান প্রাপ্তি ঘটেনি। তাহলে বলতেই হয় আমাদের ভাবনা বা কথা নেহাতই ঠোঁটের কথা! আর হাততালি পাওয়া দিলের আকাঙ্ক্ষা!
    বছরে একদিন করে রবীন্দ্র জয়ন্তী  বা বিশ্ব মাতৃভাষা দিবস জমকালোভাবে পালন করলে কর্তব্য সম্পাদন হয়ে যায় না। রবীন্দ্রনাথের প্রয়ানের পর কতদিন কেটে গেলো, কিন্তু এখনো তাঁর মত সাহিত্যসেবী একজনকে পেলাম না কেন, যাঁকে দেশ ও জাতির বিশ্ব দরবারে বাংলা সাহিত্যের গ্রেট এ্যাম্বাসেডর আখ্যা দেওয়া চলে? বাংলাদেশী সেই ৫৩০০ জন সেনানীকে সালাম, তাঁরা সিয়েরা লিওনে কেবল শান্তি শৃঙ্খলা আনেননি, বাংলাভাষার সম্মান বর্ধিত করেছেন! আর সখেদে বলতে হয় — হায়! আ মরি বাংলা ভাষা

SUNITI Debnath

আমি সুনীতি দেবনাথ, অবসরপ্রাপ্ত সরকারি শিক্ষিকা। কবিতা, প্রবন্ধ ও ছোটগল্প লিখি। কবিতা আমার প্রিয়ভূমি, শৈশব থেকেই হেঁটে চলেছি...

৩টি মন্তব্য:

  1. এই মন্তব্যটি একটি ব্লগ প্রশাসক দ্বারা মুছে ফেলা হয়েছে।

    উত্তরমুছুন
  2. অনেক ধন্যবাদ জানাচ্ছি আপনাকে। আর শুভকামনা!

    উত্তরমুছুন
  3. অনেক ধন্যবাদ জানাচ্ছি আপনাকে। আর শুভকামনা!

    উত্তরমুছুন