লেখা-লেখি

একজন সুনীতি দেবনাথ ও লাবণ্যলতা

২:৫১:০০ PM 0 Comments


মোহাম্মদ খয়রুজ্জামান খসরু


বাংলা সাহিত্যে আধুনিকতার ছোঁয়ায় যখন স্বকালের বন্ধ্যাত্ব, নৈরাশ্যবাদিতা, পাশ্চাত্যের অনুকরণে মেকি নগর-যন্ত্রণা আর সর্বগ্রাসী বিনষ্টি বিমানবিকীরণের আগ্রাসন চলছে তখন কবি সুনীতি দেবনাথ তাঁর কবিতায় দেশজতা,মানবিকতা,সাম্যবাদ,লোকজ ঐতিহ্য, নাগরিক চেতনাসমৃদ্ধ জগৎ ও জীবনঘনিষ্ট প্রাজ্ঞতার বর্ণনা দিয়ে আকৃষ্ট করেছেন পাঠককে। কবিতার হাত ধরে কবি ঘাত-প্রতিঘাতময় জীবনের নানা দিক নিয়ে নির্দেশনামূলক কবিতা লেখার পাশা পাশি সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় সরব উজ্জ্বল উপস্থিতি দৃশ্যমান।  ২২শে জুলাই ২০১৫ সালে লিখিত "ফিরে এসো লাবণ্যলতা" কবিতাটি সম্পর্কে হালকা আলোচনা করার প্রয়াসে এ লেখা। এখানে পুরো কবিতাটি তুলে ধরছি যাতে পাঠককে  রস আস্বাদন করতে বেগ পেতে না হয়।

    ফিরে এসো লাবণ্যলতা


যেন কালান্তরের ওপারে আজো ছায়া খেলে
বিস্মৃত অতীতের বাতায়নের স্মৃতি সব মগ্ন থাকে
তাই বর্তমান হারিয়ে ফেলে বেঁচে যেতে হয়।
কুয়াশাচ্ছন্ন অতীতের ঘ্রাণের চেতনাতে
আমার অতীত জুড়ে তোমার আঁচল পাতা--
তুমি নেই বলে আমিও হারিয়ে যাই অন্য দিগন্তে,
এ নদীর জল যেন জল নয় আগুনের স্রোত
সূক্ষ্ম সেতু পার হয়ে ওপারে যেতে হয়।
যারা চলে যায় ফেরেনা কখনো
তুমিও গিয়েছো চলে সে কতদিন আগে
বিভ্রান্ত মন সে হিসেবও গেছে ভুলে,
তবু মনে হয় যাওনি তো এই আশেপাশে
মল্লিকার মৃদু সুগন্ধি ছড়িয়ে তুমি সত্য হয়ে আছো!
তোমার শীতল স্পর্শ এখনো মাতাল করে
মৃদু কলভাষ আমার আত্মাকে ঘিরে
কলমন্দ্রে সারাবেলা কত কথা বলে যায়।  
লাবণ্যলতা,আমার চৈতন্যের ভাবঘরে
ভাবুকলতা হয়ে স্বর্ণলতার মত জড়িয়ে ছিলে,
আজ তুমি নেই তবু আছো আমার সত্তায়
আমার অজান্তে কোন অদ্ভুত ক্ষণে
তুমি আমি মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছি,
আমি তে জানি না, তুমি জানো কিনা
তাও তো অজানা।
আজ বিষন্ন এই সন্ধ্যার বিষাদিত সন্ধিক্ষণে
যখনই ভাবি আমার সৌর সংসারের
কোনখানে তুমি নেই অন্য কোন সূর্যের
অন্যতর আলোকিত পথে তুমি চলেছো,
মহিমান্বিত বলয়ের পর বলয় পেরিয়ে
অন্য কোন পরম প্রাপ্তির চরম বাসনায়,
আমার সারাটা অন্তর হঠাৎ কেঁদে ওঠে
আর অস্তিত্ব কেঁপে কেঁপে শূন্যতায় বিলীন,
বলো কার হাত জড়িয়ে ধরে স্বস্তির অন্তরে যাবো?
লাবণ্যলতা,কোন পথে সৃষ্টির নিখাদ সত্য
সুবিমল ধারাপথ নিত্য প্রবাহিত জানি না তা,
এবার তুমি ফিরে এসো লাবণ্যলতা
আমার অন্দর বাহিরে অনাদি অনন্ত
আলোকময় প্রশান্তির পথে এবার
হাত ধরে নিয়ে যেতে তোমাকেই চাই।

আলোচ্য কবিতাটিতে পরাবাস্তবতা এত নিখুঁতভাবে চিত্রায়িত যা একজন অতি সাধারণ পাঠকের দৃষ্টি কেড়ে নিতে সক্ষম। কবিতার উপমা ও উৎপ্রেক্ষাগুলো প্রতীক ও রূপকার্থে ব্যবহৃত হওয়ায় এগুলো খুবই মনোগ্রাহী হয়ে উঠেছে। কবি সুনীতি দেবনাথ এ কবিতাটিতে মিথের ব্যবহারও করেছেন সুদক্ষতার সাথে। মূলতঃ কবি ইহলৌকিক জগত হতে পারলৌকিক জগতে অপেক্ষমান কোন এক জনের হাতছানির দিকে অপলক চেয়ে আছেন। আমরা এ কবিতাটিতে কখনো দেখি পার্থিব সুখাচ্ছাদিত কবি অতীতের টানে নিজেকে অনুভব করেন আবার মোহগ্রস্ত ক্ষণটুকু হারিয়ে চলে যান তীর্থলোকে প্রিয়জনের সান্নিধ্যে। চর্মচোখে দেখা যায়না এমন এক জগতের টানে কবি বলেন---

"সূক্ষ্ম সেতু পার হয়ে ওপারে যেতে হয় "

এখানে যে মিথের ব্যবহার তা  ধারণিক জীবনের বোধ ও বিশ্বাসের মাত্রাকে গাঢ় করে তুলে। চুলচেরা বিশ্লেষণ করলে এখানে প্রস্ফুটিত বোধ ও বিশ্বাসটুকুই মানবাত্মার পরম গন্তব্য স্থান।
কবিতাটিতে পার্থিব জীবনের নানা সুখময় দিনের অনুভূতিটুকু বর্ণনা করা হয়েছে চমৎকারভাবে --
"তোমার শীতল স্পর্শ এখনো মাতাল করে "
এ স্পর্শ কাতরতাও কবি মনে বারবার দোলা দিয়ে উঠে দমকা হাওয়ার মত । কবি কোন কিছুতেই নিজেকে স্থির রাখতে পারেন নি। একাগ্র চিত্তে উদগ্রীব হয়ে----

অন্য কোন পরম প্রাপ্তির চরম বাসনা
দিনগুণতে থাকেন নামতা মুখস্তের মতো।
কবিতাটির পরিশেষে কবির একান্ত প্রিয়জন তার হাত ধরে নিয়ে যেতে এসে দাঁড়ান কবির দুয়ারে। আমার মনে হয় কবি সুনীতি দেবনাথ রচিত " ফিরে এসো লাবণ্যলতা" কবিতাটি কবির রচিত এ যাবত কালের সবচেয়ে সেরা। এখানে আমরা একজন সেরা দার্শনিকের বক্তব্য ও মূল্যবোধের পরিচয় পাই। আমি কবি ও কবিতাটির সর্বোচ্চ স্বীকৃতিলাভের আহ্বান রেখে আলোচনাটির পরিসমাপ্তি টানলাম।

SUNITI Debnath

আমি সুনীতি দেবনাথ, অবসরপ্রাপ্ত সরকারি শিক্ষিকা। কবিতা, প্রবন্ধ ও ছোটগল্প লিখি। কবিতা আমার প্রিয়ভূমি, শৈশব থেকেই হেঁটে চলেছি...

0 comments: