অঙ্কে আমি চিরদিন কাঁচা
© সুনীতি দেবনাথ
নববর্ষ : ১৪২২ বঙ্গাব্দ
উৎসর্গঃ ইউসুফ স্পার্টাকাস হাবিব, আমার ভাই, যার দাবিতে এ কবিতার জন্ম।
অঙ্কে আমি বরাবর কাঁচা
কোন অঙ্কই এখনো মেলাতে পারিনি।
বাঁচার অঙ্কের কথাই ধরা যাক না —
আমরা ভাবি জন্ম থেকে মৃত্যু
এই সোহানা সফর, এরই নাম জীবন!
বড়সড় খটকা জাগে
তালগোল পাঁকিয়ে যায় বাঁচলাম কখন?
যে মুহূর্তে, সময়ের ক্ষুদ্রতম মুহূর্তে
অনুভব করতে চাই আমি বেঁচে আছি
ঠিক তক্ষুনি জেনে যাই মরে গেছি
আমার অজান্তে আমি কেবল মরছি
এক জন্ম তাহলে মৃত্যুর যোগফল?
মৃত্যুই রচে যায় নব নব অনুপলব্ধ
জীবনের কল্পবিলাসী ইতিহাস!
তাই কি মৈত্রেয়ী প্রজ্ঞাবতী নারী
বৈদিক সভ্যতার সেই ঊষালগ্নে
দৃঢ় কণ্ঠে বলেছিলেন ' যেনাহং
নামৃতা স্যাম্ কিমহং তেন কুর্যামঃ '?
যা আমাকে অমৃতত্ত্ব দেবে না
তা নিয়ে আমি কি করবো?
এখানেও অঙ্কটা আমার বিলকুল মেলেনি।
প্রজ্ঞাবতী নারী মৈত্রেয়ী কি আমিত্বের
ঘেরাটোপ পেরিয়ে বহুত্বে বিলীন হয়ে
বিশাল মনুষ্যত্বের মহাসমুদ্রে যুক্ত হতে
অপারগ ছিলেন? আত্মকে কেন্দ্র করে
অমল অমৃতের সন্ধান করে বিবর্তিত
শুধু শুদ্ধতার প্রতীক আলো নারী?
এই অঙ্ক মেলাতেও ডাহা ফেল আমি।
আমি অমৃত চাই না, আমার দু ' চোখে
জেগে থাকে এই প্রবল প্রত্যক্ষ বাস্তব,
স্বর্গ বেহেস্ত ওসব আমার অঙ্কের বাইরে,
আমার কল্পনা বড় সীমায়িত পরিসরে,
তাই আজ অব্দি কোন অঙ্ক মেলেনি।
অঙ্কে চিরটাকাল আমি কাঁচাই শুধু —
তাই এই অঙ্কের জটিলতাও আমাকে
এই বেওকুফ আমাকে কাঁদিয়ে ফেলে,
আমি দেখছি মুষ্টিমেয় ক্ষমতাবান
চিরকাল চিরটা কাল অগণিত মানুষকে
নাকে দড়ি দিয়ে নাচায়, পদতলে পিষে
চুরমার করে, তাদের স্বপ্নের ঘরে রাহাজানি করে বুক ফুলিয়ে বেমক্কা হাসে হাসতেই থাকে, আনন্দে বিভোর!
সুখ কি কেবল একতরফা হাটে?
দুঃখের ডাস্টবিন অসহায় মানুষ?
আজ নববর্ষ আনন্দ লহরী নিয়ে জোরকদমে সম্মুখে সমাগত!
আজ বৈশাখী মেলায় বেচাকেনা হবে
সুখের পশরা, কোলাকুলি গলাগলি!
আজ আকাশে আনন্দ বাতাসে সুখ
রঙিলা সুখের ঢেউয়ে দোল দোদুল!
ঢাকা থেকে প্যারিস, বাংলা থেকে
সুদূর মার্কিন মুলুক, দুবাই, সৌদি আরব
বাঙ্গালী আজ নাচবে গাইবে হাসবে!
শুভকামনা উড়বে আকাশে বাতাসে
ভাল থেকো, সুখে থেকো, সমৃদ্ধ হও
হে বাংলার বাঙ্গালী! শুভকামনা!
অংকটা এখানেও মেলে না—
আমি অঙ্কে মাথামোটা।
এ পরবে বাংলার দুখিনী মা কাঁদে
পরবের কাল সে তো বিস্মৃত অতীত,
নতুন বছরে সন্তানের পাতে কি দেবে,
কোন সুস্বাদু অমৃত দেবে জানেনা।
শিক্ষিত বেকার যুবক স্বপ্নহারা
অন্ধকার থেকে আরো অন্ধকারে
হতাশার ছোবলে নীল হেঁটেই চলে।
পথশিশুদের সংখ্যা ক্রমবর্ধমান,
অরাজক রাজত্বে দিনে দ্বিপ্রহরে
হিংস্রতা আক্রোশে গর্জমান
হায়েনারা দলে দলে চলাচল করে।
গ্রামে গঞ্জে ছোটখাটো শহরে উপকণ্ঠে
হাহাকার, হাহাকার আর হাহাকার।
পড়োশী তোমরা সবাই কেমন আছো?
আমরাও ভালো নেই, সুখে নেই গো!
তুমি আমি সে আমরা সবাই বড় দুঃখী।
এই অঙ্কও মেলাতে পারিনি, পারবো
সে আশার সুলুকসন্ধান সেও জানি না।
তাই সারাবেলা একটা অসহায় ক্রোধ,
না পারার অক্ষমতা আমাকে ভাঙ্গে
আমি ভেতর থেকে আমাকে দেখি
মনে হয় এভাবে ভেঙ্গে চুরমার হওয়া
এই বুঝি নেমেসিস, নিয়তি আমার?
তবুও অঙ্কটা মেলাতে সারাটা বিশ্বের
সারাটা হিসেব নিকেশে চোখ বুলিয়ে
অসহায় ক্রুদ্ধ কান্না আমাকে বিবশ করে
আমি জেনে যাই এক অমোঘ সত্যকে
এভাবেই অনুন্নয়নের মূল্যে চিরকাল
উন্নয়নের চাকা সুমসৃণ হয়ে বনবন
ঘোরে সর্বকালে, খলখল হাসে।
বন্ধু, অঙ্ক মিলুক না মিলুক
আজ শুভ নববর্ষ! আজ শুধু
শুভকামনা, শুভকামনা, শুভকামনা!
0 comments: