ত্রিবেণী সঙ্গমে
© সুনীতি দেবনাথ
ত্রিবেণী সঙ্গম
গঙ্গা যমুনা আর ফল্গুধারা সরস্বতী
ভারতাত্মার পবিত্রতমা তিনটি নদীর মিলিত ধারা!
কোমর জলে সেদিন ডুব দিয়ে বারবার সামনে তাকালাম
আজ পরম্পরা মাফিক গর্ভধারিণী জননীর অস্থি বিসর্জন দেব।
বহু যুগ পেরিয়েও কেন সংস্কারের শিকল ছেঁড়া সুকঠিন
অতি সুকঠিন থেকে গেল ভেবে ভেতরে উন্মত্ত ঝড় ফুঁসছিল!
তবু সেই শীতের ভোরে কী এক জ্বালা জুড়োতে ডুব ডুব বার বার—
মাথা উঁচু করে সামনে তাকিয়ে জবাকুসুম সঙ্কাশ মহিমান্বিত সূর্যদেব!
যুগ যুগান্তরের আদিত্যপুরুষ, লাল স্থির রশ্মিতে পুব আকাশ থৈ থৈ!
মনে হল এমন সকাল এই প্রথম পৃথিবীতে প্রস্ফুটিত হল
এ এক অদ্ভুত জ্যোতির প্রথম প্রকাশ অনির্বচনীয় অনন্য
অজান্তে আমার কম্পিত দুটি করপুট জোড় হয়ে গেল—
আমি ধর্মের সংস্কার বা কুসংস্কারে,
রীতি রেওয়াজে কোনদিন সম্পৃক্ত থাকিনি
সেই আমি কোন সম্মোহনে
জানিনা আচ্ছন্ন হয়ে গেলাম ,আমার অস্ফুটকণ্ঠে
উচ্চারিতহলো , হে সূর্য আদিত্য পুরুষ,আলোময় প্রকাশ
তোমার রশ্মিপাতে আমাকে আলোকিত করো,
সব মালিন্য পার করে আমি আলোময় সত্তার গভীরে
এই বিশালতায় ডুবে যেতে চাই।
আমার চোখ দুটি অজান্তেই বুজে গেলো
সমগ্র আমিত্ব আমার এক হলো,
ত্রিবেণীর ধারাস্রোতে রশ্মিস্রোত একাকার হয়ে
আমাকে জড়িয়ে পরম মমতায় এক অদ্ভুত খেলায় মাতলো
আর রক্তাভ সে আলোতে স্নাত হয়ে বিশাল ব্যাপ্তির জগৎ
আমার সামনে দোলে উঠল,
কোন কালের ওপার থেকে
বর্তমানের উন্মুক্ত প্রসারে বিস্তৃত এক মহামানবের ধারা
এক অনাদি চলিষ্ণু স্রোত সঙ্গমে এসে মিলেমিশে একাকার।
চলিষ্ণু এই ধারা অতীত অন্ধকার থেকে যাত্রা শুরু করে
মহা পাদ-পরিক্রমায় বর্তমান থেকে ভবিষ্যতের পরিধি
ছুঁয়ে আছে।
আমি কেঁপে উঠলাম
আমি তো আর আমি নই বিশাল সমগ্রে ক্রমে
বিলীন হয়ে যাওয়া কী এক অনুভূতি, কী তা জানিনা!
মনে হলো আমার সমগ্র দেহ চোখ মুখ সারাটা অবয়ব
অলৌকিক অন্য আলোয় অভিষিক্ত হলো,
আমার আমি অন্য অনুভবে উঠলো কেঁপে,
এই আমি আমি নই
বিশাল এক সমগ্রে ধীরে ধীরে যেন বিলীন হয়ে যাচ্ছি
কোন সে বিস্মৃত কালে কোন এক বিশাল আমি
বিচ্ছিন্ন সব আমিকে গ্রাস করে গড়ে উঠেছি অনন্য আমি।
এই আমি কাল কালান্তরে প্রশ্ন করেছে
জন্ম সত্য জীবন সত্য মৃত্যুও সত্য প্রত্যক্ষ গোচরে।
তারপর? তারপর কি অজস্র অসংখ্য প্রাণকণা
নক্ষত্রের মত একত্রিত হয়ে মিশে যায় আকুল প্রার্থনায়
বিবিক্ত বোধের চিরন্তন এককে?
সেই এককের সন্ধানী তো
হইনি আমি,ভাবনার ঘরেও ঢুকিনি।
এক প্রচণ্ড ‘না’ এর ঘোরতর চক্রে আবর্তিত হয়েছি শুধু।
আজ সেই না অন্য এক অনুভূতিতে ঈশ্বর নয়,
অবিচ্ছেদ্য অন্য এক মানবযাত্রীর
প্রাণের চলমানতার বিপুল চেতনায় আমার আমিকে
অহংকে যুক্ত করলো জানালো আমি কেউ নই
বহুযুগের অত্যাশ্চর্য এক বিশ্বাসের কণামাত্র!
মনে হলো জন্ম জীবন মৃত্যুর তোরণ পেরিয়ে
সেই প্রাণকণা পৌঁছে যায় সেই বৃহৎ আমিতে।
আর সেই বৃহৎ আমির রহস্য সেদিন ত্রিবেণী সঙ্গমে
প্রভাতী সূর্যের প্রথম আলো আমার অনুভূতির
তারে তারে অতীন্দ্রিয় ঝঙ্কার তুলেছিলো।
এই আমি সীমায়িত আমি ক্ষুদ্রত্বের বন্ধনে বাঁধা
মহাকাশ তলে ত্রিধারার সঙ্গমে বিভাষিত আলোর মহিমায়
ক্রমশঃ গলে গলে আরেক অস্তিত্বের ঘরে প্রবেশ করছি।
যেখানে জন্ম – জীবন- মৃত্যু কালের ছন্দে নেচে নেচে
চরম পরম একে মিশে যায়, নেই আর পৃথক সত্তা
অস্তিত্বের দ্বন্দ্ব নেই বিক্ষুব্ধ যাপন সংগ্রামও নেই।
সেই পরম বৃহৎ সত্তার স্বরূপ সে মুহূর্তে সম্পূর্ণ মূর্তিতে
প্রকাশিত হলো সুখ দুঃখ আনন্দ বেদনা রহিত রূপে
আমি সেই নির্লিপ্ত ব্যাখ্যাতীত আনন্দ প্রবাহে
সমগ্র আমিকে নিয়ে একীভূত হয়ে যাচ্ছিলাম।
“বাবুয়া রে তু কাঁহা রে ? একবার তু আযা বিটোয়া
আযা বিটোয়া আযা না রে”-একী আত্মা কাঁপানো
বুকের পাঁজর চূর্ণ বিচূর্ণ করা আর্তনাদ! সঙ্গমের
সেই উত্তাল জলে ঘূর্ণি তোলে আর্ত পিতার আর্তনাদ
আমাকে আবার কাঁপিয়ে দিল,আমার সমগ্র আমিকে
আমার অস্তিত্বের ঘরে প্রবল ধাক্কা দিয়ে জাগিয়ে দিল।
শিশু পুত্রের সর্বশেষ দেহাংশের বিসর্জন এ বেদনা
ব্যাখ্যাতীত নির্মম সত্য, এ কান্না অমেয় মমত্বের প্রতীক,
জীবনের সার সত্য অস্তিত্বের আকাঙ্ক্ষার বিমূর্ত প্রতিভাস।
সে মুহূর্তে মনে হলো জীবনই তো চরম পরম প্রাপ্তি
একবারই মেলে যা, এই পথে এগিয়ে যেতেই হয়
যায় না তো ফেরা । আমার আমিত্ব আর বিশ্বের সাথে
গভীর আত্মীয়তার মহান সে উপলব্ধি জীবনই তো দেয়
অন্য কেউ অন্য কিছু নয়,নেই শক্তি কারো
এই প্রাপ্তির মূল্য শোধিবার।
কাজরী,
২৭ জানুয়ারী, ২০১৫
0 comments: