লেখা-লেখি

কবি সুমিত চক্রবর্তির কবিতা ' জাতিস্মর ' : কিছু প্রাসঙ্গিক আলোচনা

৫:০১:০০ PM 0 Comments













কবি সুমিত চক্রবর্তির কবিতা 'জাতিস্মর ':কিছু প্রাসঙ্গিক আলোচনা

© সুনীতি দেবনাথ

 ইংরেজি সাহিত্যে অপরিমিত দক্ষতার অধিকারী, নিপুণ গবেষক,  মেধাবী ও দুরন্ত প্রতিভাবান কবি সুমিত চক্রবর্তি। সুমিত চক্রবর্তি নেহাতই তরুণ বয়স্ক। কিন্তু অধীত বিদ্যা ও সৃজনশীল জগতে  তার সার্থক প্রয়োগে এখনই বাংলাদেশের একজন ঈর্ষণীয় কবি ব্যক্তিত্ব হিসেবে আগামীর সুদৃঢ় প্রত্যাশাকে জাগিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন। প্রজ্ঞাবান এই কবি নিঃসন্দেহে বাংলার ভাবীকালের উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক
 হয়ে উঠবেন, স্বীয় আলোকে বাংলা ও বাঙালিকে গর্বিত, নন্দিত ও বন্দিত করবেন —  গভীর প্রত্যাশা।
        সুমিত চক্রবর্তির ' জাতিস্মর ' কবিতা তর্কাতীতভাবে তাঁর সৃষ্ট একটি মাস্টারপীস বলে পরিগণনা করা যেতে পারে। চেহারায় নেহাতই একটি রোমান্টিক ও সাধারণ প্রেমের কবিতা মনে হলেও আমি বলবো বর্ণচোরা প্রকৃতির জন্য উত্তর আধুনিক যুগের সার্থক একটি মিস্টিক কবিতা জাতিস্মর। কবিতার নাম জাতিস্মর হলেও সেই তত্ত্ব নিয়ে কবি সরাসরি একটি শব্দও ব্যবহার করেননি। পুরো কবিতা যেন মধুর একটি প্রেম কবিতা। বাস্তবানুভূতির আড়ালে বহমান অন্তর্লীন এক বিরাট দার্শনিক ভাবনা। যেটাকে আমরা বলি Metaphysics বা অধিবিদ্যা।
   জাতিস্মর শব্দটির আভিধানিক তথা প্রচলিত অর্থ বা অভিধা হচ্ছে পূর্বজন্মের অলৌকিক স্মৃতি পরবর্তী জন্মে যেসব ব্যক্তি মনে রাখতে পারে, তারা জাতিস্মর। জাতিস্মর কথাটির গূঢ়ার্থ মেনে নেওয়া মানে পূর্বজন্ম ও পুনর্জন্ম অর্থাৎ জন্মান্তরবাদ মেনে নেওয়া। সাধারণত প্রাচ্য জগতে জন্মান্তর বিশ্বাসী লোকের সংখ্যা বেশি, পাশ্চাত্যে সে সংখ্যা কম। আমেরিকার শতকরা বিশজন লোক জন্মান্তরবাদে বিশ্বাসী। জাতিস্মরদের অস্তিত্বে সন্দেহবাদীদের বক্তব্য পূর্বজন্ম মনে রাখা স্বপ্ন ছাড়া কিছু নয়। অনেকেই জাতিস্মর আছে বলে বিশ্বাস করেন না, মানে জন্মান্তরবাদে বিশ্বাস করেন না। অপরপক্ষে অনেক বিজ্ঞানী জাতিস্মর তত্ত্ব মানেন। তাঁরা পূর্বজন্ম আর পুনর্জন্ম প্রমাণ সাপেক্ষ মনে করেন। ক্যারল বোম্যান জাতিস্মরে বিশ্বাসী, তাঁর মতে জাতিস্মরদের পূর্বজীবন হলো সত্যি ঘটনার পূর্ণাঙ্গ মানসিক চিত্র। একজন সূক্ষ্ম অনুভূতি সম্পন্ন মানুষ এর পার্থক্য নির্ণয় করতে পারেন। অভিজ্ঞতা  বহির্ভূত জ্ঞান এটা। জাতিস্মর তত্ত্ব নিয়ে গবেষণায় স্মরণীয় অপর ব্যক্তিত্ব ইয়ান স্টিভেনসন। তাঁর অনেক প্রকাশনা, কেউ তাঁর লেখায় বৈজ্ঞানিক সত্য পান, প্রশ্নাতীত সত্য অনেকেই পান না। মোদ্দাকথা এ নিয়ে সংশয়াতীত সত্য আজও মেলেনি।
    সুমিত চক্রবর্তির কবিতার নাম জাতিস্মর — তবে জাতিস্মরের তাত্ত্বিক বা বিতর্কমূলক কোন কিছুর লেশমাত্র এতে নেই। সম্পূর্ণ কবিতাটি প্রেমের বিরহবিধুর বিষয়ানুগ বলেই আপাত দৃষ্টিতে প্রতিভাত হয়। যেন নিছক একটি প্রেম কবিতা। আঙ্গিক, গঠনশৈলী, শব্দ- প্রয়োগ, ছন্দ - অলঙ্কার প্রয়োগেও উল্লেখযোগ্য কুশলতার পরিচিতি নজরে আসে না। অথচ জহুরীর চোখ নিয়ে কবিতার ভাবগভীরে বিশ্লেষণাত্মণক মনোনিবেশ করলে চমকে উঠতে হবেই। একী অপরূপ সৃষ্টি! বাস্তবতানুভূতির মাধ্যমে দেখলে দেখা যাবে কবিতায় অন্তর্লীন হয়ে আছে রূপকাশ্রয়ী এক বিরাট দার্শনিক তত্ত্ব আর দৃষ্টিভঙ্গি। কবি কবিতা রচনা করতে গিয়ে কখন যে প্রাজ্ঞ দার্শনিক হয়ে উঠেছেন তা যেন নিজেই জানেন না।
   কবি- প্রযুক্ত দার্শনিকতাকে আমরা বলি Metaphysics বা অধিবিদ্যা। সত্তার প্রকৃতি ও জ্ঞান সংক্রান্ত দর্শনশাস্ত্র হচ্ছে অধিবিদ্যা, আর দূরকল্পী দর্শন ও বিমূর্ত আলোচনা অধিবিদ্যামূলক।
প্রথমেই মনে হয় কবিতাটি অনন্যসাধারন প্রেমের কবিতা,প্রেমে জর্জর প্রেমিকের স্বগতোক্তি। স্বগতোক্তি বটে, প্রেমের কবিতাই বটে, তবে সেটা আরেকটু বৃহত্তর পরিসরে।জাতিস্মর মানে পূর্ব জন্মের সব মনে করার ক্ষমতাধারী ব্যক্তি।তাহলে সাধারন পাঠে বোঝা যাচ্ছে কবিতায় বক্তা একজন জাতিস্মর। হিন্দু ধর্ম অনুযায়ী মাত্র ছ' জন ছিলেন জাতিস্মর। বোঝাই যাচ্ছে কবিতাটি আর সহজ নয়।সময়ের বাঁধ ভেঙ্গে প্রেম এখানে উপস্থাপিত এক অনন্য উচ্চতায়।শারীরবৃত্তীয় ধারণা ছেড়ে সে গিয়ে মিশেছে পরমাত্মার সত্তায়। মানবিক পার্থিব প্রেমে কবিতার সূচনা, মগ্ন কবি বাস্তব পার্থিব প্রেমের বর্ণনা করে করে যেন অজান্তে পৌঁছে যান অন্য ভাবনার অন্য ভুবনে। বাস্তব শরীরী অনুভূতি বাস্তবের সীমানা পেরিয়ে চলে যায় বিমূর্ত ভাবলোকে, সীমায়িত জীবনের উত্তরণ ঘটে অসীমে। মনে হয় কবি পৌঁছে গেলেন রবীন্দ্রসৃষ্ট সীমা - অসীমের তত্ত্বলোকে। এই উত্তরণ, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যতা থেকে অতীন্দ্রিয় বিমূর্ততায়। এ যাত্রা জন্ম থেকে জন্মান্তরে, পূর্বজন্ম থেকে পুনর্জন্মে, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যতা থেকে অতীন্দ্রিয় লোকে।
               আমি তোর ঠিকানা হব,
               সব শ্রান্তি, ক্লান্তিতে তুই
               আমার নীড়ে ফিরবি,
               আমার কাঁধে মাথা এলিয়ে বলবি
               এই, আমার হাতটা একটু ধর না।
               তোর আদরমাখা হাত গালে ছোঁয়াবো,
                অনুভব করবো আমি নিজেকে ।
   দেহ সীমায় আবদ্ধ এই অনুভব এ জন্মেই সীমায়িত। পার্থিব সত্তায় কবি ' এলো চুলের ঘ্রাণে' মাতাল হন, প্রেমিকার 'চোখের গভীরে ' ডুব দিয়ে কবিতায় বাঁচতে চান। তারপর অতীন্দ্রিয় লোকে উত্তরণের পালা, এ যেন জাতিস্মরের পূর্বজন্ম থেকে পুনর্জন্মে স্মৃৃতির পথ হাঁটা। কবি অধরা প্রিয়াকে পুনর্জন্মে ধরেও ধরতে পারছেন না, ছুঁয়েও ছোঁয়া যাচ্ছে না —
                 পথের ধারের ঐ আগুন
                  লাল ফুলগুলো আজ বড়
                        ফিকে লাগছে,
                 তুই যে সব রঙ ভুলে গেছিস্,
                 তোর ছোঁয়া যেন পথ ভুলে গেছে।
     কবিতা কবির বিশ্বাসের প্রমান।সুতরাং কবি জন্মান্তরবাদে বিশ্বাস করেন। কনক্রিট যে সব বিষয় সেসব আমাদের চোখের সামনেই অপরিবর্তিত থাকে
কারণ এগুলা ইলিউশান। পথের ধারে, ফুল গাছ ওসব সেই ইলিউশানের এলিমেন্ট কিন্তু এই ইলিউশান লিংক করে আমাদের রেইনকারনেটেড সোলের সাথে প্রাইম সোলের।আর পথিমধ্যে ভালবাসা, হৃদয় এর মিলন দেখা দেয় জন্ম মৃত্যুর মত অমোঘ শক্তি হিসেবে,মহামায়ার বাঁধনে আমরা বাঁধা পড়ে রচে যাই জীবন বন্দনা।
      কবি সৃস্টিতত্বকে গেঁথেছেন অস্তিত্ববাদের সাথে।এবস্ট্রাক্ট কন্ট্রাস্ট করেছেন ইহকালকে অদৃষ্টবাদী ধারণার সাথে,সঙ্গে এসেছে মানুষের পূর্ব নির্ধারিত যাত্রাপথ। কবি এবার যেন অতীতের সেই বিশ্বাস থেকে ' তোর জন্মই হয়েছে প্রেম হবার জন্য ', এই বিশ্বাস থেকে বিচ্যুত হয়ে যান। মেঠো পথে বাতাসে ঘাসে ফুলে হাসিতে প্রিয়ার ভালবাসায় পাওয়া আপন সত্তা ও পূর্ণতাকে বৃথাই খুঁজে বেড়ান। সংশয়ে আক্রান্ত হন। অবশেষে সব অন্বেষণ সংশয় শেষে কবি অধিদার্শনিকতায় পৌঁছে অতীন্দ্রিয় লোকে পরমাত্মায় মিশে যান। বৈষ্ণব দর্শনেও আত্মা পরমাত্মার মিলনের কথা বলা হয়েছে। রবীন্দ্র দর্শনে এরই অনুরণন শুনি " আমার মিলন লাগি তুমি আসছো কবে থেকে ........."। কবি সুমিত চক্রবর্তি বলেন,
        যেখানে অস্তিত্ব মিশেছে গরীয়ানে
        প্রশ্নাতীত সেখানে দেহ,
        প্রেম যে সেই শ্রেয়।
        সেই প্রেমে আমি ভাসবো,
        আমি তোর ঠিকানায় যাব।
        এবার তুই আমার ঠিকানা হবি।

    গাছপালা,ফুল পাখি, হাসি এ সব ভ্রম।এগুলো কখনোই ছিল না,নেই।তবে যা দেখা যায় না(পরকাল,ঈশ্বর,মায়া,ভালবাসা) তা বরাবরই ছিল।প্রশ্ন হচ্ছে তাহলে এই ইলিউশান তৈরি করা কেন।তার উত্তর হচ্ছে এগুলোই তো মানুষকে বোধিপ্রাপ্ত হতে সুযোগ দেবে।
       মানুষ সৃষ্ট হওয়া  মাত্রই প্রেমিক,তার জন্মই হয় প্রেম খুঁজতে। সে খুঁজে ফেরে তাই মহামায়ার বাঁধনে জড়িয়ে।পরিক্রমা শেষে সে ঈশ্বররূপী চিরসত্য, প্রেমকে খুঁজে পেয়ে তাতেই আশ্রয় নেয়, মিলে যায় পরমাত্মায়।
      অতি হালকা ওজনের বাক্যমালায় কবি শাশ্বত সত্যের সিংহ দরোজায় কড়া নাড়তে চেয়েছেন। কবি এখানে কবি মাত্র নন, প্রাজ্ঞ দার্শনিক হয়ে উঠেছেন।
   

।। জাতিস্মর।।

সুমিত চক্রবর্ত্তি
৥৥৥৥৥৥৥৥৥৥৥৥৥৥৥৥৥৥৥৥৥৥৥৥৥৥৥৥৥৥
আমি তোর ঠিকানা হব,
সব শ্রান্তি,ক্লান্তিতে তুই আমার নীড়ে ফিরবি,
আমার কাঁধে মাথা এলিয়ে বলবি;
এই, আমার হাতটা একটু ধর না!
তোর আদর মাখা হাত আমার গালে ছোঁয়াবো, অনুভব করবো আমি নিজেকে।
তোর এলোচুলের ঘ্রানে আমি মাতাল হব,
তোর চোখের গভীরে ডুববো,
তোকে কবিতায় নিয়ে বাচঁব।
মনে আছে তোর ?
বলেছিলি দুহাতে জড়িয়ে,
যদি কোনোদিন ছেড়ে যাস তোকে মেরেই ফেলব শয়তান।
ফুলের গাছগুলোতে আগুন লেগেছে,
আজ ফাগুন এসেছে যে,
আমি পাগলের মত শ্বাস নিচ্ছি,
চারিদিকে যেন তুই তুই গন্ধ,
পথের ধারের ওই আগুন লাল ফুলগুলো আজ বড় ফিকে লাগছে,
তুই যে ওর রং ভুলে গেছিস,
তোর ছোঁয়া যেন পথ ভুলে গেছে,
মনে আছে তোর?
তোকে বলতাম,
তোর জন্মই হয়েছে প্রেম হবার জন্যে,
রবীন্দ্রের পূজো পাবার জন্যে,
আমাকে পূর্ণতা দেবার জন্যে।
ওই সেই মেঠো পথে আমি আজো হেঁটে যাই,
বাতাসে,ঘাসে,ফুলে,হাসিতে,খুঁজে ফিরি তোর অস্তিত্বে আমাকে,
খুঁজে ফিরি তোর ভালবাসায় পাওয়া আমার পূর্ণতা কে,
খুঁজে ফিরি তোর ভালবাসায় বানানো আমার সেই পৃথিবীটাকে।
যেখানে অস্তিত্ব মিশেছে গরীয়ানে,
প্রশ্নাতীত সেখানে দেহ,
প্রেম যে সেই শ্রেয়।
সেই প্রেমে আমি ভাসব,
আমি তোর ঠিকানায় যাব।
এবার তুই আমার ঠিকানা হবি।

SUNITI Debnath

আমি সুনীতি দেবনাথ, অবসরপ্রাপ্ত সরকারি শিক্ষিকা। কবিতা, প্রবন্ধ ও ছোটগল্প লিখি। কবিতা আমার প্রিয়ভূমি, শৈশব থেকেই হেঁটে চলেছি...

0 comments: