কদম শিউলি বকুল ভাঁটফুলের দিন
© সুনীতি দেবনাথ
--------------------------------------------
----------------------------------------------একটা আশ্চর্য মিঠেল গন্ধ, বিচিত্র বর্ণালি আর মাদকতা ভরা কতোগুলি দিনের কাহিনী। বয়স কত হবে? দেড়বছর থেকে শুরু করে পাঁচের সীমানা ছুঁই ছুঁই বড়জোর। দেড় থেকে শুরু হতে পারে? স্মৃতি কি অতোটা সকাল থেকে মনে থাকতে পারে? পেরেছিল কিন্তু। হয়তো ব্যতিক্রমী। নিজেও অবাক না হয়ে পারি না। নেহাতই শিশু শিশু দুধেল গন্ধমাখা কতগুলো দিন। এতো আগের স্মৃতি মাখা দিন মনে থাকে, জানা ছিলো না মোটে। অথচ আজ অস্তরাগে রাঙানো দিনগুলিতে সেসব দিন ঠিক স্পষ্ট থেকে আরো স্পষ্ট হয়ে দোরে কড়া নাড়ে।
আমার ভোর হতো ভোরের বেশ আগেই। বাইরে তখনো আঁধারে মাখামাখি আসছি আসছি ভোরালি ঠাণ্ডা বিস্টিভেজা সকালগুলি অস্পষ্ট কেমন করা সুরে ডেকেই চলতো আয় আয়। ফুুল কুড়োবি না?
মায়ের শ্বাসপ্রশ্বাস তখনো আয়েশে ঝিমঝিম। ওপাশের খাটে বাবার নাকের হালকা ডাক শোনা যাচ্ছেই। আমার বয়েসী আর কেউ নেই বাড়িতে। দিদিমা এলে পাশে কারুকাজ করা ঝকঝকে পেতলের পানের বাটা নিয়ে বিকেলে ছায়া ছায়া উঠোনের একপাশে শীতলপাটি পেতে পাড়াপড়শী বৌ ঝিদের নিয়ে গালগপ্পের আসর বসাতোই। দিদিমার মুখেঐ আসরেই শুনেছি আমার ঠাকুমার নাম ছিল গৌরী। আমার জন্মের ঠিক একবছর আগে গোলগাল চেহারার, কাঁচাসোনা রঙের, একমাথা কোঁকড়ানো চুলওলা, মাঝারো গড়নের শান্তশিষ্ঠ কিন্তু মারাত্মক জেদী আমার ঠাকুমা একদিনের কি যেন অসুখে টুপ করে মরে গিয়েছিলেন। বুকে বড় জ্বালা ছিল তাঁর, পনেরো বছরের আমার মা হাতে গলায় কোমরে হরেক ধরণের তাবিজ কবচে সুসজ্জিত হয়েও একটা ছেলেপুলের মা হতে পারেননি । অথচ ঠিক নয় বছরে সর্ব সুলক্ষণা আমার মায়ের রীতি অনুযায়ী গৌরী দান হয়ে বিয়ে হয়েছিল। একেবারে ঠাণ্ডা মেজাজের আমার সহজ সরল বালিকা মা খুব বাধ্য, আর কাজেকর্মে ঠাকুমার শিক্ষায় সুদক্ষা হয়ে ওঠেন। খুঁত ধরার জো ছিলো না। মাকে নাকি ঠাকুমা কথায় কথায় বাঁজা মেয়েছেলে বলে গালাগাল দিতেন। আর অবাক কাণ্ড ঠাকুমা মরে যাবার ঠিক একবছরের মাথায় আমার জন্ম। সেসময় আমাকে খুকু বলে ডাকা হতো। পোষাকী নামটা আমার দিদিমার অবদান, যা আমি কখনো পছন্দ করিনি।
বাড়িতে পৃথগান্নে কাকা কাকীমা। দুই পিসি সত্যবতী আর সুরবালার বিয়ে হয়ে গেছে আমার জন্মের আগেই। বাড়ির আর বংশের প্রথম সন্তান আমি। সেই সুবাদে আদরযত্নে বেশ দাম পেতাম। সেই সময়কালে মেয়ে হয়ে জন্মেছি বলে কিন্তু কোন খেদ ছিলো না পরিবারে। বরং একটু বেশি আহ্লাদ কচি লাউ ডগার মত লকলকে হয়ে বেড়েই চলছিল। আমার মায়ের ঠিক ষোল বছরে আমার জন্ম। এখন ভাবলে অবাক হই ষোল বছরে মা হওয়া? ভাবাই যায় না, নেহাতইখুকি খুকি সময়। স্কুল ব্যাগ নিয়ে সাইকেল চেপে দল বেঁধে খিলখিল হেসে পাড়া মাতিয়ে লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে প্রাইভেট টিউটরের বাড়ি যাওয়া আসা। মা তখন পাকা গিন্নির মত সংসারের চাকায় ঘুরপাক খেতেন সারাটা দিন, আর আমার মত চুপচাপ শব্দ না করা নিত্য নানা ঘটনা ঘটানোয় পটীয়সী ছোট্ট কন্যাটিকে সামলানোয় ব্যতিব্যস্ত। বিমনা প্রহরে ঘোমটার ফাঁকে আমগাছের ঝাঁপড়া ফাঁকফোকরে আকাশটাকে দেখে মনে হতো একটা দীর্ঘশ্বাস চেপে যেতেন। আবার কখনো দেখেছি আতাগাছের নিরিবিলি ডালে বসা জোড়া বন কপোত- কপোতীর খুনসুটি দেখে ফিক করে হেসে ফেলে মা হাততালি দিয়ে ফেলতেন। আমি হাঁ করে তাকিয়ে দেখতাম মাকে। বালিকা বালিকা মনে হতো, যেন আমার থেকে অল্প বড় এক খুকি।
আমার জন্ম পরাধীন ভারতে। তখন নারী পুরুষের সংখ্যানুপাত কি ছিল জানি না। তবে এটা জানতাম বা জানি কন্যাসন্তানের জন্মটাকে কন্যাদানের পুন্য প্রাপ্তির লোভ থাকা সত্বেও খুব যে সুনজরে নেয়া হতো তা কিন্তু নয়। কন্যাসন্তান তো দায়।কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা কন্যার জন্মের পরপরই যেন কুঁজো হয়ে যেতেন। বিশেষ করে মধ্যবিত্ত নিম্নবিত্ত ঘরে। ২০০১ সালের আগে স্বাধীন দেশে নারী- পুরুষের যে সংখ্যানুপাত প্রায় সমান সমান ছিল, বরং বলা যায় নারীর সংখ্যা সামান্য বেশি ছিল তা হঠাৎ করে কমে যায়। উদ্বেগের কারণ ছিল সেটা। অবশ্য ২০০১ সালের সেন্সাসে দেখা গেল সংখ্যাটা সামান্য ঊর্ধ্বগতির দিকে,হাজার পুরুষে নারীর সংখ্যা ৯৩৩ জন । ২০১১সালের সেন্সাসে আগের সেন্সাসের হাজার পুরুষে নারাীর সংখ্যা সামান্য বেড়ে দাঁড়ালো ৯৪০ জনে। সারা বিশ্বের ক্ষেত্রে তো প্রায় সমান সমান। আমাদের দেশে এই অনুপাত কম হবার পেছনে সরকারী নিষেধাজ্ঞার তোয়াক্কা না করে বেআইনি কন্যাভ্রূণ হত্যা একটি বিভীষিকাপূর্ণ কারণ। কন্যাদের জন্য আলো, হাওয়া, বনানী, সমুদ্র, নাক্ষত্রিক মহাকাশের সুমহান সৌন্দর্য, অন্ধকারের স্নিগ্ধ মহিমা, মৃত্তিকার সুগন্ধি মায়া আরো অনেক কিছু সহ কলমন্দ্রিত জনজীবনের অপার মায়া যেন নিষিদ্ধ ছিল । এ পৃথিবী পুরুষের পৃথিবী, এখানে অবাঞ্ছিত নারীর অংশীদারিত্ব।হয়তো সমাজ নারীকে বরদাস্ত করছে একটিমাত্র দুর্বলতায়, আর সেটা হচ্ছে পুরুষের উপভোগ্যা নারী, আর সে সূত্রে জন্মদাত্রী জননী। আর নয়তো নারী পুরুষের জন্য পিতা স্বামী আর পুত্ররূপে দায়মাত্র। তাই নারী কন্যা হয়ে এই পৃথিবীতে আসবে কিনা তার নির্ধারণকর্তা পুরুষ সমাজ।
বলাবাহুল্য এসব ভাবনা আজকের আমি সারা জীবনের অভিজ্ঞতার জঞ্জাল ঘেঁটে বলছি। ফিরে যাই সেদিনটাতে যেদিন আমি জন্মেছিলাম। দিদিমার মুখে গল্প শুনেছি আঁতুড় ঘরে সারারাত মা আমার অসহ্য অসহায় যন্ত্রণায় কাতরেছেন। তারপর ভোরের সূর্যের প্রথম আলোয় তীব্র তীক্ষ্ণ কণ্ঠে জেহাদ ঘোষণা করে আমি জন্মালাম। সুতীক্ষ্ণ সে চিৎকারে সবাই নাকি সেদিন চমকে উঠেছিল। এমন গলা! পুত্র সন্তান নই তবু পাড়াপড়শী সব নারী ঝাঁকে ঝাঁকে উলুধ্বনি দিয়েছিলেন, শাঁখ বাজিয়েছিলেন প্রমত্ত উল্লাসে! পরবর্তী আমার আমির কাহিনী কিছুটা স্মৃতি, কিছুটা মা দিদিমার মুখে শুনে শৈশবের জীবনচিত্রের নকশিঘর গড়ে উঠেছে।
এক ছোট্ট গ্রাম সুপাতলা। আমার জন্ম গ্রাম। কেউ কেউ বলতো সুখতলা। আমার জন্য সুখতলাই ছিল। এবার ফিরছি গোড়ার কথায়, ভোরের কথায়।
ঘর থেকে বেরোনোর পাছদরজা ছিল একটা, পাশে থাকতো একটা কাঠের চেয়ার আমারই জন্য। ওতে উঠে চুপিচুপি দরজার ছিটকিনি খুললেই মুক্ত বিহঙ্গম। এক পা এক পা করে এগিয়ে যাওয়া বকুলগাছের তলায়। ফ্রকের কোঁচড়ে মিঠেল বকুল কুড়োনো যে কি আনন্দের। ম ম করতো সুগন্ধ।টাটকা সকালের কুসুম কুসুম হাওয়া আর ঝরা বকুলের মগ্নকরা গন্ধ এখনো যেন মগ্ন চৈতন্যে শিহরণ তুলে বিবশ করে দেয়। বারবাড়ির পুবপাশে টলটলে জলের পুকুর, তার দক্ষিণ পশ্চিম কোণে বিশাল ঝাঁকড়া বকুল ফুলের গাছটায় অগুন্তি ফুল। ঝরে পড়ছে তো পড়ছেই। আমি কুড়োচ্ছি তো কুড়োচ্ছিই। যখন আর পারছি না তখন টলতে টলতে বাড়ি ফেরা। মায়ের নকল ধমকানো, আমার নকল কান্না, বাবার আসল কোলে টেনে নেওয়া। স্বপ্ন মনে হয়।
রিমঝিম বিস্টি, দমকা হাওয়া, ঝিম ধরা দুপুর। কে তোয়াক্কা করে! পা টিপে টিপে পড়শী বাড়ির পুকুর পার। পুকুরের নাম কলসপুকুর, তার পারে মাতালগন্ধী ভাঁটফুলের ঝোপ। ওপাশে বড় বড় সবুজ পাতাওলা কদম ফুলের সেকী সমারোহ! তাকিয়ে আছি তো আছি! ভাবতাম সারাটা পৃথিবীতে কদম ফুলের মত সুন্দর আর হয় না। দিদিমা বলতেন স্বর্গের নন্দনকাননের পারিজাত নাকি সবচেয়ে সুন্দর। ভাবতাম হোক সে। ওতো না মরলে দেখা হবে না। কদম ফুলের মত সুন্দর ফুল থাকতে আমি মরবো কেন? মরার কথা মনে হতেই গাটা ছমছম করে উঠতো। কলসপুকুরে নাকি এক বউ শ্বশুরবাড়ির যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে গলায় কলসী বেঁধে ডুবে মরেছিলো। সেই থেকে কোন কোন পূর্ণিমা রাতে সোনার কলস সারা পুকুরে ভেসে ছুটে বেড়াতো। ভয়ে ঘামতে ঘামতে ছুটে মায়ের গা ঘেঁষে দাঁড়াতাম। এখন হাসি পায় মনে হলে। সোনার কলস দেখা হয়নি, রাতের বেলা তো একা যাওয়া কোনমতেই সম্ভব ছিলো না, কাউকে বলতেও সাহস পেতাম না। কিন্তু বেজায় দুঃখ পেতাম হাতের নাগালের বাইরে রূপবাহারি কদম ফুলগুলির দেমাকি চেহারা দেখে। ছুঁয়ে দেখার সুযোগই পেতাম না। কিন্তু একবার প্রাণ ভরে ছুঁয়ে দেখার সুযোগ পেয়েছিলাম, সে পরের কথা। ভাঁটফুল দেখতে ভাল লাগতো, থোকায় কেমন বাহার! তবে কাছে ঘেঁষতাম না। এতো উগ্র গন্ধ গা গুলিয়ে দিতো!
আর শিউলি ফুল? ওতো পুজোর গন্ধ নিয়ে আসতো। কমলা বোঁটায় সাদা পাপড়ির শিশির ভেজা হাসি কেমন মা মা ভাব জাগিয়ে তুলতো। সক্কালবেলা কোঁচড় ভর্তি শিউলি কুড়োনো আমার নেশা ছিল। একা ছিলাম শৈশবে তাই ফুলের সঙ্গে যত কথাবার্তা, ভাববিনিময়, মান- অভিমান সবই চলতো। দুর্গাপুজো ছিল আমাদের সাত শরিকের পুজো, এ বছর আমাদের বাড়িতে তো পর বছর অন্য শরিকের বাড়িতে। এভাবে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চলতো। আর যে বাড়িতেই পুজো হোক না কেন পুজোর কদিন সব শরিক এক বাড়ির হয়ে যেতো। আমার সবচেয়ে ভাল লাগতো দশমীর দিনটি। সেদিন সব শরিকের বাড়িতে সাজ সাজ রব। দশমীর পুজোর পর প্রতিমা সব শরিকের বাড়ি ঘুরিয়ে তারপর সন্ধ্যেবেলা নদীতে বিসর্জন দেয়া হতো। প্রতিটি বাড়ি সেদিন সাফসুতরো, আলপনা আঁকা , নারকেল নাড়ু, তিলের নাড়ু, ক্ষীরের সন্দেশ আরো কতকিছু জ্যেঠিমা মা কাকিমারা হাতে হাতে তৈরি করতেন, যথাসময়ে বিতরণ করা হতো। পুজো তখন সবার পুজো মনে হতো,সত্যিকারের সার্বজনীনতায় দুর্গাপুজোর সমকক্ষ অন্য কোন পুজো ছিলো না।আজকের সাজগোজ, রকমারি পোষাকের আড়ম্বর, পুজোর থিম, আলোকসজ্জা যতকিছুই থাকনা কেন আমার কেন জানি মনে হয় পুজোটা বাইরের ঠাঁটঠমক হয়ে ঘরকে নিরানন্দ আলোহীন করে ফেলেছে।
আমার জ্যেঠতুতো দিদি সীমন্তিনী আর দাদা দুষ্টু শিরোমণি নবকান্তদা তখন বই স্লেট নিয়ে মাইল খানেক দূরের এক জমিদার বাড়ির স্কুলে পড়তে যেতো। বীরদর্পে যেতে যেতে করুণার দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে মুখ বেঁকাতো। মানে, ' দ্যাখ্ চেয়ে আমরা ইস্কুলে যাচ্ছি, তোর কক্ষনো যাওয়া হবেই না '। ওদের সামনে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতাম, যেন থোড়াই কেয়ার করি। বয়ে গেছে আমার, ইস্কুলে না গেলে কি আর যাবে আসবে! কিন্তু ভেতরে ভেতরে সে কী জ্বালা! ওরা চলে গেলে মনে হতো সব শূন্য! ঘরবাড়ি, ফুল এমনকি মা- বাবা! একদিন হু হু করে কেঁদেই ফেললাম! মা কাছেপিঠে কোন কাজে ব্যস্ত ছিলেন, ফোঁপানো কান্না শুনে ছুটে এসে বুকে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করলেন, ' কি হলো সোনা? কান্না কেন? ' অনেক চাপাচাপির পর বলেই ফেললাম, ' আমি ইস্কুলে যাবো। ' শান্ত স্বভাবেরই ছিলাম। আপন মনে একটা জগৎ গড়ে আপন মনে বাস করতাম আনন্দে! সেটা একান্তই আমার জগৎ। কোন জ্বালাতন করতাম না। সবাই ভালোবাসতো তাই। মা-বাবা ফ্যাসাদে পড়লেন চার বছরও পার করেনি, এখন স্কুল? চললো অনেক কথাবার্তা, সমঝানো। কিছুই লাভ হলো না। তাঁরাও অবাক হলেন এতো জেদী! নতুন করে যেনো তাঁদের খুকুকে চিনলেন। অবশেষে শলাপরামর্শ শেষে, স্কুলে মাস্টার মশায়ের সঙ্গে কথাবার্তা বলে ঠিক হলো দেওয়া হবে যেতে। বই, স্লেট - পেন্সিল সব জোগাড় হলো। প্রথম দিন বাবা নিয়ে গেলেন। এতো দূর! পা চলছিল না তবু বাবা বারবার বলেও কোলে ওঠাতে পারলেন না। পরদিন থেকে দাদা দিদির সঙ্গেই যাতায়াত। তখন ছয় বছর পূর্ণ না হলে স্কুলে ভর্তি হওয়া যাবে না এমনটা ছিলো না।
একটা মাঝারো ধরনের টিনের চৌচালা ঘর, বাঁশের তরজার বেড়া, একটা রুম, কতগুলো লম্বা বেঞ্চ ডেস্ক, একপ্রান্তে একটা চেয়ার ও টেবিল, পাশে ব্ল্যাকবোর্ড, আর একদঙ্গল বিচ্ছু ছেলেমেয়ে। মাস্টারমশায়ের হাতে লকলকে একটা জালিবেত। পাঠশালা। প্রথম থেকে চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্রছাত্রী আলাদা দলে বসা। সামনে খেলার মাঠ,বেশি বড় নয়। মাঠের পরে এক মন্দির। কি ঠাকুর জানি না। একপাশে বিরাট ছাতার মত অশ্বত্থ বটের গাছ, তলায় একটা কুয়ো, পাশে দড়িবাঁধা একটা বালতি। ব্যস্ত। বিপরীত পাশে বড় পুরোনো বকুল গাছে হলুদ হলুদ বকুল ফল আর ঝাঁকে ঝাঁকে ঠোঁট হলুদ সবুজ পালকে ঢাকা টিয়া পাখি ফলে ঠোক্কর দিচ্ছে, উড়ছে, দাপাদাপি করছে, সে কী চেঁচামেচি! আর দুষ্টু কিছু ছেলে পাখিদের লক্ষ্য করে ঢিল ছুঁড়তো — তখন ওদের চেঁচামেচি ওড়াউড়ি বেড়ে যেতো। ছেলেগুলি হেসে লুটোপুটি খেতো। আর স্কুলের পুবপাশে অনেকটা উঁচুতে একটা বিশাল দালানবাড়ি। দরজা জানালা কোনদিন খোলা দেখিনি। ওটা জমিদার বাড়ি নাকি। ওই স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা ওঁরা। কলকাতা থাকেন, দৈবাৎ কখনো আসেন। আমার বছর খানেকের জীবনে কোনোদিন আসতে দেখিনি।
একটা বিশাল ক্যানভাসে আঁকা ছবি যেন। কী সুন্দর! মাঝখানে একটা বিশাল দিঘি, পারে তালগাছের সারি, চারপারেই ক 'টা জমিদার বাড়ি। ছোট মেজো বড় শরিক এমনি। পুবপারেরটা, যেটার কথা বলছিলাম ওটা সবচেয়ে বড় শরিকদের। উত্তরদিকে মেজোর,ওদের বেশ রমরমা চলছিল, জমজমাট। ও বাড়ির সঙ্গে আমার বাবার খুব ঘনিষ্ঠতা ছিল। উৎসবে পরবে আমাদের আসা যাওয়া ছিল। আমার দ্বিতীয় জন্মদিনে ওবাড়ির বড়মা নিজ হাতে সেলাই করে নকশাদার বুকে হানিকম্ব ডিজাইন করা হালকা গোলাপি রঙের একটা ফ্রক দিয়েছিলেন। ওটা পরিয়ে রোদহাসি হেসে বলেন, ' আরে! তোকে তো গোলাপপরী লাগছে মা। ' এতো সুন্দর ফ্রক আমি আর কখনো পরিনি। সত্যি। দিঘির পশ্চিম পারের ঠিক মাঝখানে একটা পথ এলোমেলো শুয়ে আনমনা হয়ে আমাদের গ্রামের দিকে চলে গেছে। এর উত্তরপাশে দুর্বল এক শরিকের বাড়ি, বাবার কাছে শুনেছি মামলা -মোকদ্দমা করে করেই এদের এই হাল। দক্ষিণপাশের বাড়ি আর দক্ষিণের বাড়ি দুটোই ইট দাঁত বের করা ভাঙ্গাচোরা জঙ্গলে ঢাকা গা ছমছম করা পোড়োবাড়ি। ওদিকে তাকালে আমার ভয়ে সারা শরীরের
লোম খাড়া হয়ে যেতো। দিদিমার কাছে শোনা গল্পের রাক্ষস - রাক্ষসী ' হাঁউ মাঁউ খাঁউ মাঁনুষের গঁন্ধ পাঁউ ' বলে হয়তো এক্ষুনি বেরিয়ে আসবে!
আমার বাড়ি আর তার আশপাশের এলাকা নিয়ে, চেনা মানুষজন নিয়ে গড়ে ওঠা পৃথিবীটা ক্রমে বড় হচ্ছিল, রঙ বদলাচ্ছিল, কলকাকলিতে কোলাহল মুখর হয়ে উঠছিল। আমাদের বাড়ির ঠিক দক্ষিণ দিয়ে একটা ছড়া এঁকেবেঁকে পশ্চিমমুখো হয়ে অনেকখানি পথ চলে নদীতে মিলেছিল।ছড়াটি বেশ সুরসিক ছিল। শীতকালে জল নেই, বালি বুকে ধু ধু মরুভূমি, বর্ষায় জল ফুলে ফেঁপে ফোঁসে আক্রোশে পাগলপারা। নৌকো ছাড়া গতি নেই। বাকি মাসগুলিতে জল দু 'পায়ের পাতা ঘিরে আহ্লাদী মেয়ের মত ঠমকে নুপূর বাজিয়ে চলতো। ছড়ার পারে উঁচু সড়ক, বর্ষা বাদে বাকি মাসগুলি সড়কে না হেঁটে ছড়ার বুক দিয়েই জল ছিটিয়ে নয়তো বালি উড়িয়ে আমরা স্কুলে যাওয়া আসা করতাম। মজা কাকে বলে! ছপ্পর ছপ্পর করে পা -ডোবা জলে হাঁটা! খুদে খুদে বরফ -সাদা কুচি মাছ আমাদের পায়ের পাতায় নেচে নেচে হালকা স্রোতে ভেসে চলে যেতো। সেদিন নবদা বললো, ' চল মাছ ধরি '।আমি উল্লসিত। পরবর্তী অধ্যায় মোটেই সুখকর ছিলো না। আমার ফ্রক খুলে দু 'জনে মিলে দু ' পাশে ধরে মাছ ধরার সে কী প্রাণান্ত অপচেষ্টা। প্রাপ্তি শূন্য। বাড়িতে গেলাম জল, কাদা আর বালিতে মাখামাখি হয়ে। জামা আর আমার অবস্থা দেখে মা রণচণ্ডী! এই প্রথম জীবনে আমি মায়ের প্রচণ্ড বকুনি খেলাম। কোন প্রত্যুত্তর না দিয়ে অপটু হাতে সব নোংরা পরিষ্কার করতে চেষ্টা করলাম। জানি ঠিকঠাক হয়নি। কিন্তু মা গম্ভীর হয়ে নিজের কাজ করতে লাগলেন,আর টু শব্দ করলেন না। এমন কি খেতেও ডাকলেন না। আমি ভয় পেয়ে গেলাম। এরপর ভীষণ অভিমান হলো। না খেয়ে চুপচাপ শুয়ে পড়লাম। কখন ঘুমিয়ে পড়েছি জানি না।
জাগলাম যখন তখন অনেক বেলা। স্কুলে যাবার সময় প্রায় হয়ে গেছে। স্নান করলাম, মা নিঃশব্দে ভাত দিলেন, কয়েক গ্রাস খেয়ে আর পারলাম না।এরপর সোজা দাদা দিদিদের সঙ্গে স্কুলের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। সেই ছোট্ট বয়সে আমার ভেতরে একটা আগুন দাউদাউ করে জ্বলছিল। এমন কি অপরাধ করেছি যে মা আমাকে এতোবড় শাস্তি দিলেন? সারাপথ কেবল ভাবলাম আর বাড়ি ফিরে যাবো না। কিন্তু যাবো কোথায়? কেন? মামার বাড়ি দিদিমার কাছে চলে যাবো। স্কুলের পথে একটিও শব্দ করিনি, স্কুলে গিয়েও না। দিদির বোধহয় কিছু সন্দেহ হয়, ' তোর কি হয়েছে রে? ' প্রথম চুপ ছিলাম। দিদি একটু চাপ দিতেই কেঁদে ফেলি এবং গলগল করে সব বলে ফেলি। এমনকি শেষ সিদ্ধান্তটাও। দিদিও সায় দিলো, কিন্তু মাইল চারেক দূরে পথ চিনে যেতে পারবো কিনা সন্দেহ প্রকাশ করলে প্রচণ্ড জেদের সঙ্গে বলে উঠলাম, ' পারবো, পারবো, পারবো। ' ঠিক হলো জল খাবার অছিলায় ক্লাস থেকে বেরিয়ে চুপচাপ পেছনের ঝোপ দিয়ে বেরিয়ে বড় রাস্তায় চলে রওনা দেবো। তারপর চলা আর চলা। মসজিদ পেরিয়ে সোজা রাস্তা। দিদি বইপত্র ওদের বাড়ি রেখে দেবে। কেউ আমার কথা জিজ্ঞেস করলে বলবে জানেনা।
পরিকল্পনা মাফিক অভিযান শুরু হলো। প্রথম বুুকটা একটু কেঁপে উঠেছিল। তারপর সব ঘটনা মনে হতেই জেদটা বেড়ে গেল। হনহনিয়ে মসজিদ পেরিয়ে সোজা রাস্তায় হাঁটতে লাগলাম। হাঁটছি তো হাঁটছি কেবল, পথ চিনতে একটুও অসুবিধে হয়নি । ক্রমে বেলা পড়ছিল। ক্ষিধে তেষ্টায় প্রাণ বেরিয়ে আসছিল। ভয়ও করছিল। এমন সময় দেখলাম কলুর ঘানিটা। মনে বিশ্বাস জাগলো এইতো আর একটু, এসে গেছি। ঠিক সন্ধ্যেবেলা পৌঁছে গেলাম মামাবাড়ি।
আমি অভিমান করে মুখ গুঁজে মাটির দাওয়ায় বসে আছি। এমন সময় বাবার গলা শুনতে পেলাম, ' খুকু, এই খুকু দেখ তোর জন্য কি এনেছি! 'ও মা! এ কী! এক ঝুড়ি কদম ফুল! সব আমার? হ্যাঁ তো, একটাও দেবো না কাউকে! .'.....' কি দিবি না রে খুকু? উঠ শিগগির বাড়ি যাবি।' ছোটমামার গলা শুনে ধড়ফড় করে জেগে উঠলাম। ও মা! আমি স্বপ্ন দেখছিলাম! এখন সকাল, সব মনে পড়লো। আমার তখন দম নেবার ক্ষমতা ছিলো না। দিদিমাকে চিৎকার করে ডাকতে চাইলাম, গলা দিয়ে স্বর বেরোলো না। আর মনে নেই। এখন ছোটমামা যত্ন করে চান করিয়ে গরম গরম ভাত খেতে দিলেন। আলুসেদ্ধ আর ভাত যে এতো স্বাদ আগে কোন দিন টের পাইনি। ছোটমামার কাছেই জানলাম উনি বাদে বাড়িসুদ্ধু সবাই কাল দুপুরে আমাদের বাড়ি চলে গেছেন। মা নাকি খুব অসুস্থ। আমি কেঁদে ফেললাম। আমার জন্য মা অসুস্থ হলো। রাতে আমাদের পাড়ার একজন এসে জেনে গেছে আমি ঠিকঠাক এসেছি কিনা। সবার চাপে দিদি সত্যি কথা বলে ফেলেছে।
বাড়ি ফিরে এদিকে ওদিকে কোথাও মাকে দেখতে না পেয়ে হঠাৎ চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করলাম। তখন জানতাম না আমার বাকি বাল্যকাল আর ভাবী জীবনের কান্নার ইতিহাসের সূচনা হয়ে গেছে। আর সে কান্না কখনো সোচ্চার, কখনো ফল্গু নদী।
শুনে দিদিমা ছুটে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে আঁতুড় ঘরের দিকে টেনে নিয়ে গেলেন। মা ঘুমে আচ্ছন্ন আর তাঁর বুকের কাছে একটা জ্যান্ত পুতুল ন্যাকড়া জড়ানো। হাত পা ছুড়ছে, টুপটুপ তাকাচ্ছে। আমার পাঁচ বছর পুরো হতে না হতে জন্ম নিলো আমার বোন শান্তি। এরপর শুরু জীবনের আরেক পর্ব।
0 comments: