বিপ্লব মন্ত্রের দীক্ষাগুরু রবীন্দ্রনাথ
© সুনীতি দেবনাথ
তন্দ্রাচ্ছন্ন যুবশক্তিকে জেগে ওঠায় আর নতুন চেতনায় উদ্বুদ্ধ করেছিলেন গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। যৌবনের কণ্ঠে বিজয়মালা পরান তিনি। মহাচীনে কনফিউসিয়াসের দেশে New Tide Group যে বিপ্লবের মহাবন্যা আনে ভারতে রবীন্দ্রনাথের লেখনী সে বন্যা আনে। Chen-এর নেতৃত্বে চৈনিক সাহিত্যে শুরু হয় লড়াইয়ের ঝড়, সাহিত্যকে বাহন করে দিক দিগন্তে ছড়িয়ে পড়ে ভাঙ্গনের অগ্নিবন্যা। সেদিন মহাচীনের নব যৌবন বললো—স্বাধীনতা দাসত্ব নয়, প্রগতি রক্ষণশীলতা নয়, আক্রমণাত্মক মানসিকতা ভীরুতা নয়। কনফুসিয়াসের দর্শনে কর্তব্যের বন্ধনকে আক্রমণ করে, বিদ্রোহ ঘোষণা করে চীনের নব জোয়ার আন্দোলন — New Tide Movement। কর্তব্য নয় অধিকার প্রাধান্য পায় এই আন্দোলনে।
রবীন্দ্রনাথ নির্বিচারে অতীত ঐতিহ্যকে আঘাত করেননি। ভারতীয় সংস্কৃতির মহান ঐতিহ্যকে শ্রদ্ধার সঙ্গে তিনি স্বীকৃতি দিয়েছেন। তাঁর লেখায় তপোবন আশ্রমের প্রাজ্ঞ ঋষিগণের ভাবনার ছন্দোময় প্রকাশ। ' নৈবেদ্য ' কাব্য ' উপনিষদের ভাবসম্পদে পরিপূর্ণ। আবার নির্বিচারে অতীতকে অন্ধ গ্রহনও তিনি করেননি। তাঁর কাছে সর্বোচ্চ মূল্য ছিল মানুষের জীবনের, আর এর মূল্যকে যা খর্ব করতে চেয়েছে তাকে তিনি কখনো, কোন মূল্যেই ক্ষমা করেননি। তাঁর কাব্য স্বাধীনতার জয়গান, পথ চলার সুর। ন্যায় ও স্বাধীনতায় ভিত্তি করে নব জগৎ সৃষ্টি করতে চান তিনি। ' প্রান্তিক '- এর শেষ কবিতায় যাবার আগে তিনি যাদের আকুল কণ্ঠে ডাক দিয়েছেন, " তারা হবে নির্ভীক যোদ্ধা, তারা সংগ্রাম করবে আসুরিক শক্তির বিরুদ্ধে — যে শক্তি আজ নরমুণ্ডের পিরামিডের উপরে উড্ডীন করতে চায় তার উদ্ধত জয়ধ্বজা, রক্তের সাগরে ডুবিয়ে দিতে চায় মানুুষের কতকালের তৈরি সভ্যতার আকাশচুম্বি সৌধকে। " [ বিজয়লাল চট্টোপাধ্যায় ]
জীবন অন্তহীন সংগ্রাম। সে সংগ্রামের নির্ভীক কুণ্ঠাহীন সৈনিক যৌবন। তাঁর ডাক তাই যৌবনের জাগরণের। যৌবনই পারবে অজানাকে জয় করতে, ভেতর ও বাইরের শত্রুকে জয় করে মনুষ্যত্বের বিজয় ঘোষণা করতে। তাই রবীন্দ্র সাহিত্য মানুষের পথ চলার, মানবিকতার বিজয়গাথা আর যুবশক্তি তার ঋত্বিক অগ্নিহোত্রী সৈনিক।
কর্তব্যের আদর্শ তিনি স্বীকার করেন। তাই তিনি সহজেই বলতে পারেন —
তোমার কাছে আরাম চেয়ে
পেলেম শুধু লজ্জা।
এবার সকল অঙ্গ ছেয়ে
পরাও রণসজ্জা।
কর্তব্যের দোহাই দিয়ে মানুষের জীবনকে পঙ্গু করে দেবার প্রয়াসকে ধ্বংস করতে তাঁর সাহিত্য খরশান তরবারি। মুক্তধারা নাটকে তারই নিদর্শন মেলে।রাজা প্রজার ক্ষুধার অন্নে হাত বাড়ালে ধনঞ্জয় বৈরাগীর তীব্র কণ্ঠে শুনি—...আমার উদ্বৃত্ত অন্ন তোমার, ক্ষুধার অন্ন তোমার নয়।
রাজদ্রোহকে রবীন্দ্রনাথ সম্পূর্ণ সমর্থন করেন জনগণের স্বার্থে। মানুষের জীবনের প্রতি অপরিসীম শ্রদ্ধাই এর মূলে। তাঁর লেখায় স্পষ্ট নির্দেশ মানুষের জীবনের প্রতি একবার শ্রদ্ধা জাগাতে পারলে চিরতরে মুশকিল আসান সম্ভব। মানুষের মর্যাদা ও অধিকারকে রক্ষা না করার হীনতা ও নিষ্ঠুরতা বর্তমান পৃথিবীর দুর্গতির মূল কারণ সেটা বহুদিন আগেই রবীন্দ্রনাথ দৃঢ় কণ্ঠে উচ্চারণ করে গেছেন।
স্বল্প পরিসরে রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যের মৌল সত্য আবিষ্কার সুকঠিন ব্যাপার। তাঁর ' স্ত্রীর পত্র ' কমপক্ষে উল্লেখের দাবি রাখে। এই গল্পে নারীর বিদ্রোহিনী সত্ত্বার অভিনব প্রকাশ অবশ্যই উল্লেখ করতে হয়। স্বামী স্ত্রীর মতামতকে পাত্তা দিতে একদম নারাজ। মেয়েদের জন্ম হয়েছে পুরুষের হুকুম পালন করার জন্য। তার মতামত বা জীবনের দাম কি? তার জন্ম হয়েছে সংসার চালনা, সন্তানের জন্মদান ও প্রতিপালন, পুরুষের খেলনা হওয়া, কামনা তৃপ্ত করার জন্য। উদ্ধত পুরুষের ঔদ্ধত্যের বিরুদ্ধে নারীর বিদ্রোহের কাহিনী এটি। নারীর বিদ্রোহিনী সত্ত্বার যুগান্তকারী সৃষ্টি এটি। স্ত্রী বলে —... সংসারের মাঝখানে মেয়েমানুষ পরিচয়টা যে কী -তা আমি পেয়েছি। আর আমার দরকার নাই।
রবীন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন মানুষের জীবনকে মর্যাদা দিতে, অধিকারে প্রতিষ্ঠিত করতে। মানুষের জীবনের প্রতি ছিল তাঁর অপরিমেয় শ্রদ্ধা। আর এই শ্রদ্ধাবোধ থেকেই উচ্চারিত তাঁর বিদ্রোহের বাণী, অগ্নিময় এই বাণীরই শিক্ষাগুরু তিনি যুবশক্তির। কারণ তিনি সমগ্র সত্ত্বা দিয়ে অনুভব করেছিলেন ' আধমরাদের ঘা মেরে ' যুবশক্তিই চেতনায় চৈতন্যময় করে তুলতে পারবে। আজ দুনিয়াসুদ্ধ যে অবক্ষয় কুরে কুুুরে মনুষ্যত্বকে ধ্বংস করছে, সেখানে দাঁড়িয়ে আমরা বলতে পারি রবীন্দ্রনাথ" আমার হাত ধরে তুমি নিয়ে চল সখা আমি যে পথ চিনি না। "
0 comments: