সে
© সুনীতি দেবনাথ
আকাশ ছেনে বাছাইকরা কিছু নক্ষত্র
সে একদিন আমার আঁচলে ঢেলে দিয়েছিলো
পৃথিবীর সব অরণ্য তল্লাসী করে নীলকণ্ঠ পাখির
পালক এনে আমার খোলা চুলে সাজিয়ে দিলো
জল থৈথৈ বিলে অবিরাম সাঁতরে দু'টি হাতে শাপলার
বাজুবন্ধ পরিয়েছিলো, সে আমার প্রিয় ভাই।
আমি যখন কাগজ কলমে শব্দের আঁকিবুঁকিতে
সারিতে সারিতে আলপনা এঁকে যেতাম তখন সে
পাশটিতে চুপটি বসে হাঁকরা চোখে তাকিয়েই থাকতো।
উদাসী জানলায় বিবশ বিকেলে উদাস উদাস আমি
আমার চেতনায় তুমুল বৃষ্টি ভাবনা মত্ত বিক্ষুব্ধ সংলাপে
আকাশে ঝড়ো মেঘের ঝুঁটি চেপে আমি দুনিয়াটাকে
ওলোটপালোট করে চাইতাম সাজিয়ে নেবো ইচ্ছেখুশি।
হয়তো আমার দু’চোখে তখন বিদ্যুল্লেখা আগুনের ফুলকি
আর আমি আগুনের মত জ্বলে উঠে হতে চাইছি অগ্নিকন্যা,
সে পাথর মুখ কোঁচকানো ভুরু সুতীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমাকে দেখতো,
তার সেই নিঃশব্দ চাউনি অনুচ্চারিত প্রতিজ্ঞা হয়ে
আমাকে কাঁপিয়ে দিয়ে অন্দরমহলে তুলতো তোলপাড় ঝড়।
কখনো শান বাঁধানো ঘাটে একেলা আমি বসে
জলকেলিতে হাঁসগুলির খুনসুটি দেখছি পানকৌড়ির
টুপ টুপ ডুব চমকালো রঙবাহারি মাছরাঙার রকমসকম—
আমি দ্বাদশী কিশোরী খিলখিল হাসির দমকে ভেঙ্গে পড়ি,
সে তখন হা হা হাসির অট্টরবে কাঁপিয়ে দিতো
সারাটা দিঘীর কালচে জলের ঘরসংসার
ওপাশের একঠ্যাঙা তালগাছটার পাতাগুলি উঠতো কেঁপে
বাঁশঝাড়ে সবুজ দীঘল পাতারা সন্ত্রস্ত, ঝুঁকে দেখতো
মাটি কেঁপে কেঁপে চৌচির হয়ে গেলো কিনা।
আমি বলতাম ভাই এমন হাসি হেসোনা
ভাই আমার বুক যে কাঁপছে থরোথরো।
আর ঠিক তখনই দু’টি মুঠো খুলে সে উজাড় করে
ঢেলে দিতো আমার হাতে গুচ্ছ লাল পলাশ,
আকাশে বাতাসে মৃত্তিকার রোমে রোমে কী লাল উল্লাস!
সে খুশিতে ডগোমগো ঘাসের সবুজ মখমলে সেকী গড়াগড়ি!
আমার দু’চোখে নতুন আনকোরা পৃথিবীর ছবি স্থির চিত্রলেখা!
তারপর দিনগুলি ডানা মেলে দিলো যে উড়াল
উড়তে উড়তে পার হলো পাকা সোনালী ধানের খেত
নীল গাছের ছায়ায় ছোট ছোট ঘর গেরস্তালি
অগুন্তি গ্রামের পর গ্রাম কত মানুষের পাড়া ঘরসংসার
পার হয়ে নগর প্রান্তর দিল পাড়ি না ফেরার দেশে।
খুব যে বেশীদিন খুব যে বেশী পরিসর এভাবে পার হলো
ঠিক এভাবেই কেটে গেলো বলাতো
চলে না
এসে গেলো ভয়াল আরেক বিপন্ন দিন বৈশাখী ডানায়।
সে কোথায় আমি কোথায়
মাঝে দিকশূন্যপুরের ক্ষিপ্ত ভয়ঙ্কর মাঠ পদচিহ্নহীন
এলো পঙ্গপালের মত শোষক দল নির্দয় নিষ্ঠুর
ভেঙ্গেচুরে তছনছ সব বহুকালের স্বপ্নের বাড়িঘর,
কৃষ্ণ ডানায় এলো দিনের উঠোনে বাদুড়ের দল
অন্ধকার ছড়িয়ে ছড়িয়ে তোমার আমার সকলের ঘরে।
জীবন্ত মানুষ লাশ হলো ভাষাহীন আশাহীন স্বপ্নহীন
স্বাধীনতা ছিন্নকন্থা দুয়ারে দুয়ারে কেঁদে ফেরে
ভিক্ষাপাত্র হাতে ক্ষতের বীভৎস দাগ সারা দেহে নিয়ে।
আর সে হেঁটে চলেছে হেঁটেই চলেছে তারপর,
তারপর সে কেঁদেই চলেছে কাঁদছে কেবলই
আমার চোখে ভরা কালো দিঘী অফুরন্ত জল টলোমল,
আমি দেখছি শূন্য দৃষ্টি শূন্যে মেলে সে
ফসলী মাঠের আলপথে হেঁটে চলে যাচ্ছে দূর থেকে
দূরে আরও দূরে উদ্ভ্রান্ত পাগলের মত
গন্তব্য না জেনে এই যাত্রা পরিণাম হীনতায় বিদ্ধ।
এ যুগের ক্রুশবিদ্ধ যীশু!
কতগুলো মানব চেহারাধারী পশু মত্ত জিঘাংসায়
ছুঁড়ছে কাদা , ইটপাটকেল সে আজ পাথর মানুষ
অনুভূতি লেশমাত্র নাড়ায় না তাকে, ক্রোধ তার
ভেসে গেছে মেঘনা পদ্মার স্রোতে ভেসে
বহুদূরে বঙ্গোপসাগরে।
আমি ডাকি ভাই কথা শোনো,
ফিরেও চায় না সে এলোমেলো পায়ে চলে যায়।
কাজরী,
১৭ মার্চ, ২০১৫
.....................................................................
আবৃত্তি শুনুন বদরুল আহসান খানের কন্ঠে --- সে
0 comments: