লেখা-লেখি

খাদানের ছেলে

৬:৫৬:০০ PM 0 Comments










© সুনীতি  দেবনাথ
   


একটা ছবি দেখে সে পাগল হবার জোগাড়। নীলচে পাহাড় যেন এই সামনেই। খাড়া মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে। সে পরিত্যক্ত কয়লা খাদানের ঠিক সামনে। রেলের লাইন অযত্নে শুয়ে আছে। সেই কোনকাল থেকে কেউ জানে  না। এখানে জনমানুষের চিহ্ন নেই। ওপাশে শুরু হয়েছে চাবাগান। দূরে আবছা ব্রিটিশ আমলে তৈরি গলফ ক্লাবের সুদৃশ্য বাড়িটি।
   সে প্রায়ই সুযোগ পেলে এখানে আসে। আজো এসেছে। এসে দেখতে পেল ছবিটা। খাদানের অন্ধকার গর্ত থেকে বিশাল এক অজগর সাপ একটা মানুষকে কব্জা করে গিলছে। সে বুঝতে পারছে না মানুষটা কে। সামনে এগোনোর মত বুকের পাটা তার নেই। উঁকি মেরে স্পষ্ট দেখলো লোকটার মুণ্ডু থেকে গেলা শুরু করে বুক অব্দি গিলে ফেলেছে। চেনার কোন পথ নেই। খুব ধীরে কব্জা করে গিলছে। এমন বীভৎস দৃশ্য সে আগে দেখেনি। সমস্ত শরীরটা তার কেমন জানি ঝিমঝিম করতে  লাগলো। না ভয় নয়, কি এক অন্য অনুভূতি তাকে পাঁকে পাঁকে জড়িয়ে ধরলো। ঠিক যেভাবে অজগরটা মানুষটাকে জড়িয়েছে।
      এখানে মানে এই কয়লা খাদানে তার বাবা সেই ব্রিটিশ আমলে কাজ করত। সে তখন ছোট্টটি। কত হবে বয়স? তিন বা চার? মাঝে মাঝে আসতো বাবার সঙ্গে। বাইরে ঐ বটগাছের তলায় দাঁড়িয়ে হা করে কর্ম ব্যস্ততা  দেখতে পেতো। সামনে এগোনো নিষেধ। বাবাও সেদিন বাইরে  কাজ করতো। কয়লা বোঝাই ট্রলি টেনে লাইনের কাছে নিয়ে যেতো। বাবাকে কালো ভুতের মত মনে হতো। অসুরের মত শক্তি বাবার। মনে মনে ভাবতো বড় হয়ে  ঠিক বাবার মত হবে, ট্রলিগুলো ঠেলে ঠেলে নিয়ে যাবে। কী মজা!
   সকাল থেকে শুরু হতো কাজ। চলতো সন্ধ্যে অব্দি,    দুপুরে আধা ঘন্টা ব্রেক। খাবার খাওয়া, জল খাওয়া এরই ফাঁকে সঙ্গীদের সঙ্গে খানিকটা খিস্তি, খানিক সুখ দুঃখের ভাগ বাটোয়ারা। ওদের মুখে কোনদিন হাসি দেখেনি সে। অবাক হতো ওরা হাসতে ভুলে গেছে নাকি! মুখ সব সময় গুমড়ো, চোখে ঘৃণা আর ধিকিধিকি আগুন। এটাই সে দেখেছে সারাটি শৈশব।
     বাবার সেদিন ট্রলি দিয়ে কয়লা  টানার কাজ, তাকেও সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিল।ঘরে তার মন বসতো না মোটে । ছটফট করতো  মনটা।মা সারাদিন সংসারের কাজ করেই চলেছে।কথা বলার সময় নেই। দূর নদী থেকে সারাদিনের জল, সব কাজের জল টানাই তো বিরাট কাজ। তারপর রান্নাবান্না, ঘরদোর সাফসুুতরো করা এসব তো ছিলই। বাড়তি কাজ পিংলির জন্য ঘাস কাটা, দশ বারোটা মোরগ পায়রার যত্ন আত্তি করা,  আরও কতকিছু। পিংলি তার মা মঙলীকে হারিয়ে এখনো মায়ের অভাব টের পায়নি। মঙলী তাদের কম দুধ খাওয়ায়নি, একদিন পেট ফুলে ছটফট করে মরে গেল।  বেচারী মা খাবার সময় পেতো না ওর সাথে কখন কথা বলবে? তার বাবা মানুষটা  খারাপ ছিল না । বস্তির আর আর মরদের চাইতে আলাদা ছিল। মদ গাঁজা খেতো না, বৌকে পেটাতো না। সন্ধ্যের পরপর খানাপিনা শেষ করে শুয়ে পড়তো।কেরোসিনের আকাল। বাতি জ্বালানোর উপায় নেই। অন্ধকারে পাশাপাশি শুয়ে তিনটি প্রাণী। সে চুপ, নিঃস্পন্দ। মা বলতো, ওকে ইস্কুলে পড়াবো। ও তো আমাদের একমাত্র ধন। বাবা ঘুম জড়ানো গলায় বলতো, হু, এরপর কলেজে  ...। বাবার কথা ঘুমে ডুবে যেতো। সে অন্ধকারে সাঁতার কাটতো। পাঁচ মাইল দূর। তারপর অরণ্যের পথে হাঁটতো। উঁচুনীচ পথ, কাঁকড় বিছানো, খোঁচা লাগে পায়ে। একটু পাশ কেটে আধমরা ঘাসের উপর দিয়ে যেতে গেলে চোরকাঁটার জ্বালানি। জামাকাপড়ে গেঁথে একসা। তারপর আর স্বপ্ন নেই। ইস্কুল বাড়িটা সে তখনো দেখেনি কিনা।
    আরেকদিনের ঘটনা। বাবার সাথে গেছে। বাবা বাইরে কাজ করছে। সে যথারীতি বটগাছের তলায় বসে।  এমন সময় গাড়ি চেপে এক বাবু এলেন। সাদা পোশাক পরা, মাথায় সাদা হ্যাট পরা। কুলি লাইনে দৌড়ঝাঁপ। বড় সাহেব ইনি। সে চিনত ভয় ভয় লাগতো তার। সর্দারকে সাহেব কি বললেন। অন্যরাও শুনেছে মনে হলো তার। কারণ মুহূর্তেই কে যেন সবার মুখে একপোঁচ কালি লেপ্টে দিল। তার বাবা করুণভাবে তার দিকে তাকিয়ে মাথা নিচু করে সবার সাথে খাদানের দিকে যেতে লাগলো। ওরা ভেতরে ঢুকে গেল সবাই। সাহেব ফিরে গেল। কিন্তু ভেতর থেকে কেউ বেরোলো না। খাবার সময় পেরিয়ে গেলো, তখনো না। খিদেতেষ্টায় তার শরীর ঝিমঝিম করছিল। সে শুয়ে পড়লো গাছতলায়। এমন সময় ভয়ঙ্কর এক শব্দ। মেঘগর্জনের চেয়েও জোরালো।  এই শব্দটি সে চেনে। খনিতে কয়লার স্তর ভাঙা হচ্ছে। বিস্ফোরণ! আশপাশের মাটি থরথর কেঁপে উঠলো। ভয়ে তার বুক কাঁপছিলো। তার গলায় কি যেন দলা পাঁকিয়ে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে যাচ্ছিল। কারণ খাদানে যতবার এমন শব্দ হতো ততবারই বস্তিতে কারও না কারও ঘরে কান্নার রোল উঠত। হয় কেউ মরে যেতো আর নয়তো হাত পা এমনি কোন অঙ্গ হারাতো। মানে বেকামা হয়ে যেতো। মানে সারা পরিবারের পেটের ভাত খতম হতো।
          খিদে আতঙ্কে কখন সে জ্ঞান হারিয়েছিল জানেনা। যখন সে গাছতলায় ঢলে পড়লো তার মনে হচ্ছিল অতল জলের তলায় ডুবে যাচ্ছে। চারপাশে ঠাণ্ডা জল তাকে গিলে ফেলছে। আর কিচ্ছু মনে নেই। সে একটা গুনগুন কান্নায় যেন জেগে উঠছিল। অনেকজনের ফিসফিস কথা ঢেউয়ের মত তাকে ধাক্কা দিচ্ছিলো। সে চোখ মেলল। মুখ ঘুরিয়ে এদিক ওদিক দেখতে চাইলো। কেমন যেন ছায়া ছায়া, একটুকরো রোদ ছোট্ট জানলা দিয়ে ছলকে তার মুখে পড়লো। এবার স্পষ্ট দেখলো বস্তির এঘর ওঘর সেঘরের অনেক মুখ উদ্বিগ্ন হয়ে তাকে দেখছে সে ঘরের বিছানায়। বাবা কোথায়? মা? সে চিৎকার করে ডাকতে চাইলো, কোন শব্দ তার গলা দিয়ে বের হলোনা।
     সে আর কোনদিন কথা বলতে পারেনি। বিস্ফোরণে বাবার একটা পা গিয়েছিল, সেই সঙ্গে কোলিয়ারীর কাজও। বেচারি মায়ের মাথায় পুরো নাগা পাহাড়টা চেপে বসলো। ভোরে উঠে দু'মাইল দূরে বাবুপাড়ায় ঠিকে কাজে যেতো। বেলা পড়ে যাবার সময় ঘরে ফেরা।মা একদিন কাজ করে করে কুঁজো হয়ে গেলো। সে ধীরে ধীরে যুবক হলো। ইস্কুল কলেজের স্বপ্ন বড়গোলাই ইস্টিশনের কু ঝিকঝিকে হারিয়ে গেল। সে এখন রেলের কুলি। তার হাতে তৈরি ক্রাচে ভর করে বাবা বেশ এদিক ওদিক চলাফেরা করে। বাবা গাঁজার আসরে এখন নিত্য সদস্য। রাতে কুঁজো মাকে পেটাতেও দক্ষ।
   বোবা সে বুকে  কী এক আগুন নিয়ে যখন ছারখার, তখন কাজ ভুলে খাদানের পথে হাঁটে। খাদান এখন জনশূন্য। মৃত্যুপুরী। সে আর কালের সাক্ষী বটগাছটা জড়াজড়ি করে দাঁড়িয়ে থাকে। হয়তো কখনো একদল হরিণ ছুটে এসে থতমত খেয়ে  পালিয়ে যায় ওদের দেখে। সে দেখেও দেখে না। আর একটু দূরের নাগা পাহাড়টা আরো  উঁচু হয়ে উঁকি দিয়ে তাদের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে। আজও তাই হলো।
     হঠাৎ  ঐ ছবি। অজগরটা আরেকটু গিলেছে মানুষটাকে। সে নির্বিকার এখন। সে দেখলো দূরে শুয়ে থাকা একটা ক্রাচ। দেখলো একঠ্যাঙা মানুষটাকে এখন পুরো কব্জা করেছে সাপটা। বাবা বলে আকাশ ফাটিয়ে চিৎকার করার ইচ্ছেটাও তার এখন হলো না।

২৩ মার্চ, ২০১৫

SUNITI Debnath

আমি সুনীতি দেবনাথ, অবসরপ্রাপ্ত সরকারি শিক্ষিকা। কবিতা, প্রবন্ধ ও ছোটগল্প লিখি। কবিতা আমার প্রিয়ভূমি, শৈশব থেকেই হেঁটে চলেছি...

0 comments: