কিছু চুপকথার অন্তরালে
© সুনীতি দেবনাথ
প্রিয়তম কবি শুধু তুমি নও
সুরের ভুবনে ঘুম জাগানিয়া
বাংলার বুলবুল তুমি হে
ভালোবাসি আজো তাই!
লহো প্রণাম সুরসাথী —
নজরুলের গান আজো বাঙ্গালীর প্রাণে আন্দোলন তুলে, তুলবে বহুকাল। বাংলা সঙ্গীত জগতে নিশ্চিত দুটি প্রধান ধারা রবীন্দ্র সঙ্গীত আর নজরুল গীতি। রবীন্দ্রনাথ তাঁর সঙ্গীতে নিঃসন্দেহে আবহমান কাল আচ্ছন্ন করে রাখবেন আমাদের সত্তাকে। তিনি গুরুদেব, নমস্য। আর নজরুল? প্রথম জীবনে রবীন্দ্র সঙ্গীতে হাবুডুবু খেয়েও পৌঁছে গেলেন নিজের ভিন্ন সৃষ্টির ভুবনে। এই সৃষ্টি তাঁকে পৌঁছে দিল সঙ্গীতপিপাসু বাংলার আমজনতার দরবারে। সংখ্যাতত্ত্বের বিচারেও নজরুল রচনা সংখ্যায় রবীন্দ্রনাথকে ছাপিয়ে গেলো, অনেক হারিয়ে যাওয়া গান এখনো যদিও হারিয়েই আছে। সুরের মায়াজালে, কাব্যিক কথামালায় সঙ্গীতদেহ নির্মাণে আর শব্দ ব্যবহারের কুশলতায় বাংলা সঙ্গীত জগতে আজো নজরুল অনন্য। হর়ফ প্রকাশনী, কলকাতা প্রকাশিত, আবদুল আজীজ আল আমান সম্পাদিত ' নজরুল - গীতি অখণ্ড ' বইয়ের ভূমিকায় বলা হয়েছে, " রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে যে সংখ্যা নিঃশেষকর( বর্তমান গীতবিতানের সূচি অনুযায়ী রবীন্দ্রনাথের গানের সংখ্যা ২২১৯টি), নজরুলের ক্ষেত্রে তা পরিবর্তনশীল এবং ক্রমবর্ধমান। " তিনি বইয়ের পরিশিষ্টে নজরুল গানের সংখ্যা বলেছেন ২৮৭২ টি, আর আশা প্রকাশ করেছেন ' নিষ্ঠা এবং ধৈর্য সহকারে এগিয়ে গেলে ' আরো বহু সঙ্গীত পাওয়া যাবে। আমার আলোচ্য বিষয় সংখ্যাতত্ত্ব নয়, আলোচনা করতে চাই নজরুলের কিছু সংখ্যক গানের উৎস বিষয়ে এবং তর্কাতীতভাবে এসব গান আমার প্রিয়।
' কারার ঐ লৌহকপাট ...'.গানটি, এই সেই গান যা একদিন পরাধীন ভারতের হাজারো মুুক্তিকামী মানুষের মনে আগুন জ্বেলেছিলো, কারারুদ্ধ মানুষের দুঃসহ জীবনে হয়ে উঠেছিল অগ্নিশুদ্ধ ঋক্- মন্ত্র। বন্দীশালার নিরুদ্ধ প্রতিবাদ যেন প্রতিটি পংক্তির দ্যোতনা। সেই সংগ্রামকালে প্রতিটি সভা সমিতিতে এই গান না হলে কাজ অসম্পূর্ণ হয়েছে মনে করা হতো। কেউ কেউ ভাবেন কারারুদ্ধ অবস্থায় নজরুল গানটি রচনা করেন, কিন্তু তা ভুল। "আনন্দময়ীর আগমনে"রচনাটির জন্য নজরুলের জেল হয় ১৯২৩খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে, আর গানটি লেখা হয় ১৯২১খ্রিস্টাব্দে। সে সময় অসহযোগ আন্দোলন সুতীব্র হয়ে ওঠে, হাজারো জনতা হয় কারারুদ্ধ। শান্তিপূর্ণ অসহযোগ আন্দোলন হলেও মানুষের মনে আগুন জ্বলছে দাউদাউ,
রক্ত ফুুটছে টগবগ। এ সময় দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের পরিবারের সুকুমাররঞ্জন দাশ নজরুলের কাছে এসে দেশবন্ধুর পত্রিকা ' বাংলার কথা '-র জন্য কবিতা চান। দেশবন্ধু তখন জেলে, পত্রিকা সম্পাদনা করছেন তাঁর স্ত্রী বাসন্তী দেবী। বাসন্তী দেবীর স্নেহধন্য নজরুল, জনাব মুজফ্ফর আহমেদের ভাষায় "' বাংলার কথা ' - র জন্যে লেখা চাইতেই নজরুল লিখতে বসে গেলেন। অল্প ক্ষণের মধ্যেই লেখা সমাপ্ত হলো। " সেটি একটি রক্তঝরানো অগ্নিক্ষরা গান —" কারার ঐ লৌহকপাট ......"।আলি আকবর খান দ্বারা প্রভাবিত সদ্য কুমিল্লা ফেরৎ নজরুল এই গানটি লেখেন। এটি ' বাংলার কথা ' - য় প্রকাশিত হলো। পরে তাঁর 'ভাঙার গান ' কাব্য গ্রন্থে স্থান পায়।
" ওড়াও ওড়াও লাল নিশান!
দুলাও মোদের রক্ত পতাকা
ভরিয়া বাতাস জুড়ি বিমান
ওড়াও ওড়াও লাল নিশান।। ইত্যাদি
কবিবন্ধু জনাব মুজফ্ফর আহমেদের বক্তব্য এই বিখ্যাত গানটির উৎস কোন ইংরেজি গান। ' সাম্যবাদ ' রচনার সময় কবি শ্রমিক মজদুরদের নিয়ে কিছু কিছু লেখা বাংলায় তর্জমা করছিলেন, সে সময় তিনি কোন ইংরেজি কবিতার উৎস থেকে গানটি লিখে থাকবেন বলে অভিমত প্রকাশ করেন মুজফ্ফর সাব। গানটি ' রক্ত পতাকা ' নামে খ্যাত। এই রচনাটি প্রথম ' গণবাণী ' - তে ২৮ এপ্রিল, ১৯২৭ সালে প্রকাশিত হয় এবং পরে কবির ' ফণিমনসা ' কাব্যগ্রন্থে স্থান পায়।
' জাগরণী ' শীর্ষকএকটি গান কবির ' ভাঙার গান 'কাব্যগ্রন্থে সংকলিত। সারা দেশে অসহযোগ আন্দোলন ব্যাপক ও প্রবল রূপে যখন উত্তাল, সেসময় ইংল্যান্ডের প্রিন্স অফ ওয়েলস - এর আগমন বার্তা ঘোষিত হয় ২১নভেম্বর, ১৯২১ সালে। তাঁর এই আসা উপলক্ষে সারা দেশে হরতাল ঘোষিত হলো। কবি তখন ছোট্ট শহর কুমিল্লায়। এর আগে কুমিল্লাকে রক্তঝরা গানে তিনি মাতিয়ে দিয়েছেন। নেতৃস্থানীয় কিছু লোক কবিকে অনুরোধ করলেন মিছিলে গাইবার মতএকটা গান লিখে দেবার কথা। বললে কবি লেখেন এই গানটি —
ভিক্ষা দাও! ভিক্ষা দাও!
ফিরে চাও ওগো পুরবাসী,
সন্তান দ্বারে উপবাসী
দাও মানবতা ভিক্ষা দাও!
জাগোগো, জাগোগো
তন্দ্রা অলস জাগোগো
জাগোরে! জাগোরে!
সেসময় গানটিতে আরো কিছু অংশ ছিলো, পরে বাদ পড়ে। কেবল রচনা নয় সুরারোপ করে গলায় হারমোনিয়াম. ঝুলিয়ে মিছিলের সামনে থেকে নিজে তিনি গানটি করেন। সারা শহর হলো মাতোয়ারা আর ' লক্ষ্মীছাড়া দলের 'সভ্য হলো।
' চল চল চল ' কবির নিঃসন্দেহে বিখ্যাত গানগুলোর অন্যতম। কেউ কেউ এটি কলকাতার স্টুডেন্টস হলে ছাত্র ও যুব সম্মেলনের জন্য লেখা মনে করলেও তা ঠিক নয়। কাজী আবুল হোসেন প্রতিষ্ঠিত ঢাকার প্রথম বার্ষিক অনুষ্ঠানে কবি ' মুসলিম সাহিত্য সমাজ '- এ গেয়েছিলেন'খোস আহমেদ ' গান। ১৯২৮ সালে আমন্ত্রিত হয়ে কবি রক্তে দোল জাগানো মাতালকরা তরুণদের এই গানটি গাইলেন উদ্বোধনী সঙ্গীত হিসেবে।
চল চল চল!
ঊর্ধ্ব গগনে বাজে মাদল
নিম্নে উতলা ধরণীতল
অরুণ প্রাতের তরুণ দল
চলরে চলরে চল।
বুকে মাতাল করা এই গানটি 'মুসলিম সাহিত্য সমাজ ' - এর দ্বিতীয় সম্মেলন উপলক্ষে রচিত। গানটি ১৩৩৪সালের দ্বিতীয় বর্ষের কাজী মোতাহার হোসেন সম্পাদিত 'শিখা 'পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। আর ফাল্গুনের সওগাতে আত্মপ্রকাশ করেএবং কবির 'সন্ধ্যা ' কাব্যগ্রন্থে স্থান পায়। গৌরী কেদার ভট্টাচার্য ও সহশিল্পীদের দ্বারা গীত হয়ে এটি ৩১১৫৪সংখ্যায় রেকর্ডিং হয় এইচ. এম. ভি - তে।
এবার নজরুলের দু'চারটি গজলের উৎস সন্ধানের প্রচেষ্টা করা হবে। বাংলা ভাষায় গজল রচনায় কবির অবদান অনস্বীকার্য। বাংলা ভাষায় যে এতো মনোরম গজল সৃষ্টি করা যায় তা যেন আগে জানা ছিলো না। গজলের রচয়িতা নজরুলকে বাঙ্গালী মনেপ্রাণে ভালবেসেছে। নতুন এক প্রাণবন্যা প্রবাহিত করেন নজরুল, এ আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস।
নিশি ভোর হলো জাগিয়া, পরাণ পিয়া ....একটি অনবদ্য গজল নজরুলের। বারবার শুনেও আশ মেটেনা। এই গজলটির উৎস সন্ধানে নামলে একটি চমৎকার কাহিনী আর নজরুলবন্ধু নলিনীকান্ত সরকারের নাম উঠে আসে। প্রায়ই নজরুল এই প্রিয় বন্ধুর জেলেটোলা লেনের বাসায় গিয়ে নানা সব বিষয়ে কথা বলতেন। সে এক নিঝুম গ্রীষ্ম দুপুর। চারপাশ যেন ঝিমুচ্ছে। হঠাৎ হিন্দুস্থানী গজলের অপূর্ব সুরঝঙ্কারে সেই রুদ্র দিনের নিমগ্নতা কেঁপে উঠলো। একজন হিন্দুস্থানী পুরুষ আরএক নারীর মোহনীয় গানে প্রকৃতি যেন মাতাল হয়ে উঠেছে। বিমুগ্ধ নজরুলের আত্যন্তিক আবেদনে তাদের ডেকে আনতে হলো। একটার পর একটা গজল গাওয়া চললো নজরুলের আবেদনে। তিনি আত্মভোলা হয়ে শুনতে লাগলেন! তিনি চোখ বন্ধ করে তালে তালে তেহাই মারতে লাগলেন তক্তপোশে। বিশেষ প্রভাবিত কবি তাদের পিয়া পিয়া গানটির সুরে রচনা করে ফেললেন ' নিশি ভোর হলো জাগিয়া ' গজলটি। নলিনীকান্তের মতে এই প্রথম নজরুলের গজল রচনা। তথ্যগত সূত্রে এই মত বিশ্বাস্য নয়, কারণ এর আগেই বিখ্যাত কিছু সংখ্যক গজল নজরুল রচনা করে ফেলেছিলেন। অপরপক্ষে বুদ্ধদেব বসুুর অভিমত এই গজল নজরুল ঢাকায় থেকে রচনা করেন তাঁর সম্পাদিত 'প্রগতি ' সাহিত্যপত্রে১৩৩৪ সালের চৈত্র সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। গজলটি ' বুলবুল ' ও ' নজরুল - গীতিকা'- য় স্থান পায়! নং এন ১১৭৪৭ - এ আঙুরবালার কণ্ঠে গীত হয়ে রেকর্ডিং হয়।
নজরুলের অন্যতম বহুল প্রচলিত ও জনপ্রিয় গজল হচ্ছে ' বসিয়া বিজনে কেন একামনে......'। গজলটির রচনাকাাল ১৩৩৩ সাল, প্রকাশিত হয় চতুর্থ বর্ষ একাদশ সংখ্যা ' কল্লোল ' - এ। ( ফাল্গুন ১৩৩৩সালের প্রেক্ষিতে হবে ফেব্রুয়ারি ১৯২৭খ্রিস্টাব্দ )। গানটি কবির ' বুলবুল ' ও ' নজরুল - গীতিকা '- য় সংকলিত হয়। কে. মল্লিক গানটিতে কণ্ঠ দেন, এইচ. এম.ভি.রেকর্ড নং ১১৪৭১।
কৃষ্ণনগরে চাঁদ সড়কে বসবাসকালে একবার বন্ধুবান্ধব সহ কবি হাঁস শিকারে যান দূরবর্তী চাবড়ির বিলে। আদিগন্ত বিলের জলে সান্ধ্য সূর্যের রক্তিমাভা ছড়িয়ে লাল করেছে অথৈ জলরাশিকে।অভাবনীয় সৌন্দর্যের অভূতপূর্ব প্রকাশ,শিকার শেষে কবি নৌকোয় বসে বিমুগ্ধ! এই পটভূমিতে গ্রাম্য বধূরা জল নিতে কলসী কাঁখে! বাসায় ফিরে রাতেই লিখে ফেললেন অবিস্মরণীয় " বসিয়া বিজনে কেন একা মনে/ গাগরী ভরনে চললো গোরী।"
সেসময় উর্দু ভাষায় বহু গজল গান ইসলামী সঙ্গীতের রেকর্ডের বিশাল ভাণ্ডার থাকলেও বাংলা ভাষায় একটিও ইসলামী সঙ্গীতের রেকর্ড ছিলো না। এই বিষয়ে প্রথম উদ্যোগী হন আব্বাসউদ্দিন। আব্বাসউদ্দিনকে প্রচণ্ড লড়াই করতে হয় এইচ. এম .ভি. গ্রামোফোন কোম্পানীর সাথে। তাঁরা কোন ঝুঁকি নিতে চাইছিলেন না। অবশেষে নাছোড়বান্দা আব্বাসউদ্দিনের অনুরোধ তাঁরা মেনে নেন। যুগান্তকারী তথা নবযুগের সূচনাকারী ঘটনা ঘটলো। প্রথমদিকে নজরুল আব্বাস উদ্দিনের কথায় ইসলামী সঙ্গীত রচনায় তেমন উৎসাহ পাচ্ছিলেন না। কিন্তু আব্বাস উদ্দিন একদিন তাঁকে বললেন, " কাজিদা, একটা কথা মনে হয় এই যে পিয়ারু কাওয়াল, কাল্লু কাওয়াল এরা উর্দু কাওয়ালী গায়,এদের গানও শুনি অসম্ভব বিক্রী হয়,এই ধরনের বাংলায় ইসলামী গান দিলে হয় না?তারপর আপনি তো জানেন। কি ভাবে কাফের কুকুর ইত্যাদি বলে বাংলার মুসলমান সমাজের কাছে আপনাকে অপাংক্তেয় করে রাখার জন্যে আদা - জল খেয়ে লেগেছে একদল ধর্মান্ধ! আপনি যদি ইসলামী গান লিখেন তাহলে মুসলমানের ঘরে ঘরে আবার উঠবে আপনার জয়গান। " এবার নজরুল উদ্দীপ্ত হয়ে উঠলেন।
ইতিপূর্বে নজরুলের অনেকগুলি গান গেয়েছেন আব্বাস উদ্দিন, পেয়েছেন প্রভূত জনপ্রিয়তা। প্রথম ইসলামী যে সঙ্গীত নজরুল লিখলেন তা হলো " ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুুশীর ঈদ। "পরদিনই লিখলেন," ইসলামের ঐ সওদা লয়ে এলো নবীন সওদাগর।" দুটি গানই একদিনে রেকর্ডিং করলেন আব্বাস উদ্দিন।
পরবর্তী কথা সংক্ষেপে বলা যায় নজরুলের কথা আর আব্বাস উদ্দিনের কণ্ঠ তুমুল কাণ্ড ঘটালো। অল্প সময়েই মানুষের মুখে মুখে ফিরতে লাগলো এই দুটি ইসলামী সঙ্গীত। ইসলামী সঙ্গীত নজরুলের স্বকীয় প্রতিভার দান, আর তাঁর সৃষ্টির মধ্যমণি। দুইশোটির মতভিন্ন ভিন্ন প্রকারের ইসলামী সঙ্গীত তিনি সৃষ্টি করেছেন।
পরিশেষে স্মরণ করবো আবদুল আজীজ আল - আসমানের কথা, " ইসলামী সঙ্গীতগুলি আবার আন্তঃবিভাগ অনুযায়ী হামদ, নাত, মর্সিয়া,পর্ব - সংগীত, মুনাজাত, মুর্শেদী, দেহতত্ত্বমূলক সংগীত ইত্যাদি শ্রেণীতে বিভক্ত। এই সংগীতগুলিতে নানান রকম সুরের সমাবেশ দেখা যায়। প্রকৃতপক্ষে এই নতুন ধারার গানগুলির বাণী মধুর, সুরগুলি মধুরতর। সুরের মাদকতার জন্য এ গানগুলি চিরকাল বেঁচে থাকবে। " গীতিকার ও সুরকার নজরুল Versatile Genus, তাঁকে নিয়ে যথেষ্ট গবেষণা এখনো হয়নি। কিন্তু তার প্রয়োজন অত্যন্ত জরুরি।
0 comments: