লেখা-লেখি

রবীন্দ্রনাথ ও পাবলো নেরুদা মনে শান্তি দেয়- সুনীতি দেবনাথ

১০:৪৭:০০ PM 0 Comments

সাক্ষাৎকার— দোসর

একজন লেখক সত্তার আগেও একজন পাঠক সত্তা
বিরাজ করে। আমরা সেই পাঠক সত্তাকেই খুঁজে পেতে চাই?

•কোন বইটি আপনার সবথেকে প্রিয় এবং কেন? এই বিষয়ে যদি পাঠকদের বিস্তারিত বলেন।

বিস্মিত হবেন হয়তো একটা নয় একাধিক বই আমার প্রিয় তালিকায়। তবু যেহেতু প্রশ্ন করা হয়েছে কোনটা আমার সবথেকে প্রিয় বই বলতে তো হবে একটা নাম। আর কারণও বলতে হবে। দুদিন ধরে যুদ্ধ চলছে মনে কোন বইটি সবচেয়ে প্রিয় বাছাই করতে। একটা নাম মনে এলে আরো আরো বইয়ের মুখ উঁকি দিয়ে যেন বলে আমি নই কেন? ধুন্ধুমার কাণ্ড শেষে বলছি বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ' পথের পাঁচালী ' আমার প্রিয় বই। কেন প্রশ্ন করলে এক কথায় বলবো আমিও গাঁয়ের মেয়ে, অপু আর দুর্গার মাঝে আমি আমাকে দেখতে পাই। তবে খাঁটি বাংলার মেয়ে নই, ছিন্নমূল। ওপার বাংলা থেকে পাঁচ বছর বয়সে উপড়ে এনে ত্রিপুরার মাটিতে পুঁতে দেওয়া হয়েছে। এই মাটিতে বাংলার সবকিছু না থাকলেও অনেক কিছু আছে, একটা সুগন্ধি আছে যা বাংলার সঙ্গে মিলে যায়। জীবনের সঙ্গে মিলে যায়।  পাখপাখালি, ফুল,গাছগাছালি লতাপাতা, জীবন বৈচিত্র্য, মানুষের কাহিনী, ক্ষুদ্রতা তুচ্ছতা মহানতা নিয়ে গোটা মানুষের জ্যান্ত চরিত্রের সঙ্গে মিলে যায়। এ যেন অপু দুর্গার গল্প নয় আমার গল্প। আরেকটা কথা একটা বয়স পর্যন্ত মানুষের বোধহয় শুধু শৈশবই থেকে যায়, ছেলে মেয়ে আলাদা করা যায় না। যেমন অপু - দুর্গা না ছেলে, না মেয়ে। তাই তাদের সেই বয়সের কথা, ভাবনা -চিন্তা আমার ঐ বয়সের সঙ্গে কেমন খাপে খাপে মিলে যায়। আর সর্বজয়া, এ যে একেবারে আমার মা! নামে শুধু আলাদা। ইন্দির ঠাকরুন আমার আশ্রিতা দিদিমাটি নন কিভাবে বলি? আর এখানেই বিভূতিভূষণের কলমের জোর। আমি কোন প্রথাগত তাত্ত্বিক পদ্ধতিতে বলতে চাইছি না। লেখকের কুশলতার তাত্ত্বিক বিচার নয়, ওসব বহুকাল ধরে বিশিষ্ট সমালোচকরা করে গেছেন করবেনও। আমি শুধু কেন আমার প্রিয় বই সেই কথাই বলছি। আর তাও অতি সংক্ষিপ্ত আকারে।
    প্রকৃতি আর মানব সত্তা এ দুটিকে আলাদা যেন করা যায় না। বিভূতিভূষণ তাঁর উপন্যাসে এভাবেই দেখাতে চেয়েছেন। প্রকৃতির চালচিত্র, রূপ -রস -শব্দ -গন্ধ -স্পর্শ যে মহিমান্বিত রূপে তিনি অঙ্কন করেছেন তাতে তাঁকে সুররিয়ালিস্টিক কবি -শিল্পী না বলে পারা যায় না! বাংলা সাহিত্যে প্রকৃতির অন্দর মহলে, কবি জীবনানন্দ দাশ ছাড়া আর কেউ এতো দক্ষতা নিয়ে প্রবেশ করতে পেরেছেন বলে মনে হয় না। দুজনের একজন গদ্যশিল্গী,  অপরজন কবি। কিন্তু মৌলিক ভাবনায় দুজনের সাদৃশ্য আছে। পথের পাঁচালীতে বিভূতিভূষণ প্রকৃতি আর মানুষকে মিলিয়ে মিশিয়ে যেন জীবনের মহাকাব্য রচনা করেছেন। জীবনানন্দ তো তাঁর কাব্যে চরম ঔৎকর্ষকে স্পর্শ করেছেন।

   দুটি টুকরো ছবির কথা বলে আমার বক্তব্য শেষ করছি। অপু দুর্গা রেললাইন দেখতে যাবে। অজানাকে জানতে, অচেনাকে চিনতে যাবার সেকি আনন্দ! সেই আনন্দ কি ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেলো আলোময় হয়ে পথের দুপাশের গুচ্ছ গুচ্ছ দোলায়িত কাশ ফুলে?

    দুর্গার মৃত্যুর রাত্রি। আসন্ন ভয়ংকর ঘটনাটির জন্য প্রকৃতির সেই ঝড় বৃষ্টির রাতের আবহ! বিস্ময়কর নয়কি? যতবার বইটি পড়েছি কেঁপে উঠেছি, কেঁদে ফেলেছি। আর বইটি পড়া শেষ হলে এক উদাসীন শূন্যতা গহীনে বেজেছে, " হলুদ বনে বনে নাকছাবিটি হারিয়ে গেছে সুখ নেইকো মনে "।

•এমন কোনও বই আছে যা পড়ে আপনি জীবনের অন্ধকার সময়গুলিতেও আশার আলো খুঁজে পান?

হ্যাঁ আছে বৈকি। তবে বিশেষ একটি বই নয়। রবীন্দ্রনাথ ও পাবলো নেরুদার কবিতা মনে শান্তি দেয়। ভালো লাগে। গীতাঞ্জলি অনেক দুঃখদিনে সারাটা মনের আকাশ জুড়ে প্রশান্তির হাওয়া বইয়ে  দেয়। সত্যি কথা বলতে কি জীবনে অন্ধকার সময়ই তো বেশি, তাই বইয়ের দরকারটা বেশি!

•ফিকশন না নন-ফিকশন, কোন ধরণের বই পড়তে আপনার বেশি ভালো লাগে আর কেন?

সময়ের অতিক্রমণের সাথে সাথে মানুষের ভালো লাগা মন্দ লাগার তারতম্য ঘটে বোধহয়। বই পড়ার ক্ষেত্রেও সেটা ঘটে। প্রথম জীবনের কথা বলি। এই যেমন দশ এগারো বছর বয়স অব্দি গোয়েন্দা কাহিনী, রূপকথার কাহিনী এসব পড়তে খুব ভালো লাগতো। আমার ছোটবেলায় গোয়েন্দা কাহিনী স্বপনকুমার সিরিজ, মোহন সিরিজ এসব হাতে পেতাম বেশি। ঠাকুরমার ঝুলি, ঠাকুরদাদার থলে আরো কি কি সব পড়েছি আজ আর সেসব মনে পড়ে না।  পড়তাম ভ্রমণ কাহিনী, ভালো লাগতো। যা পেতাম তাই পড়তাম। অনেকটা একা ছিলাম, বই ছিলো সঙ্গী। আরেকটু বড় হয়ে বঙ্কিমচন্দ্র, শরৎচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ বিভূতিভূষণ ইত্যাদি শুরু হলো। অর্থাৎ ফিকশনের রাজত্ব। সাথে শুরু হলো কবিতা। আস্তে নন ফিকশন ঢুকতে লাগলো। মাঝে ফিকশন নন ফিকশনের মিশ্র এক বিচিত্র দুনিয়া! কবিতা শুরুতে ছিলো আজো আছে। ফিকশনও পুরো যায়নি। তবে প্রাধান্য পেয়েছে নন ফিকশন। প্রবন্ধ পড়তে এখন খুব ভালো লাগে। একটা কথা বলতে চাই বই পড়া আজন্ম নেশা। সীমিত সীমানায় নয় যখন যা পেয়েছি বা পাচ্ছি পড়তে ভালো লাগে। রামায়ণ, মহাভারত, বাইবেল, পুরাণ সব পড়েছি। পড়াটা হবি ছিলো, বই ছিলো আজন্ম বন্ধু ও সঙ্গী। এখনো পড়ি তবে সীমিত। চোখ সহায়তা করে না। সামলে চলতে হয়। ইদানিং শরীরও সহযোগিতা করে না। দেশের অনুন্নত অঞ্চলে থেকে চাইলেই পছন্দের বই পাওয়া কঠিন।

•সম্প্রতি কোন বইটি পড়েছেন? সে সম্পর্কে আপনার মতামত বিস্তারিতভাবে জানতে চাই।

অতি সম্প্রতি পড়লাম বাংলাদেশের জনপ্রিয় প্রতিবাদী কবি হেলাল হাফিজের বাংলাদেশের হৃদয় কাঁপানো কাব্যগ্রন্থ ' যে জলে আগুন জ্বলে '। অসাধারণ এই কাব্যগ্রন্থের কবিতা বাংলার মানুষের মুখে মুখে ফেরে। আমার রাজ্য ত্রিপুরার সীমানা তিনদিক থেকে বাংলাদেশ ঘিরে রেখেছে। কত কাছে তবু কত দূরে! বাংলা সাহিত্য চর্চার তৃতীয় ভুবনে থেকে দ্বিতীয় ভুবনের সাহিত্য চর্চার নড়াচড়া সাড়াশব্দ পেলেও প্রতিবেশী বিদেশী রাষ্ট্র বলে বাংলাদেশের বইপত্র পাওয়া সহজ ব্যাপার নয় ত্রিপুরা থেকে। হেলাল হাফিজের বইটাও সহজলভ্য ছিলো না। এবার পড়লাম নেটে।

বাংলাদেশের স্বাধীনোত্তর কালে সামরিক পট পরিবর্তনের অস্থির সময়ে প্রতিবাদী লেখনী নিয়ে রুখে দাঁড়ানো কবিদের এক জন হেলাল হাফিজ । তাঁর কাব্যের প্রধান উপকরণ যৌবন এবং বিদ্রোহ। যে জলে আগুন জ্বলে কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয় আশির দশকে। দুই যুগের বেশি সময় পরে প্রযুক্তির সহস্র আবিষ্কার আর জ্ঞান বিজ্ঞানের চরম উৎকর্ষতা সত্ত্বেও মানব সভ্যতা যেন প্রশ্নের সম্মুখিন । অর্থলোভী ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের হাতে বিশ্বের মানবতা বিপন্ন, মারণাস্ত্রের নির্লজ্জ যুদ্ধ যুদ্ধ খেলায় ধনী দেশগুলো অধিকতর ব্যস্ত , নৈতিকতা এবং বিবেক বোধ ক্ষতবিক্ষত । হেলাল হাফিজের যুদ্ধমিশ্রিত প্রেমের কবিতাগুলিকে ভিন্ন প্রেক্ষাপটে এখনও সমানভাবে প্রয়োজনীয় মনে হয়।
১৯৪৮ সালের ৭ অক্টোবর নেত্রকোনায় জন্মগ্রহণ করেছেন, যে নেত্রকোনায় বাংলার আরো অনেকানেক বিখ্যাত কবি সাহিত্যিক জন্মেছিলেন।  তাঁর পিতা খোরশেদ আলী তালুকদার,  মাতা কোকিলা বেগম। নেত্রকোনা দত্ত হাইস্কুল, নেত্রকোনা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা গ্রহণ করেন । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবস্থায় ১৯৭২ সালে তিনি তৎকালীন জাতীয় সংবাদপত্র দৈনিক পূর্বদেশে সাংবাদিকতায় যোগদান করেন। ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন দৈনিক পূর্বদেশের সাহিত্য সম্পাদক। ১৯৭৬ সালের শেষ দিকে তিনি দৈনিক দেশ পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদক পদে যোগদান করেন । সর্বশেষ তিনি দৈনিক যুগান্তরে কর্মরত ছিলেন।
         'জলেতে আগুন জ্বলে ' কাব্যগ্রন্থ বাংলার জনজীবনে উত্তাল উন্মাদনা সৃষ্টিকারী কাব্য। এই বইটি লেখার পর কবি অনেকদিন আর কোন বই লেখেননি।' নিষিদ্ধ সম্পাদকীয় ' কবিতা ' যে জলে আগুন জ্বলে ' কাব্যগ্রন্থের বিখ্যাত একটি কবিতা। এই জ্বালাময়ী, উন্মাদনা সৃষ্টিকারী কবিতাটি ১৯৬৯সালের গণ অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটে রচিত।
সে সময়ের রেলষ্টেশন গুলিস্তান ফুলবাড়িয়া এলাকায় ছিলো ই.পি.আর  অফিস। সেখানে যখন চারদিক থেকে দলবদ্ধ মানুষের মিছিল আসছিল, কবির পাশে দাঁড়িয়ে থাকা এক রিক্সাচালক চিৎকার করে বলতে থাকে মার শালাদের মার। সেই অগ্নিময়ী কথায় উদ্দীপ্ত কবি লিখে ফেলেন বিখ্যাত কবিতাটি , "যৌবন যার, এখনই যুদ্ধে যাওয়ার তার শ্রেষ্ঠ সময়/যৌবন যার, এখন মিছিলে যাওয়া তার শ্রেষ্ঠ সময়"। এসব পংক্তি রক্তে জাগায় উন্মত্ত ঢেউ, প্রাণে সৃষ্টি করে প্রমত্ত ঝড়। এই কবিতা লেখার পর কোন এক পত্রিকা সম্পাদকের দ্বারস্থ হলে তিনি ছাপাতে অসম্মত হন। কবিতাটি প্রকাশ করলে পত্রিকা বন্ধ হবার আশঙ্কা, শাস্তির ভয়ে ভীত হন সম্পাদক। কবিতার নামকরণ হলো : ' নিষিদ্ধ সম্পাদকীয় '।
বুদ্ধিজীবীদের ধারণা ১৯৭১ সালের যুদ্ধের আগে এটাই ছিলো তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে প্রথম  সশস্ত্র প্রতিবাদের কবিতা। সেইসময় প্রকাশিত না হলেও আজীবন অমর থাকবে কবিতাটি সকল স্বাধীনচেতা মানুষের হৃদয়ে। জানা গেছে কবিতাটি বাংলার কারিগরি শিক্ষা বিভাগের শিক্ষার সিলেবাসে গৃহীত হতে পারে।
       ১৯৮৬ সালে হেলাল হাফিজের বইটি প্রকাশিত হলো, দ্রুত বারোটি সংস্করণও প্রকাশিত হয়ে গেলো। কবি কিন্তু দ্বিতীয় বই আর প্রকাশ করার উদ্যোগ নিলেন না। অনেক দেরিতে ২০১২ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ' কবিতা একাত্তর '।
১৯৮৬ সালে প্রকাশিত তাঁর কবিতার বই ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ প্রকাশিত হয়। কবিতার জন্য পেয়েছেন নারায়ণগঞ্জ বৈশাখী মেলা উদযাপন কমিটির কবি সংবর্ধনা (১৯৮৫), যশোহর সাহিত্য পরিষদ পুরস্কার (১৯৮৬), আবুল মনসুর আহমদ সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৭), নেত্রকোনা সাহিত্য পরিষদের কবি খালেদদাদ চৌধুরী পুরস্কার ও সম্মাননা প্রভৃতি। কবিতায় তিনি ২০১৪ সালের বাংলা একাডেমী পুরষ্কার লাভ করেন।
      কবি হেলাল হাফিজ অকৃতদার। বর্তমানে একা অসুস্থ অবস্থায় ঢাকায় আছেন। একটি চোখ নষ্ট হয়ে গেছে। গ্লুকোমাতে অন্য চোখটিও আক্রান্ত। তাঁর কবিতার বই পড়ার পরপর ফেসবুকে আমি আমার টাইমলাইনে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছিলাম,তাতে দুজন বন্ধু জানালেন তাঁর অর্থাভাবে বিনা চিকিৎসায় চোখ নষ্ট হতে চলেছে। আমি উদ্বিগ্ন হয়ে জনগণের কাছে  সহযোগিতার আবেদন জানিয়েছিলাম। আমার আবেদনের ভিত্তিতে ওদেশের বন্ধু অমিয় দেবনাথ দেশবাসী ও জাতীয় সরকারের কাছে কবির চিকিৎসার জন্য আবেদন জানান। দ্রুত পট পরিবর্তন হচ্ছে প্রথম একটি কমিটি গঠিত হলো, বাংলাদেশ জাতীয় চক্ষু হাসপাতালের প্রধান চিকিৎসক ড.জহিদুর ইসলাম ভাই কবির চিকিৎসার সব দায়িত্ব নিলেন। দ্রুতগতিতে সব চলেছে ২৮ জুন কবির সর্বশেষ ইনভেস্টিগেশনের পর বন্ধু মির্জা মেহেদী হাসান স্ট্যাটাস দিয়েছেন :
    "বিধাতার অশেষ মেহেরবানী, আমাদের প্রিয় কবি হেলাল হাফিজের চোখের অবস্থা স্থিতিশীল রয়েছে। আজ সকাল ১১টায় আমাদের প্রিয় ডাঃ জহির ভাইয়ের তত্ত্বাবধানে প্রফেসর মুহাম্মদ হোসেন কবির চোখ পরীক্ষা করে এই রিপোর্ট দেন। কবিকে ছয় সপ্তাহ পরে আবার  চেকআপ করা হবে। এর মধ্যে ঈদের পর ডাঃ জহির ভাই কবিকে একবার প্রফেসর ডাঃ মুহাম্মদ হোসেনের ধানমন্ডি চেম্বারে নিয়ে যাবেন তাঁর চোখের সান্ধ্যকালিন প্রেসারটা পরীক্ষা করার জন্য। " ...
     একটা কবিতার বই পাঠের বিচিত্র অভিজ্ঞতা শেষ অব্দি একটি প্রতিবেশী রাষ্ট্রের একজন কবির চিকিৎসার জন্য গঠিত কমিটির উপদেষ্টার দায়িত্বে নিয়ে নিল। সবই হলো ফেসবুকের জন্য!

•বর্তমানে সময়ে কার/কাদের লেখা আপনার বিশেষ পছন্দ?

প্রচেত গুপ্তের ছোটগল্প, তিলোত্তমা মজুমদার ও স্বপ্নময় চক্রবর্তীর উপন্যাস। জীবনানন্দ দাশের পর অমিতাভ দাশগুপ্ত ও সুবোধ সরকারের কবিতা। এরপরের? না ভালো লাগা তেমন দানা বাঁধেনি।

•ইলেক্ট্রনিক নাকি ছাপা অক্ষর? পড়ার ক্ষেত্রে কোন মাধ্যমটি বেশি পছন্দ করেন?

দ্বিধাহীন কণ্ঠে বলছি ছাপা অক্ষরই পড়তে বেশি ভালোবাসি। লুকোছাপা নয় মোটেই। আপনারা সেকেলে ভাবুন লোকসান নেই আমার। নিঃসন্দেহে আমি সেকেলে মানুষ। ছেলে চেন্নাইয়ে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রী করার পর স্কলারশিপ পেয়ে আন্না ইউনিভার্সিটিতে দামি সফ্টওয়্যার কোর্স করে ত্রিপুরায় ফেরে সরকারি চাকরি পেয়ে। ওর ডেস্কটপে যখন কাজ করতো পাশে দাঁড়িয়ে দেখতাম। পরে ওর কাছেই সামান্য শিক্ষা কমপিউটারের। অতি সামান্য। এখনো ঐ সামান্য কাজ চালানোর মতো পারি। কাজেই ইলেকট্রনিক পদ্ধতি অস্বস্তিকর। বেশি জানলেও মনে হয় ছাপা অক্ষরের বইই বেশি ভালো লাগতো। ভাবুনতো বাইরে ঝমঝম বিষ্টি শুয়ে শুয়ে মোটা বইটার পাতা উল্টে যাচ্ছি। আহা! কী সুখ! তবে ইলেকট্রনিক, ওটাও চাই যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে।

•প্রিয় অনুবাদ সাহিত্য কোনটি এবং কেন?

ম্যাক্সিম গোর্কির রুশ ভাষায় লেখা বিশ্ব কাঁপানো উপন্যাস ' মাদার ' এর বাংলা অনুবাদ ' মা ' আমার প্রিয় অনুবাদ সাহিত্য। 'ম্যাক্সিম গোর্কি ' বা ' তিক্তপ্রাণ ম্যাকসিম ' হচ্ছে ছদ্মনাম। আসল নাম আলেক্সেই ম্যাক্সিমভিচ পেশকভ। বলা যায় এই রুশ উপন্যাসটি প্রকাশিত হবার পর পৃথিবীর প্রায় সব ভাষাতেই অনূদিত হয়েছিল এবং এখন অব্দি সবচেয়ে বেশি পঠিত বই এটি। এই উপন্যাস সম্পর্কে লেনিন বলেছিলেন, " এটি দরকারী বই, বহু মজুর বিপ্লবী আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল অচেতন ও স্বতঃস্ফূর্তভাবে, এবার ' মা ' পড়ে তাদের মহা উপকার হবে ...খুবই যুগোপযোগী বই।" প্রকৃতপক্ষে সমগ্র বিশ্ব সাহিত্যে আর দ্বিতীয় বই পাওয়া যাবে না যেটি এই বইটির মত পাঠক পেয়েছে। কোটি কোটি মানুষের নিয়তিতে বইটি প্রভাব বিস্তার করেছে। ১৯০৫ সালে প্রথম রুশ বিপ্লবের সময় বইটি লেখা হয়েছিল, আমার জানা মত আজো পৃথিবীর নানা দেশের পাঠকের কাছে এটি প্রিয় বই। পৃথিবীর নানা ভাষা আর সোভিয়েত ইউনিয়নের নানা ভাষায় কোটি কোটি সংখ্যায় বইটি ছাপা হয়েছিল। বইটির প্রধান দুটি চরিত্র পাভেল ও তার মা। বইটির লেখক গোর্কি ব্যক্তিগত জীবনে বইটি লেখার আগে পর্যন্ত চব্বিশ বছর বয়স অব্দি বহু বিচিত্র জীবন্ত সব অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছেন, দুঃখ ও দুর্গতির চরমতম নিষ্ঠুর অভিজ্ঞতা তিনি লাভ করেছেন। জীবনকে খুব বেশি সামনা থেকে দেখেছেন। তাই বুঝি উপন্যাসটির সৃষ্টিতে কোথাও কষ্টকল্পনা নেই, চরিত্র, ঘটনা পরম্পরা জীবন্ত। সততা আর নিষ্ঠা নিয়ে চিরকালীন মহাকাব্যিক এক অনবদ্য উপস্থাপনা। অষ্টম শ্রেণীতে পড়ার সময় প্রথমবার পড়েছি। তারপর বারবার বহুবার পড়েছি। প্রতিবারই একটা বুকচাপা কষ্ট পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে বুক থেকে দলা পাঁকিয়ে গলায় এসে শ্বাস রুদ্ধ করেছে। আর দু' চোখে ঝরেছে অঝোর ধারে জল। তাই এটি আমার প্রিয় ও স্মরণীয় অনুবাদ সাহিত্য। পাভেলের মায়ের মধ্যে শাশ্বত বিপ্লবী মাতাকে পেয়েছি, পুত্র যার বিপ্লব চেতনার স্রষ্টা।

দোসর পাবলিকেশনস্ - এর ওয়েব সাইট শুরু হলো ৫ জুলাই, তাতে প্রকাশিত হয়েছে আমার সাক্ষাৎকার।  লিংক দিলাম, পড়ুন :

http://doshor.com/?p=13014

SUNITI Debnath

আমি সুনীতি দেবনাথ, অবসরপ্রাপ্ত সরকারি শিক্ষিকা। কবিতা, প্রবন্ধ ও ছোটগল্প লিখি। কবিতা আমার প্রিয়ভূমি, শৈশব থেকেই হেঁটে চলেছি...

0 comments: