সাক্ষাৎকার— সৈয়দ মহিউদ্দিন মাসুদ, সঞ্চালক, 'ছোট কবিতা ',বাংলাদেশ গৃহীত
প্রিয়
সঞ্চালক, ছোট কবিতা।
১) কবিতা কি? ভারি সুন্দর প্রশ্ন। সেই আদিকাল থেকে মানুষ কবিতা লিখছে, তবু আজো কি দু ' এক কথায় চট করে বলা যায় কবিতা কি? প্রাচ্য - পাশ্চাত্যের নন্দনতাত্ত্বিকেরা নানা সংজ্ঞায় এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পাতার পর পাতা লিখেছেন। আবার সমালোচনা - প্রতি সমালোচনায় বিতর্কের ঝড় তুলেছেন। ভারতবর্ষ, বাংলাদেশ, পৃথিবীর আলংকারিকেরা শাস্ত্রকারেরা —
অ্যারিস্টটল, হোরেস, আনন্দবর্ধন, অভিনব গুপ্ত আর পরবর্তীকালের আলোচনায় গড়ে উঠেছে পাশ্চাত্য ও প্রাচ্য নন্দনতত্ত্ব। আজো কিন্তু কবিতার সর্বসম্মতিক্রমে গ্রহণযোগ্য কোন সংজ্ঞা মেলেনি। আমার মনে হয় কবিতা যেন মানুষের সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি । আর সেই সৃষ্টি কাজে মানুষ তার আত্মা ও মননের সহায়তায় পৃথিবী ও তার সবকিছু সহ, সমাজ ও সামাজিক সংগঠন, মানুষ আর মানুষের পারস্পরিক সম্পর্কের মিথক্রিয়া , যাবতীয় পার্থিব বিষয় - আশয়, যাপিত জীবন, আরও বাড়িয়ে মহাবিশ্বের মহাঙ্গনের লীলাবৈচিত্র্য, প্রকৃতির অনুষঙ্গ সবকিছু থেকেই উপলব্ধ অনুভূতিকে ভাষা মাধ্যমে ছন্দে, অলঙ্কারে, শব্দ প্রয়োগের চাতুর্যে নান্দনিক যে সৃষ্টি করে সহজ ভাষায় তাকে কবিতা বলবো। কবিতা তো আত্মার স্ফুরিত স্পন্দন, অন্য কথায় আমি বলবো শ্রেষ্ঠ দর্শন।
আমি কবিতা লিখি আমার উপলব্ধির প্রকাশের আর্তিতে। না লিখে আমি পারি না। সবচেয়ে বড় কথা আমি জীবনকে ভালোবাসি, মানুষকে ভালোবাসি! যুগ যুগ ধরে বঞ্চিত নিপীড়িত মানুষের ভাষা করে তুলতে চাই আমার কবিতাকে। মানুষের প্রতি মুষ্টিমেয় সম্পদশালী ক্ষমতাবানের শোষণ নিপীড়নের প্রতিবাদ আমার কবিতা। আমার কবিতা নারীর মুক্তি ও অধিকারের সংগ্রামের কবিতা। সোজা কথায় কবিতা আমার সংগ্রামের হাতিয়ার! না লিখে পারবো কেন.?
ছোটবেলায় প্রকৃতি, মানুষের সংসার আর বইয়ের জগৎ আমাকে কবিতার দিকে টানে। প্রচুর বই পড়েছি — মাইকেল, রবীন্দ্রনাথ,শরৎচন্দ্র,বঙ্কিমচন্দ্র বেশ পড়েছি। পড়েছি উপেন্দ্রকিশোর, বিভূতিভূষণ এসব তো পড়েছি, পাশাপাশি গোয়েন্দা সিরিজ স্বপন কুমার, মোহন সিরিজ আরও কত কি। কবিতার জগতে নজরুল, সুকান্ত মনে দ্রোহের আগুন জ্বালালেন। জীবনের লড়াই কবিতায় প্রকাশ পেতে চাইলো! শৈশবের দিনগুলিতে কবিতার সঙ্গে মিতালি, ষষ্ঠ বা সপ্তম শ্রেণীতে পড়ার সময় প্রথম কবিতা লেখি! আজ আর মনে নেই ঠিক কবে কোন কবিতা দিয়ে শুরু।
ঠিক কখন কবিতা আসে বলা শক্ত। গভীর বেদনা, যন্ত্রণার মুহূর্তে, আবার কখনো আনন্দের উদ্দামতায়, একাকী সময়ে কবিতা আসে, কবিতা আমার মনের একান্ত তাগিদে, প্রকাশের আর্তিতে আসে। কখনো নিজেই আসে, না লিখে শান্তি পাইনা, স্বপ্নেও আসে। হ্যাঁ চাইলেই কবিতা লিখতে পারি, শুধু মনটাকে স্থির করে নিই। কিন্তু ফরমায়েসি কবিতা লিখতে মন বিদ্রোহ করে।
২)
জীবন বিবিক্ত কবিতা তো হতেই পারে না। জীবনকে ঘিরে জড়িয়ে স্বর্ণলতিকার মত কবিতা আপনাকে মেলে ধরে। জীবনই একমাত্র জীবনের আদর্শ, আর জীবনের স্বাধীনতাই কবিতা। হ্যাঁ জীবনের অনুষঙ্গে কবিতা জেগে ওঠে, পরমের ঠোঁটে কথা বলে — 'পরম ' কবির উপলব্ধি সঞ্জাত। কবিই তাঁর আত্মা আর মননের অনবদ্য রসায়নে 'পরম- ' এর সৃষ্টি করেন। কবির শ্রেষ্ঠ উপলব্ধি পরম। না কবিতাকে কবির আত্মকথন বা আত্মজীবনী মনে করি না। বরং কবির ভাবনায় জারিত যে উপলব্ধির আলোকিত উদ্ভাস তা যখনই ভাষায় প্রকাশ পায় তা বিশ্বজনীন হয়ে যায়।
জীবন আর কবিতা ঠিক সমান্তরাল চলে আমি ভাবি না।আমি মনে করি জীবনকে জড়িয়ে কবিতা চলে। ঐ বললাম না জীবনের স্বাধীনতা কবিতা।
৩)হ্যাঁ কবিতা শব্দের শিল্প। ভাষা মাধ্যমে কবিতার অবয়ব গড়ে ওঠে। কবিকে ভাষা, বিশেষ করে শব্দ বিষয়ে বিশেষ পারদর্শী হতে হবে। আর নয়তো শব্দ নিয়ে কুশলী কারুকাজে তিনি কিভাবে হিরন্ময় দ্যুতি সৃষ্টি করবেন? শব্দের আভিধানিক বা ব্যুৎপত্তিগত অর্থকে কবি ভেঙ্গেচুরে নান্দনিকতায় নতুন অভিধায় নিয়ে যান। যেমন ত্রিপুরার কবি দিলীপ দাসের কিছু উদ্ধৃতি বলছি।
মেঘের খেলা সব জলের উঠোনে
তার ছুটোছুটি, খুনশুটি,
তার গোল্লাছুট
সময় নেই, গময় নেই
সারাদিন খেলা
উদানে মাধানে —
দেখুন অতি সাধারণ ভাষায় কবি শব্দের মূল অভিধাকে কোন নান্দনিকতায় নিয়ে গেলেন। লক্ষ্য করি আরো কথ্য গ্রামীন শব্দের ব্যবহারে কবি কবিতায় ভিন্ন মাত্রা সৃষ্টি করলেন! আরেকটু শুনুন —
একটু আগে চাঁদের নৌকাডুবি হল
প্রথমে গলুই তারপর
দোয়েলপুুচ্ছ পাছা তলিয়ে গেল
গেল আর ভেসে উঠল না।
এমন কত চাঁদ রোজদিন তলিয়ে যায়।
সত্যিই এ যেন শব্দের যাদুমাত্রিকতা! আভিধানিক বা ব্যুৎপত্তিগত অর্থ ছাপিয়ে এখানে শব্দ হিরন্ময় দ্যুতি ছড়িয়ে ম্যাজিকেল টিউন বা মাত্রায় অর্থাৎ যাদু মাত্রিকতায় পৌঁছে গেলো।
৪) 'কবিতা আধুনিক ' আমার পড়া নেই। তাই প্রসঙ্গটা বাদ দিতে হচ্ছে। আধুনিক কবিতা সম্পর্কে ছোট করে বলছি।
মানুষের সভ্যতা, সংস্কৃতি, পারিপার্শ্বিক, যাপন প্রক্রিয়া নিত্য বদলায়। বদলায় তার ভাবনাচিন্তা, মনন, মানসিকতা। বদল ঘটে সমাজ আর ভাষা প্রবাহে। কবিতায়ও এই পরিবর্তনের ধাক্কা লাগে। বলাবাহুল্য বাংলা কবিতার ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে। প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যে কবিতার আধিপত্য। বলা হয় বাংলাসাহিত্যে আধুনিকতার জনক মাইকেল মধুসূদন দত্ত। বিষয়টি অস্বীকার করা যায় না। প্রাচীন আর মধ্যযুগের দৈববাদ নির্ভরতা থেকে যেদিন মানবের বিজয় বার্তা ঘোষিত হলো, সেদিন দেবতার স্বর্গ মহিমা মানুষের ধুলোর ধরণীর কাছে হেরে গেলো। মানববাদ আর ব্যক্তিস্বাতন্ত্রের বিজয় ঘোষণা আধুনিক কবিতার শ্রেষ্ঠ অবদান। রবীন্দ্রনাথ নিঃসন্দেহে বাংলাসাহিত্যে এযাবৎকাল শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব। বাংলা কবিতা নিয়ে তিনি বিশ্বজয়ী। রবীন্দ্রনাথে আধুনিক কবিতার সূত্রপাত কারও কারও অভিমত। আমি তা বিশ্বাস করি। তাঁর মুক্তক ছন্দের গদ্য কবিতা দিয়েই আধুনিক কবিতার পথিকৃৎ হয়েছেন তিনি । তিরিশের দশকে বাংলা কাব্যসাহিত্যে রবীন্দ্র -প্রভাব মুক্ত হয়ে আধুনিক কবিতা রচনার প্রয়াস লক্ষ্য করা যায়। কবি অমিয় চক্রবর্তী, বিষ্ণু দে, বুদ্ধদেব বসু, সুধীন্দ্র নাথ দত্ত বিশিষ্ট আধুনিক কবি। এছাড়া অচিন্ত্য কুমার সেনগুপ্ত প্রমুখ উল্লেখ্য। বিশিষ্ট কবি জীবনানন্দ দাশ এই আধুনিক কবিদের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বের অধিকারী। বলা চলে শ্রেষ্ঠ আধুনিক কবি। কারও কারও মতে জীবনানন্দ এখনো এশিয়া মহাদেশের শ্রেষ্ঠ আধুনিক কবি।
দুই দুইটি বিশ্বযুদ্ধ, মন্দা অর্থনীতি,যুদ্ধ সঞ্জাত অবক্ষয়িত সমাজব্যবস্থা, দুর্ভিক্ষ, ফরাসি বিপ্লবের প্রভাব, বিপ্লব পরবর্তী সমাজতান্ত্রিক রাশিয়ার অভ্যুত্থান, মার্ক্সীয় দর্শনের প্রভাব, বিজ্ঞান প্রযুক্তির অগ্রগতি, ফ্রয়েডীয় মনোবিজ্ঞান, ভারতের স্বাধীনতার আন্দোলন, ঔপনিবেশিক শাসকের রুদ্র রোষ, নতুন ধনিক গোষ্ঠীর অভ্যুত্থান, শিক্ষায় পাশ্চাত্য প্রভাব আরো নানা আন্তর্জাতিক ও দেশীয় কারণে আধুনিক কবিতার অগ্রগতি অনিবার্য হলো। এরপর স্বাধীনতা লাভ ও দেশবিভাগ গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে আধুনিক কবিতায়। কবিতার আঙ্গিক ও বিষয়ে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসে। বিরাট বিষয়, সংক্ষেপে আধুনিক কবিতা সম্পর্কে আলোচনা কঠিন, আমি ইঙ্গিত মাত্র দিলাম!
৫)ভাষাবোধ, মননশীলতা, মূল্যবোধ, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রশ্নে কবিতার শাশ্বত ভাবনার আধুনিক প্রকাশ আমার মতে অপরিসীম এবং আধুনিক কবিরা সচেতনভাবে কাব্য নির্মাণে সৎ ও নিষ্ঠাবান। সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে অবক্ষয়, বিপর্যস্ত অর্থনীতির কাঠামোতে, ধনতান্ত্রিক তথাকথিত উন্নত দেশগুলোর তৃতীয় বিশ্বের দরিদ্র, উন্নয়নশীল দেশের উপর আস্ফালন, খোলা অর্থনীতি তথা বাজারের বিষাক্ত ফলাফল আধুনিক কবিতায় রূপায়িত হচ্ছে, কবিরা সচেতন। বিষবৃক্ষের ফল আস্বাদন করে আমাদের সমাজের ভাঙ্গন ও অবক্ষয় কবিদের হতাশাগ্রস্ত করে, তার ছাপ দেখি আধুনিক কবিতায়। বিশ্বের উন্নত সাহিত্যের অনুবাদ বা মৌল রচনার প্রভাবও দুর্লক্ষ্য নয়। সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রভাব আধুনিক কবিতায় ব্যাপক।
৬)কবিতা নির্মাণে অখণ্ড বা বৈশ্বিক চেতনা আমার কবিতার মূল সুর। তথাকথিত রাজনৈতিক মানচিত্রের, ধর্মীয় গণ্ডির, জাতপাতের, নারী পুরুষের অধিকার ও ক্ষমতার বৈষম্যের, বর্ণ বৈষম্যের আর অর্থনৈতিক শ্রেণীবৈষম্যের গণ্ডি পেরিয়ে আমি চাই মহামানবের অখণ্ড সত্তার উত্থান বিশ্ব জুড়ে। ' জয় মহামানবের নব উত্থান '।
৭) ঈশ্বর, ধর্ম, প্রেমানুভূতি — ঈশ্বর আছেন কি নেই জানিনা, তথাকথিত ঈশ্বর চেতনা আমাকে জড়িয়ে নেই, আমি আপ্লুত নই। নজরুল বলেন, 'খেলিছ এ বিশ্ব লয়ে বিরাট শিশু '...... বেশ লাগে। সারা মহাবিশ্বকে কোন মহাশক্তি নিয়ন্ত্রণ করছে মনে হয়। তাই কি ঈশ্বর? জানিনা। আর ধর্ম? ধর্ম তো তা যা জীবনকে ধারণ করে, প্রচলিত আচার অনুষ্ঠান সর্বস্ব কোন ধর্মকে আমি মানি না। আমার কোন ধর্মীয় গোঁড়ামি নেই। তবে একটা কথা বলবো আমি পরমতসহিষ্ণু। এই প্রসঙ্গে আমার একটি কবিতা সংলগ্ন করছি :
আমি তোমাকে চাই না
===============
© সুনীতি দেবনাথ
জানুয়ারী ২৯/ ২০১৫
গরিমার উত্তুঙ্গ চূড়ায় বসে তর্জনী
উঁচিয়ে কি বলতে চাও ভাল জানি।
আর জানি বলেই তোমাকে চাইনা
আমার অন্দরে বাজে ঝড়ের মাদল,
তুমি বাজাও মগ্নতার সাপুড়ে বাঁশি,
ও সাপুড়িয়া তোমার সুর আমি চাই না।
তুমি এক স্বচ্ছ সরোবর শক্ত বাঁধনে
তিরতিরে জলের কাঁপন নিয়ে বসে।
চলিষ্ণুতা তোমার চরিত্রে নেই,
চলমান জগৎ তাবৎ বিশ্ব চরাচরকে
তুমি স্থবিরতায় বেঁধে স্বেচ্ছাচারী হও
আর আত্মগরিমায় হাসো খলখল।
আমি, আমার চৈতন্যের রঙ মশাল
জ্বালানো খেলা, আর আমাকে ধারন
করার ক্ষমতা তোমার কণামাত্র নেই।
তুমি জানো চলিষ্ণুতাই সৃষ্টির মৌল ধর্ম
সেই ধর্ম তোমার আছে কি?
আছে কি গতির সাথে মিলিঝুলি
করার চমকদার চাল চলতি?
সীমার বন্ধনে আমি যখন যন্ত্রণায়
জ্বলি বারবার একটিবারও কি তুমি
সীমানা অতিক্রম করে আমার হাত
তোমার হাতে ধরে বল আমি পাশে
ভয় পেয়োনা, আমি মুক্তির আলো?
অথচ বিশ্বজুড়ে চলছে বিবর্তনের স্রোত
অথচ এই যে পৃথিবী এরও তো বদল
হবার লীলাখেলা চলছে তো চলছে
তার মাঝে তুমি শাশ্বত অপরিবর্তনীয়!
যে সভ্যতা যে সমাজ সেই আদিকালে
গড়ে তুলেছিল মানুষ , গড়েছিল তোমাকে
আনত শিরে পরম শ্রদ্ধায়,
সেসব কিছুই বদলে বদলে আজ
আজকের মানুষ সভ্যতার অন্যলোকে,
চির বদলের যাত্রাবেলায় অপরিবর্তনীয়
শাশ্বত কেবল তুমি? তোমায় সৃষ্টি করেছে মানুষ,
মানুষের যা পরম ও চরম
তার গভীরতম প্রদেশের আহরিত
শ্রেষ্ঠতম সম্পদ — অপরিবর্তনশীল?
আমি তা মানতে নারাজ।
যুগ যুগের পথ হেঁটে মানুষ আহরণ করেছে
কত মণিমুক্তো সেসব তুচ্ছ?
যুগান্তরের পথে চলমানতার সমৃদ্ধ সম্পদ
সেও তুচ্ছ হয়ে গেলো?
আর স্বচ্ছ সরোবর তুমিই একমাত্র সত্য!
গতিহীন প্রাণহীন শেওলার জঞ্জালে
অচল অনড় অশ্রুত শৃঙ্খল ঝনঝন
আত্মাকে হননকারী মনুষ্যত্ব বিনাশী
আমি তোমাকে চাই না।
আমি চাই প্রাণবন্যায় চলমান,
গতির আবেগে বহমান
সমুদ্রাভিসারী নদীটি।
আর প্রেমানুভূতি সৃষ্টির সেরা অনুভূতি, যার উপর মানুষের, মানব সমাজের অগ্রগমন নির্ভরশীল। আমার বিশ্বাস পৃথিবীতে যত কবিতা রচিত হয়েছে, তার অধিকাংশই প্রেমানুভূতি নির্ভর। প্রেমানুভূতি নিয়ে আমি খুব কম কবিতা লিখেছি। আমার মনে হতো এবং হয় এ আমার একান্ত ব্যক্তিগত সম্পদ যা আমাকে আনন্দ দিয়েছে, তৃপ্তি দিয়েছে, চলার পথে পাশে থেকেছে। আমার জীবনের প্রথমভাগে 'প্রেম' নামে একটিই কবিতা লিখেছি, যা আমার কাব্যগ্রন্থ ' ঋদ্ধ সত্য অনুভবে আসে '-তে প্রকাশিত। আর আমার স্বামীর মৃত্যুর পর ' স্বগত সংলাপ ' নামে সংখ্যায়িত ত্রিশটি কবিতার একটা গুচ্ছ আছে। এইমাত্র।
আমার জীবনদর্শন? আমি বিশ্বাস করি যে জীবন পেয়েছি, তা একবারই মেলে। পৃথিবীর এই পথে আর কোনদিন হাঁটতে পাবো না। তাই পৃথিবীর প্রতিটি ধুলোকণা আমার প্রিয়। ' আমি পৃথিবীর কন্যা '.....বলে গর্বিত! আমার কবিতায় ঘুরে ফিরে এ চেতনা এসেছে! আর সবচেয়ে বড় বলে মানি ' মানুষ মানুষের জন্য. .....'। কবিতায় তাই বলতে চেয়েছি বারেবার।
৮)বাংলায় রচিত আর আমার পড়া এবং প্রিয় পাঁচটি কবিতা হচ্ছে :
(অ) আমি — রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর,
(আ) প্রিয়তমাসু— সুকান্ত ভট্টাচার্য,
(ই) বোধ — জীবনানন্দ দাশ,
(ঈ) যদি আর বাঁশী না বাজে —কাজী নজরুল ইসলাম,
(উ) হুলিয়া — নির্মলেন্দু গুণ।
৯)আমার লেখা কবিতার মধ্যে কোন কবিতা আমার সবচেয়ে প্রিয় বলাটা কঠিন। জানেন তো কবির কাছে তাঁর সব কবিতাই প্রিয়। তবু একটা বলতে হলে বলবো " মারিয়া কারোলিনা দে হেসুস "। নান্দনিকতা এ কবিতার কতটুকু জানিনা, শুধু জানি কবিতাটি আমাকে গভীরে নাড়া দেয়। আরেকটি কথা বলতেই হয়, দীর্ঘ কবিতা লিখতে আমি ভালোবাসি। আমার কবিতাটি দিচ্ছি।
মারিয়া কারোলিনা দে হেসুস
©সুনীতি দেবনাথ ২০১৪
----------------------------------------
নোংরা দুর্গন্ধমাখা আবর্জনার স্তুপ,
সেটাকে ঘিরে শকুনিরা কর্কশ চিৎকারে
আকাশটাকে করছিল ফালাফালা।
ওখানেই প্রাণের উদ্ভাসে জন্মেছিল শিশুটি-
অন্ধকারে সেই মানব শিশুটি গাঢ়তর অন্ধকারকে
উপভোগ করার জন্যই জন্মেছিল।
তাই প্রথম দু’চোখ মেলে যখন সে তাকালো-
প্রথম সে দৃষ্টিপাতে বোধের জগতে তোলপাড়
পৃথিবী এমনি হয় নোংরা পুঁতিগন্ধময়
আঁধার আকাশে মোড়া, হয়তো জেনে গিয়েছিল সে।
আহা! ফুলের মত পবিত্র শিশুটি –
ব্রাজিলের সেই সিণ্ডেরেলা বিশ্বের বিস্ময়কর পণ্যদ্রব্য!
প্রথম চোখ মেলে তাকালেন
মারিয়া কারোলিনা দে হেসুস!
শকুনির ভীড়ে এক স্পন্দিত জীবন!
তারপর দিন গেল রাত গেল ক্রমাগত এলোগেলো।
কিভাবে দিন রাতের পারাপার হল-
খবর জানেনা কেউ,খবর রাখেনি কেউ,
ব্রাজিলের লাখো শিশুর দিন রাত এমনিই ছিল।
তবে সবাই জানে অনেক দুঃখ বেদনার পথ হেঁটে
মারিয়া আরও গভীর প্রাপ্তির জন্য
আরও কঠোর শ্রমদানের জন্য বেঁচে চললেন,
বেড়েও উঠলেন,মারিয়া একদিন যুবতী হলেন।
একদিন এক পুরুষের সাথে তাঁর ভালবাসাবাসি হল
সন্তানের জন্ম দিয়ে মারিয়া জননীও হলেন-
অবিরত শ্রম আর দুঃখের সহবাসে তিনি এক নারীও হলেন।
সারাটা দিন কাজ আর কাজ চলমান এক কাজের চাকা
সারাটা রাত নিবিড় নিখাদ দুঃখের বুননে কালো
এরি মাঝে বেঁচে থাকে ব্রাজিলের অগুন্তি নারী-
মারিয়াও বেঁচে ছিলেন, বাঁচার ফাঁকে ফাঁকে আঁকাবাঁকা ছাঁদে
অক্ষরে অক্ষরে যন্ত্রণাদগ্ধ মনের কথাগুলি
দিনলিপির পাতায় পাতায় উপুড় করে ঢেলে দিয়েছিলেন,
কালো পৃথিবীর নারীর বেদনায় উপলব্ধ কোমল- গান্ধার!
একদিন এক আকস্মিক ক্ষণে এক সাংবাদিক
পেলেন সেই দিনলিপি পড়লেন বিমুগ্ধ হলেন
বুঝে গেলেন এ নারীর গহন মনের খনি পূর্ণ কালো সোনায়।
‘কুয়ারতো দে দেসপেহো’ – ‘চাইল্ড অফ দি ডার্ক’
১৯৬২ সালে প্রকাশিত হল, আর থামা নেই
ব্রাজিলের আস্তাকুঁড়- কন্যা হলেন লেখিকা।
সারা দুনিয়া তাজ্জব একী অপরূপ সৃষ্টির সম্ভার!
জীবনের টাটকা গন্ধমাখা, বিলাসী বিদগ্ধ জীবন নয়,
‘লা ফাবেলা’- ‘ঝুপড়ি’-র বাস্তব জান্তব জীবন আর
‘সাওপাওলোর নোংরা বস্তির পাঁচ বছরের ডায়েরি’ –
কষ্টকল্পিত কৃত্রিম সৃষ্টির আবর্জনা মাত্র নয়,
দেখে দুইচোখে অনুভবে জেনে সত্যি বেঁচে থেকে
শাশ্বত মানুষের সাহিত্যে নিচে থাকা ধুঁকে ধুঁকে বাঁচা
অগনিত মানুষের অতলান্ত বেদনার অফুরান কথামালা-
চমকে উঠল তথাকথিত আঁতেল শিল্পের সমঝদারগণ।
আস্তাকুঁড় থেকে বস্তি – বিদগ্ধসমাজ বেমানান
এ এক অলৌকিক জাদুকরের যেন জাদুকাঠির ভেল্কিবাজি!
রাতারাতি পৃথিবীর চল্লিশটা দেশের মানুষ
মারিয়া কারোলিনার বিচিত্র কথামালার বিমুগ্ধ পাঠক
উলট- পালট এই উত্থানে তেরটি ভাষায় অনুবাদও হল
জীবনের সত্য অভিজ্ঞতার চরম পরম বেদনার্ত উচ্চারণ!
এবার পরিভ্রমণ বিশ্বজোড়া মহাযাত্রা
সিণ্ডেরেলার পণ্য হবার চটকদার জীবন।
পৃথিবীর অসংখ্য পথে মাত্র ক’বছরের আশ্চর্য্য ভ্রমণ
সম্বর্ধনা সাক্ষাতকারের হুল্লোড় ফ্ল্যাশের জ্বলে ওঠা নেভা
ক্লিক্ ক্লিক্ কত, নোংরাঘাটা হাত দু’টি তাঁর
নন্দিত হল বন্দিত হল অভিনন্দন আর পুরস্কারে।
সম্ভ্রান্ত ভদ্রমহোদয়গণ আমন্ত্রণ ভোজে সঙ্গী পেয়ে
ধন্য হলেন, বলা কি সঠিক নয় ধন্য করলেন?
তাবড় তাবড় রাষ্ট্রনায়কগণ বিশ্বের দিলেন অভ্যর্থনা-
অভিনন্দনে আস্তাকুঁড়ের মারিয়া নন্দনকানন বাসিনী।
বিশ্বদরবারে খ্যাতির শীর্ষে তখন মারিয়া কারোলিনা দে হেসুস।
‘মনুষ্য শরীরে ডিনামাইট হল ক্ষুধা’-
‘এল আমব্রে এস লা দিনামিতা দেল কুয়ের পো উমানো’ –
ক্ষুধার এমন আগুনজ্বলা জ্বালাময়ী ধ্রুব উচ্চারণ
কোনও কবি বা লেখক কোনদিনই কি করেছিলেন ?
কোনও ক্ষুধার্ত মানুষও তার জীবনের স্পষ্ট সত্যকে এমনি
উচ্চারিত হতে শোনেনি কোনদিন- অনবদ্য গ্রন্থের অভিনব কথা!
১৯৭৭সালের শুরুতে বিষণ্ণ রোববারের এক ধোঁয়াটে সকাল
দিনের সূর্য তখনো পুব আকাশে নরম লাল আলো ছিটোনো শুরু করেনি
সেদিনও এক আস্তাকুঁড় ঘিরে পালে পালে শকুনি ডানা ঝাপটাচ্ছিল
উল্লসিত কর্কশ এক বীভৎস কোরাসে তারা-
নোংরা ডাস্টবিন ঘিরে প্রমত্ত ওড়াওড়ি
এই আবহে মরে পড়েছিলেন এক ব্রাজিলিয়ান নারী
ওদেশের হাজার হাজার অতি সাধারণ নারীর মতন।
তিনি এক অনবদ্য সার্থক নারী অন্যের উচ্ছিষ্ট খুঁটে যিনি
ঘোষণা করেছিলেন অমোঘ সত্য-
তুচ্ছতার ঘেরাটোপে থেকেও তাঁর উঁচু মাথা ছুঁয়েছিল আকাশের উচ্চতা,
সৃষ্টির নিত্য সত্যাকাশে আলোর বিভাসে ধ্রুবতারার মতই
প্রতিষ্ঠা পাবার অধিকারী তিনি মারিয়া কারোলিনা দে হেসুস!
জীবনের ক্ষুদ্রতম খণ্ড অবসরে সমাদৃতা হবার কালেও
মহার্ঘ ভোজসভায় আপ্যায়ন কালেও স্বপ্নেরা তাঁর-
শ্রমদানকালে প্রতিদিন প্রতিটা দিন মেশিনের ঘাতক চাকায়
পিষ্ঠ হয়ে গড়পড়তা শত শ্রমিকের আহত-নিহত হওয়া,
আর জন্মলগ্ন থেকেই সার সার বোবা স্তব্ধ দৃষ্টির ভিখিরি শিশু
এসব কিছুকে ঘিরে থাকা হিংস্র শকুনির ভয়াল চক্কর,
আতঙ্কিত স্বপ্নদের নিয়ে সুখ যাত্রায় কান্নার লহর বয়ে যেতো তাঁর।
নির্যাতিত ব্রাজিলের নির্যাতিতা নারী নির্যাতিত জীবনের ভাষ্যকার
শোষিতের একেবারে কাছে থেকে শোষিত জীবনে থেকে
কোনও একদিন হয়তো মুক্তি আসবেই স্বপ্ন দেখেছিলেন স্পষ্ট,
স্বপ্নদ্রষ্টা সেই নারী সকলকে স্বপ্ন দেখিয়ে আস্তাকুঁড়েই মরে গেলেন।
আজ কোন মুগ্ধ পাঠক বা স্তাবক পুষ্পগুচ্ছ হাতে এলোনা-
আজ প্রগাঢ় সন্তাপে কোন বিষাদ- মেদুর বিদায়ী ভায়োলিন বাজলোনা।
১০) আমার দুটি ইচ্ছে পূর্ণ করা হলে আমার প্রথম ইচ্ছে হবে — পৃথিবীর সকল শ্রেষ্ঠ দ্রোহের কবিতার নিপুণ বঙ্গানুবাদ আমি পড়তে চাইবো। আমার স্বপ্নের পৃথিবী ও শোষণমুক্ত মানব সমাজ গড়ে উঠুক — এটা আমার দ্বিতীয় ইচ্ছে।
নমস্কার ও শুভকামনা সবাইকে!
Suniti Debnath,
Kajori, Netaji Road,
P.O. - Dharmanagar,
North Tripura District,
State -Tripura.
Pin— 799250
দিদি!
প্রিয় কবি,
অনেক ধন্যবাদ মূল্যবান সময় থেকে সময় করে ছোট কবিতার সাক্ষাৎকারে সাড়া দেবার জন্য।
আশাকরি, এইসব সাধারণ প্রশ্নগুলির বিপরীতে কবির ভাবনা, অভিজ্ঞতা, পাঠ ও নান্দনিক দৃষ্টিভঙ্গির কথনে যারা নূতন লিখিয়ে তাদের জন্য অনেক উপকারে আসবে, কবি ও কবিতা সম্পর্কে একটা সুন্দর ধারণা পাবে, তাদের কবিতাচর্চার পথে আলো পাবে।
কবির সার্বিক মঙ্গল কামনায়,
সৈয়দ মহিউদ্দিন মাসুম
ছোট কবিতা
সঞ্চালক, ছোট কবিতা।
১) কবিতা কি? ভারি সুন্দর প্রশ্ন। সেই আদিকাল থেকে মানুষ কবিতা লিখছে, তবু আজো কি দু ' এক কথায় চট করে বলা যায় কবিতা কি? প্রাচ্য - পাশ্চাত্যের নন্দনতাত্ত্বিকেরা নানা সংজ্ঞায় এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পাতার পর পাতা লিখেছেন। আবার সমালোচনা - প্রতি সমালোচনায় বিতর্কের ঝড় তুলেছেন। ভারতবর্ষ, বাংলাদেশ, পৃথিবীর আলংকারিকেরা শাস্ত্রকারেরা —
অ্যারিস্টটল, হোরেস, আনন্দবর্ধন, অভিনব গুপ্ত আর পরবর্তীকালের আলোচনায় গড়ে উঠেছে পাশ্চাত্য ও প্রাচ্য নন্দনতত্ত্ব। আজো কিন্তু কবিতার সর্বসম্মতিক্রমে গ্রহণযোগ্য কোন সংজ্ঞা মেলেনি। আমার মনে হয় কবিতা যেন মানুষের সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি । আর সেই সৃষ্টি কাজে মানুষ তার আত্মা ও মননের সহায়তায় পৃথিবী ও তার সবকিছু সহ, সমাজ ও সামাজিক সংগঠন, মানুষ আর মানুষের পারস্পরিক সম্পর্কের মিথক্রিয়া , যাবতীয় পার্থিব বিষয় - আশয়, যাপিত জীবন, আরও বাড়িয়ে মহাবিশ্বের মহাঙ্গনের লীলাবৈচিত্র্য, প্রকৃতির অনুষঙ্গ সবকিছু থেকেই উপলব্ধ অনুভূতিকে ভাষা মাধ্যমে ছন্দে, অলঙ্কারে, শব্দ প্রয়োগের চাতুর্যে নান্দনিক যে সৃষ্টি করে সহজ ভাষায় তাকে কবিতা বলবো। কবিতা তো আত্মার স্ফুরিত স্পন্দন, অন্য কথায় আমি বলবো শ্রেষ্ঠ দর্শন।
আমি কবিতা লিখি আমার উপলব্ধির প্রকাশের আর্তিতে। না লিখে আমি পারি না। সবচেয়ে বড় কথা আমি জীবনকে ভালোবাসি, মানুষকে ভালোবাসি! যুগ যুগ ধরে বঞ্চিত নিপীড়িত মানুষের ভাষা করে তুলতে চাই আমার কবিতাকে। মানুষের প্রতি মুষ্টিমেয় সম্পদশালী ক্ষমতাবানের শোষণ নিপীড়নের প্রতিবাদ আমার কবিতা। আমার কবিতা নারীর মুক্তি ও অধিকারের সংগ্রামের কবিতা। সোজা কথায় কবিতা আমার সংগ্রামের হাতিয়ার! না লিখে পারবো কেন.?
ছোটবেলায় প্রকৃতি, মানুষের সংসার আর বইয়ের জগৎ আমাকে কবিতার দিকে টানে। প্রচুর বই পড়েছি — মাইকেল, রবীন্দ্রনাথ,শরৎচন্দ্র,বঙ্কিমচন্দ্র বেশ পড়েছি। পড়েছি উপেন্দ্রকিশোর, বিভূতিভূষণ এসব তো পড়েছি, পাশাপাশি গোয়েন্দা সিরিজ স্বপন কুমার, মোহন সিরিজ আরও কত কি। কবিতার জগতে নজরুল, সুকান্ত মনে দ্রোহের আগুন জ্বালালেন। জীবনের লড়াই কবিতায় প্রকাশ পেতে চাইলো! শৈশবের দিনগুলিতে কবিতার সঙ্গে মিতালি, ষষ্ঠ বা সপ্তম শ্রেণীতে পড়ার সময় প্রথম কবিতা লেখি! আজ আর মনে নেই ঠিক কবে কোন কবিতা দিয়ে শুরু।
ঠিক কখন কবিতা আসে বলা শক্ত। গভীর বেদনা, যন্ত্রণার মুহূর্তে, আবার কখনো আনন্দের উদ্দামতায়, একাকী সময়ে কবিতা আসে, কবিতা আমার মনের একান্ত তাগিদে, প্রকাশের আর্তিতে আসে। কখনো নিজেই আসে, না লিখে শান্তি পাইনা, স্বপ্নেও আসে। হ্যাঁ চাইলেই কবিতা লিখতে পারি, শুধু মনটাকে স্থির করে নিই। কিন্তু ফরমায়েসি কবিতা লিখতে মন বিদ্রোহ করে।
২)
জীবন বিবিক্ত কবিতা তো হতেই পারে না। জীবনকে ঘিরে জড়িয়ে স্বর্ণলতিকার মত কবিতা আপনাকে মেলে ধরে। জীবনই একমাত্র জীবনের আদর্শ, আর জীবনের স্বাধীনতাই কবিতা। হ্যাঁ জীবনের অনুষঙ্গে কবিতা জেগে ওঠে, পরমের ঠোঁটে কথা বলে — 'পরম ' কবির উপলব্ধি সঞ্জাত। কবিই তাঁর আত্মা আর মননের অনবদ্য রসায়নে 'পরম- ' এর সৃষ্টি করেন। কবির শ্রেষ্ঠ উপলব্ধি পরম। না কবিতাকে কবির আত্মকথন বা আত্মজীবনী মনে করি না। বরং কবির ভাবনায় জারিত যে উপলব্ধির আলোকিত উদ্ভাস তা যখনই ভাষায় প্রকাশ পায় তা বিশ্বজনীন হয়ে যায়।
জীবন আর কবিতা ঠিক সমান্তরাল চলে আমি ভাবি না।আমি মনে করি জীবনকে জড়িয়ে কবিতা চলে। ঐ বললাম না জীবনের স্বাধীনতা কবিতা।
৩)হ্যাঁ কবিতা শব্দের শিল্প। ভাষা মাধ্যমে কবিতার অবয়ব গড়ে ওঠে। কবিকে ভাষা, বিশেষ করে শব্দ বিষয়ে বিশেষ পারদর্শী হতে হবে। আর নয়তো শব্দ নিয়ে কুশলী কারুকাজে তিনি কিভাবে হিরন্ময় দ্যুতি সৃষ্টি করবেন? শব্দের আভিধানিক বা ব্যুৎপত্তিগত অর্থকে কবি ভেঙ্গেচুরে নান্দনিকতায় নতুন অভিধায় নিয়ে যান। যেমন ত্রিপুরার কবি দিলীপ দাসের কিছু উদ্ধৃতি বলছি।
মেঘের খেলা সব জলের উঠোনে
তার ছুটোছুটি, খুনশুটি,
তার গোল্লাছুট
সময় নেই, গময় নেই
সারাদিন খেলা
উদানে মাধানে —
দেখুন অতি সাধারণ ভাষায় কবি শব্দের মূল অভিধাকে কোন নান্দনিকতায় নিয়ে গেলেন। লক্ষ্য করি আরো কথ্য গ্রামীন শব্দের ব্যবহারে কবি কবিতায় ভিন্ন মাত্রা সৃষ্টি করলেন! আরেকটু শুনুন —
একটু আগে চাঁদের নৌকাডুবি হল
প্রথমে গলুই তারপর
দোয়েলপুুচ্ছ পাছা তলিয়ে গেল
গেল আর ভেসে উঠল না।
এমন কত চাঁদ রোজদিন তলিয়ে যায়।
সত্যিই এ যেন শব্দের যাদুমাত্রিকতা! আভিধানিক বা ব্যুৎপত্তিগত অর্থ ছাপিয়ে এখানে শব্দ হিরন্ময় দ্যুতি ছড়িয়ে ম্যাজিকেল টিউন বা মাত্রায় অর্থাৎ যাদু মাত্রিকতায় পৌঁছে গেলো।
৪) 'কবিতা আধুনিক ' আমার পড়া নেই। তাই প্রসঙ্গটা বাদ দিতে হচ্ছে। আধুনিক কবিতা সম্পর্কে ছোট করে বলছি।
মানুষের সভ্যতা, সংস্কৃতি, পারিপার্শ্বিক, যাপন প্রক্রিয়া নিত্য বদলায়। বদলায় তার ভাবনাচিন্তা, মনন, মানসিকতা। বদল ঘটে সমাজ আর ভাষা প্রবাহে। কবিতায়ও এই পরিবর্তনের ধাক্কা লাগে। বলাবাহুল্য বাংলা কবিতার ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে। প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যে কবিতার আধিপত্য। বলা হয় বাংলাসাহিত্যে আধুনিকতার জনক মাইকেল মধুসূদন দত্ত। বিষয়টি অস্বীকার করা যায় না। প্রাচীন আর মধ্যযুগের দৈববাদ নির্ভরতা থেকে যেদিন মানবের বিজয় বার্তা ঘোষিত হলো, সেদিন দেবতার স্বর্গ মহিমা মানুষের ধুলোর ধরণীর কাছে হেরে গেলো। মানববাদ আর ব্যক্তিস্বাতন্ত্রের বিজয় ঘোষণা আধুনিক কবিতার শ্রেষ্ঠ অবদান। রবীন্দ্রনাথ নিঃসন্দেহে বাংলাসাহিত্যে এযাবৎকাল শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব। বাংলা কবিতা নিয়ে তিনি বিশ্বজয়ী। রবীন্দ্রনাথে আধুনিক কবিতার সূত্রপাত কারও কারও অভিমত। আমি তা বিশ্বাস করি। তাঁর মুক্তক ছন্দের গদ্য কবিতা দিয়েই আধুনিক কবিতার পথিকৃৎ হয়েছেন তিনি । তিরিশের দশকে বাংলা কাব্যসাহিত্যে রবীন্দ্র -প্রভাব মুক্ত হয়ে আধুনিক কবিতা রচনার প্রয়াস লক্ষ্য করা যায়। কবি অমিয় চক্রবর্তী, বিষ্ণু দে, বুদ্ধদেব বসু, সুধীন্দ্র নাথ দত্ত বিশিষ্ট আধুনিক কবি। এছাড়া অচিন্ত্য কুমার সেনগুপ্ত প্রমুখ উল্লেখ্য। বিশিষ্ট কবি জীবনানন্দ দাশ এই আধুনিক কবিদের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বের অধিকারী। বলা চলে শ্রেষ্ঠ আধুনিক কবি। কারও কারও মতে জীবনানন্দ এখনো এশিয়া মহাদেশের শ্রেষ্ঠ আধুনিক কবি।
দুই দুইটি বিশ্বযুদ্ধ, মন্দা অর্থনীতি,যুদ্ধ সঞ্জাত অবক্ষয়িত সমাজব্যবস্থা, দুর্ভিক্ষ, ফরাসি বিপ্লবের প্রভাব, বিপ্লব পরবর্তী সমাজতান্ত্রিক রাশিয়ার অভ্যুত্থান, মার্ক্সীয় দর্শনের প্রভাব, বিজ্ঞান প্রযুক্তির অগ্রগতি, ফ্রয়েডীয় মনোবিজ্ঞান, ভারতের স্বাধীনতার আন্দোলন, ঔপনিবেশিক শাসকের রুদ্র রোষ, নতুন ধনিক গোষ্ঠীর অভ্যুত্থান, শিক্ষায় পাশ্চাত্য প্রভাব আরো নানা আন্তর্জাতিক ও দেশীয় কারণে আধুনিক কবিতার অগ্রগতি অনিবার্য হলো। এরপর স্বাধীনতা লাভ ও দেশবিভাগ গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে আধুনিক কবিতায়। কবিতার আঙ্গিক ও বিষয়ে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসে। বিরাট বিষয়, সংক্ষেপে আধুনিক কবিতা সম্পর্কে আলোচনা কঠিন, আমি ইঙ্গিত মাত্র দিলাম!
৫)ভাষাবোধ, মননশীলতা, মূল্যবোধ, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রশ্নে কবিতার শাশ্বত ভাবনার আধুনিক প্রকাশ আমার মতে অপরিসীম এবং আধুনিক কবিরা সচেতনভাবে কাব্য নির্মাণে সৎ ও নিষ্ঠাবান। সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে অবক্ষয়, বিপর্যস্ত অর্থনীতির কাঠামোতে, ধনতান্ত্রিক তথাকথিত উন্নত দেশগুলোর তৃতীয় বিশ্বের দরিদ্র, উন্নয়নশীল দেশের উপর আস্ফালন, খোলা অর্থনীতি তথা বাজারের বিষাক্ত ফলাফল আধুনিক কবিতায় রূপায়িত হচ্ছে, কবিরা সচেতন। বিষবৃক্ষের ফল আস্বাদন করে আমাদের সমাজের ভাঙ্গন ও অবক্ষয় কবিদের হতাশাগ্রস্ত করে, তার ছাপ দেখি আধুনিক কবিতায়। বিশ্বের উন্নত সাহিত্যের অনুবাদ বা মৌল রচনার প্রভাবও দুর্লক্ষ্য নয়। সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রভাব আধুনিক কবিতায় ব্যাপক।
৬)কবিতা নির্মাণে অখণ্ড বা বৈশ্বিক চেতনা আমার কবিতার মূল সুর। তথাকথিত রাজনৈতিক মানচিত্রের, ধর্মীয় গণ্ডির, জাতপাতের, নারী পুরুষের অধিকার ও ক্ষমতার বৈষম্যের, বর্ণ বৈষম্যের আর অর্থনৈতিক শ্রেণীবৈষম্যের গণ্ডি পেরিয়ে আমি চাই মহামানবের অখণ্ড সত্তার উত্থান বিশ্ব জুড়ে। ' জয় মহামানবের নব উত্থান '।
৭) ঈশ্বর, ধর্ম, প্রেমানুভূতি — ঈশ্বর আছেন কি নেই জানিনা, তথাকথিত ঈশ্বর চেতনা আমাকে জড়িয়ে নেই, আমি আপ্লুত নই। নজরুল বলেন, 'খেলিছ এ বিশ্ব লয়ে বিরাট শিশু '...... বেশ লাগে। সারা মহাবিশ্বকে কোন মহাশক্তি নিয়ন্ত্রণ করছে মনে হয়। তাই কি ঈশ্বর? জানিনা। আর ধর্ম? ধর্ম তো তা যা জীবনকে ধারণ করে, প্রচলিত আচার অনুষ্ঠান সর্বস্ব কোন ধর্মকে আমি মানি না। আমার কোন ধর্মীয় গোঁড়ামি নেই। তবে একটা কথা বলবো আমি পরমতসহিষ্ণু। এই প্রসঙ্গে আমার একটি কবিতা সংলগ্ন করছি :
আমি তোমাকে চাই না
===============
© সুনীতি দেবনাথ
জানুয়ারী ২৯/ ২০১৫
গরিমার উত্তুঙ্গ চূড়ায় বসে তর্জনী
উঁচিয়ে কি বলতে চাও ভাল জানি।
আর জানি বলেই তোমাকে চাইনা
আমার অন্দরে বাজে ঝড়ের মাদল,
তুমি বাজাও মগ্নতার সাপুড়ে বাঁশি,
ও সাপুড়িয়া তোমার সুর আমি চাই না।
তুমি এক স্বচ্ছ সরোবর শক্ত বাঁধনে
তিরতিরে জলের কাঁপন নিয়ে বসে।
চলিষ্ণুতা তোমার চরিত্রে নেই,
চলমান জগৎ তাবৎ বিশ্ব চরাচরকে
তুমি স্থবিরতায় বেঁধে স্বেচ্ছাচারী হও
আর আত্মগরিমায় হাসো খলখল।
আমি, আমার চৈতন্যের রঙ মশাল
জ্বালানো খেলা, আর আমাকে ধারন
করার ক্ষমতা তোমার কণামাত্র নেই।
তুমি জানো চলিষ্ণুতাই সৃষ্টির মৌল ধর্ম
সেই ধর্ম তোমার আছে কি?
আছে কি গতির সাথে মিলিঝুলি
করার চমকদার চাল চলতি?
সীমার বন্ধনে আমি যখন যন্ত্রণায়
জ্বলি বারবার একটিবারও কি তুমি
সীমানা অতিক্রম করে আমার হাত
তোমার হাতে ধরে বল আমি পাশে
ভয় পেয়োনা, আমি মুক্তির আলো?
অথচ বিশ্বজুড়ে চলছে বিবর্তনের স্রোত
অথচ এই যে পৃথিবী এরও তো বদল
হবার লীলাখেলা চলছে তো চলছে
তার মাঝে তুমি শাশ্বত অপরিবর্তনীয়!
যে সভ্যতা যে সমাজ সেই আদিকালে
গড়ে তুলেছিল মানুষ , গড়েছিল তোমাকে
আনত শিরে পরম শ্রদ্ধায়,
সেসব কিছুই বদলে বদলে আজ
আজকের মানুষ সভ্যতার অন্যলোকে,
চির বদলের যাত্রাবেলায় অপরিবর্তনীয়
শাশ্বত কেবল তুমি? তোমায় সৃষ্টি করেছে মানুষ,
মানুষের যা পরম ও চরম
তার গভীরতম প্রদেশের আহরিত
শ্রেষ্ঠতম সম্পদ — অপরিবর্তনশীল?
আমি তা মানতে নারাজ।
যুগ যুগের পথ হেঁটে মানুষ আহরণ করেছে
কত মণিমুক্তো সেসব তুচ্ছ?
যুগান্তরের পথে চলমানতার সমৃদ্ধ সম্পদ
সেও তুচ্ছ হয়ে গেলো?
আর স্বচ্ছ সরোবর তুমিই একমাত্র সত্য!
গতিহীন প্রাণহীন শেওলার জঞ্জালে
অচল অনড় অশ্রুত শৃঙ্খল ঝনঝন
আত্মাকে হননকারী মনুষ্যত্ব বিনাশী
আমি তোমাকে চাই না।
আমি চাই প্রাণবন্যায় চলমান,
গতির আবেগে বহমান
সমুদ্রাভিসারী নদীটি।
আর প্রেমানুভূতি সৃষ্টির সেরা অনুভূতি, যার উপর মানুষের, মানব সমাজের অগ্রগমন নির্ভরশীল। আমার বিশ্বাস পৃথিবীতে যত কবিতা রচিত হয়েছে, তার অধিকাংশই প্রেমানুভূতি নির্ভর। প্রেমানুভূতি নিয়ে আমি খুব কম কবিতা লিখেছি। আমার মনে হতো এবং হয় এ আমার একান্ত ব্যক্তিগত সম্পদ যা আমাকে আনন্দ দিয়েছে, তৃপ্তি দিয়েছে, চলার পথে পাশে থেকেছে। আমার জীবনের প্রথমভাগে 'প্রেম' নামে একটিই কবিতা লিখেছি, যা আমার কাব্যগ্রন্থ ' ঋদ্ধ সত্য অনুভবে আসে '-তে প্রকাশিত। আর আমার স্বামীর মৃত্যুর পর ' স্বগত সংলাপ ' নামে সংখ্যায়িত ত্রিশটি কবিতার একটা গুচ্ছ আছে। এইমাত্র।
আমার জীবনদর্শন? আমি বিশ্বাস করি যে জীবন পেয়েছি, তা একবারই মেলে। পৃথিবীর এই পথে আর কোনদিন হাঁটতে পাবো না। তাই পৃথিবীর প্রতিটি ধুলোকণা আমার প্রিয়। ' আমি পৃথিবীর কন্যা '.....বলে গর্বিত! আমার কবিতায় ঘুরে ফিরে এ চেতনা এসেছে! আর সবচেয়ে বড় বলে মানি ' মানুষ মানুষের জন্য. .....'। কবিতায় তাই বলতে চেয়েছি বারেবার।
৮)বাংলায় রচিত আর আমার পড়া এবং প্রিয় পাঁচটি কবিতা হচ্ছে :
(অ) আমি — রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর,
(আ) প্রিয়তমাসু— সুকান্ত ভট্টাচার্য,
(ই) বোধ — জীবনানন্দ দাশ,
(ঈ) যদি আর বাঁশী না বাজে —কাজী নজরুল ইসলাম,
(উ) হুলিয়া — নির্মলেন্দু গুণ।
৯)আমার লেখা কবিতার মধ্যে কোন কবিতা আমার সবচেয়ে প্রিয় বলাটা কঠিন। জানেন তো কবির কাছে তাঁর সব কবিতাই প্রিয়। তবু একটা বলতে হলে বলবো " মারিয়া কারোলিনা দে হেসুস "। নান্দনিকতা এ কবিতার কতটুকু জানিনা, শুধু জানি কবিতাটি আমাকে গভীরে নাড়া দেয়। আরেকটি কথা বলতেই হয়, দীর্ঘ কবিতা লিখতে আমি ভালোবাসি। আমার কবিতাটি দিচ্ছি।
মারিয়া কারোলিনা দে হেসুস
©সুনীতি দেবনাথ ২০১৪
----------------------------------------
নোংরা দুর্গন্ধমাখা আবর্জনার স্তুপ,
সেটাকে ঘিরে শকুনিরা কর্কশ চিৎকারে
আকাশটাকে করছিল ফালাফালা।
ওখানেই প্রাণের উদ্ভাসে জন্মেছিল শিশুটি-
অন্ধকারে সেই মানব শিশুটি গাঢ়তর অন্ধকারকে
উপভোগ করার জন্যই জন্মেছিল।
তাই প্রথম দু’চোখ মেলে যখন সে তাকালো-
প্রথম সে দৃষ্টিপাতে বোধের জগতে তোলপাড়
পৃথিবী এমনি হয় নোংরা পুঁতিগন্ধময়
আঁধার আকাশে মোড়া, হয়তো জেনে গিয়েছিল সে।
আহা! ফুলের মত পবিত্র শিশুটি –
ব্রাজিলের সেই সিণ্ডেরেলা বিশ্বের বিস্ময়কর পণ্যদ্রব্য!
প্রথম চোখ মেলে তাকালেন
মারিয়া কারোলিনা দে হেসুস!
শকুনির ভীড়ে এক স্পন্দিত জীবন!
তারপর দিন গেল রাত গেল ক্রমাগত এলোগেলো।
কিভাবে দিন রাতের পারাপার হল-
খবর জানেনা কেউ,খবর রাখেনি কেউ,
ব্রাজিলের লাখো শিশুর দিন রাত এমনিই ছিল।
তবে সবাই জানে অনেক দুঃখ বেদনার পথ হেঁটে
মারিয়া আরও গভীর প্রাপ্তির জন্য
আরও কঠোর শ্রমদানের জন্য বেঁচে চললেন,
বেড়েও উঠলেন,মারিয়া একদিন যুবতী হলেন।
একদিন এক পুরুষের সাথে তাঁর ভালবাসাবাসি হল
সন্তানের জন্ম দিয়ে মারিয়া জননীও হলেন-
অবিরত শ্রম আর দুঃখের সহবাসে তিনি এক নারীও হলেন।
সারাটা দিন কাজ আর কাজ চলমান এক কাজের চাকা
সারাটা রাত নিবিড় নিখাদ দুঃখের বুননে কালো
এরি মাঝে বেঁচে থাকে ব্রাজিলের অগুন্তি নারী-
মারিয়াও বেঁচে ছিলেন, বাঁচার ফাঁকে ফাঁকে আঁকাবাঁকা ছাঁদে
অক্ষরে অক্ষরে যন্ত্রণাদগ্ধ মনের কথাগুলি
দিনলিপির পাতায় পাতায় উপুড় করে ঢেলে দিয়েছিলেন,
কালো পৃথিবীর নারীর বেদনায় উপলব্ধ কোমল- গান্ধার!
একদিন এক আকস্মিক ক্ষণে এক সাংবাদিক
পেলেন সেই দিনলিপি পড়লেন বিমুগ্ধ হলেন
বুঝে গেলেন এ নারীর গহন মনের খনি পূর্ণ কালো সোনায়।
‘কুয়ারতো দে দেসপেহো’ – ‘চাইল্ড অফ দি ডার্ক’
১৯৬২ সালে প্রকাশিত হল, আর থামা নেই
ব্রাজিলের আস্তাকুঁড়- কন্যা হলেন লেখিকা।
সারা দুনিয়া তাজ্জব একী অপরূপ সৃষ্টির সম্ভার!
জীবনের টাটকা গন্ধমাখা, বিলাসী বিদগ্ধ জীবন নয়,
‘লা ফাবেলা’- ‘ঝুপড়ি’-র বাস্তব জান্তব জীবন আর
‘সাওপাওলোর নোংরা বস্তির পাঁচ বছরের ডায়েরি’ –
কষ্টকল্পিত কৃত্রিম সৃষ্টির আবর্জনা মাত্র নয়,
দেখে দুইচোখে অনুভবে জেনে সত্যি বেঁচে থেকে
শাশ্বত মানুষের সাহিত্যে নিচে থাকা ধুঁকে ধুঁকে বাঁচা
অগনিত মানুষের অতলান্ত বেদনার অফুরান কথামালা-
চমকে উঠল তথাকথিত আঁতেল শিল্পের সমঝদারগণ।
আস্তাকুঁড় থেকে বস্তি – বিদগ্ধসমাজ বেমানান
এ এক অলৌকিক জাদুকরের যেন জাদুকাঠির ভেল্কিবাজি!
রাতারাতি পৃথিবীর চল্লিশটা দেশের মানুষ
মারিয়া কারোলিনার বিচিত্র কথামালার বিমুগ্ধ পাঠক
উলট- পালট এই উত্থানে তেরটি ভাষায় অনুবাদও হল
জীবনের সত্য অভিজ্ঞতার চরম পরম বেদনার্ত উচ্চারণ!
এবার পরিভ্রমণ বিশ্বজোড়া মহাযাত্রা
সিণ্ডেরেলার পণ্য হবার চটকদার জীবন।
পৃথিবীর অসংখ্য পথে মাত্র ক’বছরের আশ্চর্য্য ভ্রমণ
সম্বর্ধনা সাক্ষাতকারের হুল্লোড় ফ্ল্যাশের জ্বলে ওঠা নেভা
ক্লিক্ ক্লিক্ কত, নোংরাঘাটা হাত দু’টি তাঁর
নন্দিত হল বন্দিত হল অভিনন্দন আর পুরস্কারে।
সম্ভ্রান্ত ভদ্রমহোদয়গণ আমন্ত্রণ ভোজে সঙ্গী পেয়ে
ধন্য হলেন, বলা কি সঠিক নয় ধন্য করলেন?
তাবড় তাবড় রাষ্ট্রনায়কগণ বিশ্বের দিলেন অভ্যর্থনা-
অভিনন্দনে আস্তাকুঁড়ের মারিয়া নন্দনকানন বাসিনী।
বিশ্বদরবারে খ্যাতির শীর্ষে তখন মারিয়া কারোলিনা দে হেসুস।
‘মনুষ্য শরীরে ডিনামাইট হল ক্ষুধা’-
‘এল আমব্রে এস লা দিনামিতা দেল কুয়ের পো উমানো’ –
ক্ষুধার এমন আগুনজ্বলা জ্বালাময়ী ধ্রুব উচ্চারণ
কোনও কবি বা লেখক কোনদিনই কি করেছিলেন ?
কোনও ক্ষুধার্ত মানুষও তার জীবনের স্পষ্ট সত্যকে এমনি
উচ্চারিত হতে শোনেনি কোনদিন- অনবদ্য গ্রন্থের অভিনব কথা!
১৯৭৭সালের শুরুতে বিষণ্ণ রোববারের এক ধোঁয়াটে সকাল
দিনের সূর্য তখনো পুব আকাশে নরম লাল আলো ছিটোনো শুরু করেনি
সেদিনও এক আস্তাকুঁড় ঘিরে পালে পালে শকুনি ডানা ঝাপটাচ্ছিল
উল্লসিত কর্কশ এক বীভৎস কোরাসে তারা-
নোংরা ডাস্টবিন ঘিরে প্রমত্ত ওড়াওড়ি
এই আবহে মরে পড়েছিলেন এক ব্রাজিলিয়ান নারী
ওদেশের হাজার হাজার অতি সাধারণ নারীর মতন।
তিনি এক অনবদ্য সার্থক নারী অন্যের উচ্ছিষ্ট খুঁটে যিনি
ঘোষণা করেছিলেন অমোঘ সত্য-
তুচ্ছতার ঘেরাটোপে থেকেও তাঁর উঁচু মাথা ছুঁয়েছিল আকাশের উচ্চতা,
সৃষ্টির নিত্য সত্যাকাশে আলোর বিভাসে ধ্রুবতারার মতই
প্রতিষ্ঠা পাবার অধিকারী তিনি মারিয়া কারোলিনা দে হেসুস!
জীবনের ক্ষুদ্রতম খণ্ড অবসরে সমাদৃতা হবার কালেও
মহার্ঘ ভোজসভায় আপ্যায়ন কালেও স্বপ্নেরা তাঁর-
শ্রমদানকালে প্রতিদিন প্রতিটা দিন মেশিনের ঘাতক চাকায়
পিষ্ঠ হয়ে গড়পড়তা শত শ্রমিকের আহত-নিহত হওয়া,
আর জন্মলগ্ন থেকেই সার সার বোবা স্তব্ধ দৃষ্টির ভিখিরি শিশু
এসব কিছুকে ঘিরে থাকা হিংস্র শকুনির ভয়াল চক্কর,
আতঙ্কিত স্বপ্নদের নিয়ে সুখ যাত্রায় কান্নার লহর বয়ে যেতো তাঁর।
নির্যাতিত ব্রাজিলের নির্যাতিতা নারী নির্যাতিত জীবনের ভাষ্যকার
শোষিতের একেবারে কাছে থেকে শোষিত জীবনে থেকে
কোনও একদিন হয়তো মুক্তি আসবেই স্বপ্ন দেখেছিলেন স্পষ্ট,
স্বপ্নদ্রষ্টা সেই নারী সকলকে স্বপ্ন দেখিয়ে আস্তাকুঁড়েই মরে গেলেন।
আজ কোন মুগ্ধ পাঠক বা স্তাবক পুষ্পগুচ্ছ হাতে এলোনা-
আজ প্রগাঢ় সন্তাপে কোন বিষাদ- মেদুর বিদায়ী ভায়োলিন বাজলোনা।
১০) আমার দুটি ইচ্ছে পূর্ণ করা হলে আমার প্রথম ইচ্ছে হবে — পৃথিবীর সকল শ্রেষ্ঠ দ্রোহের কবিতার নিপুণ বঙ্গানুবাদ আমি পড়তে চাইবো। আমার স্বপ্নের পৃথিবী ও শোষণমুক্ত মানব সমাজ গড়ে উঠুক — এটা আমার দ্বিতীয় ইচ্ছে।
নমস্কার ও শুভকামনা সবাইকে!
Suniti Debnath,
Kajori, Netaji Road,
P.O. - Dharmanagar,
North Tripura District,
State -Tripura.
Pin— 799250
দিদি!
প্রিয় কবি,
অনেক ধন্যবাদ মূল্যবান সময় থেকে সময় করে ছোট কবিতার সাক্ষাৎকারে সাড়া দেবার জন্য।
আশাকরি, এইসব সাধারণ প্রশ্নগুলির বিপরীতে কবির ভাবনা, অভিজ্ঞতা, পাঠ ও নান্দনিক দৃষ্টিভঙ্গির কথনে যারা নূতন লিখিয়ে তাদের জন্য অনেক উপকারে আসবে, কবি ও কবিতা সম্পর্কে একটা সুন্দর ধারণা পাবে, তাদের কবিতাচর্চার পথে আলো পাবে।
কবির সার্বিক মঙ্গল কামনায়,
সৈয়দ মহিউদ্দিন মাসুম
ছোট কবিতা
0 comments: