কবি আত্মার বিস্ফোরণ : আলোচনা — সুনীতি দেবনাথ
কবি আত্মার বিস্ফোরণঃ আলোচনা –সুনীতি দেবনাথ
অপাঙক্তেয়
=======
কবি-রুবেল পারভেজ
বাংলাদেশ
গ্রীক মিশরীয় আরও সব প্রাচীন সভ্যতার বিচিত্র সব মিথের ব্যবহার বাংলাদেশের বর্তমান কবিরা তাঁদের কবিতায় বেশ মুন্সিয়ানার সঙ্গে করেন দেখে কৌতূহল জেগেছিল তাঁরা কেন কবিতায় ইসলামিক মিথ ব্যবহার করছেন না। প্রশ্ন করেছিলাম হালের বাংলাদেশের তরুণ তুর্কী বহুবিচিত্র সৃষ্টিকর্মের সঙ্গে ওতোপ্রোতভাবে জড়িত কবি,তুখোড় সমালোচক, বিদগ্ধ প্রবন্ধকার, নাট্যকার, আবৃত্তিশিল্পী, ছোটগল্পকার আরও অনেক কিছু রুবেল পারভেজকে। উত্তরটা সরাসরি দেননি তিনি। মনে হয়েছিল এড়িয়ে গেলেন বুঝিবা। আধুনিকোত্তর বাংলা কবিতায় নানা পরীক্ষা নিরীক্ষা চলছেই। বর্তমান আলোচক সকল সীমাবদ্ধতা স্বীকার করে নিয়েই বলতে চাইছি কবিতায় অন্য একটা ঝোঁক বা প্রবণতা যেন হালের কবিদের মধ্যে পরিলক্ষিত হচ্ছে আর সেটা এই- কবিতায় মিথের ব্যাপক ব্যবহার, পরাতত্ত্ববাদ, বৈজ্ঞানিক বিষয়আশয়, তথ্যপ্রযুক্তির অনুপ্রবেশও ঘটছে। তার সাথে দুর্বোধ্যতার মোড়কে কবিতায় ভিন্নতর মাত্রসংযোজনের প্রয়াসও লক্ষ্য করা যায়। কবি রুবেল পারভেজ কবিতার এই পরীক্ষা নিরীক্ষায় পিছিয়ে নেই,বরং বলব বেশ দাপট দেখিয়েই দুরন্ত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছেন।
তিনি আমাকে উৎসর্গ করেছিলেন তাঁর প্রোজ্জ্বল কবিতা আফ্রোদিতি -এক অনবদ্য সৃষ্টিকর্ম, কবিতাটির সমৃদ্ধ আলোচনা করেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানিত অধ্যাপক ড.অনিরুদ্ধ বসু মহাশয়। ভূয়শী প্রশংসা করেছিলেন তিনি কবিতাটির, বিশেষ করে মিথের ব্যবহার প্রসঙ্গে। ড.বসু ভিন্ন প্রসঙ্গে ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় রুবেল পারভেজ যে প্রচুর ‘পড়াশোনা’ করে অনবরত নিজেকে পরিশীলিত করে যাচ্ছেন সে বিষয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেন। এই সেদিন কবি রুবেল পারভেজ তাঁর সাম্প্রতিক গদ্যকবিতা ‘অপাঙক্তেয়’ বিশ্ব সাহিত্য অঙ্গনে পোস্ট করলেন। কবিতাটিতে ইসলামিক মিথের,পরাতত্ত্ববাদের ব্যবহার বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে।
সত্যি কথা বলছি ইসলামিক মিথ সম্পর্কে আমার জ্ঞান নেই। তবু রুবেল পারভেজের কবিতা নিয়ে সামান্য কথা না বলে পারছি না। আমি একবার পড়লাম। কিছুই বুঝলাম না। কিন্তু কেমন যেন একটা অনুভূতি হলো, কি যেন এক বেদনা তার স্বরূপ জানিনা আমাকে জড়িয়ে ধরতে চাইলো। আবার পড়লাম কবিতাটি ঠা ঠা অট্টহাসি হেসে উঠলো। হা হা নয় ঠা ঠা। ঝনঝন করে বেজে উঠলো কবিতার শরীরে। ত্রিকাল পার হয়ে অন্য কোন জগৎ যেন আবির্ভূত হলো। আমি লাইক দিতে পারিনি, কমেন্ট তো দূর কথা। আমি কেঁদে ফেলেছিলাম। এ কেমন কবিতা যা ধরা দেয় না কাঁদায় শুধু ! আমার জেদ চেপে গেল। বারবার পড়েও পারলাম না। অবশেষে শরণাপন্ন হতে হলো তাঁর যিনি এর স্রষ্টা। তিনি হা হা অট্টহাসি হাসলেন, ‘জানতাম পারবে না’। আমার আবেদন ‘আমি ইসলামিক মিথ জানিনা’। বলে দিলেন মিথ রহস্য রুবেল পারভেজ।
এবার আমার পড়ার পালা। সারাটা শরীরে মিথ শুধু মিথ,পুরোটা কাঠামো মিথে গড়া। আর এমনই তার ব্যাপ্তি মহাকাল তার পরিসর। মিথের মহারণ্য থেকে আধুনিক কবি রুবেল পারভেজকে খুঁজে বের করা এক দুর্ধর্ষ কাজ। আপাতঃ দৃষ্টিতে এমনটা মনে হলেও আগাগোড়া যুক্তিবুদ্ধিসম্পন্ন মরমী কবিকে পেতে অসুবিধে হয়না। এই সর্বকালে অবাধ বিচরণ মনে করিয়ে দেয় লাতিন আমেরিকার নোবেল পুরস্কার বিজয়ী ঔপন্যাসিক গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের উপন্যাস One Hundred Years of Solitude-এর কথা। শুরুতেই একটা বিতর্কের সম্ভাবনাকে খারিজ করে দেয়া সঙ্গত মনে করি ভিন্নধর্মী দুটি সাহিত্য ফর্মের তুলনাত্মক আলোচনার বিষয়। ফর্ম বা প্রকরণ আমার আলোচ্য বিষয় নয় এইক্ষেত্রে,আমি ভাবগত একটা সাম্যের কথা শুধু বলতে চাই।আর তা হচ্ছে ‘ম্যাজিক রিয়ালিটি’ বা ‘মায়া বাস্তবতা’। ঐ ক্লাসিক্যাল উপন্যাসে জন্ম, মৃত্যু, ম্যাজিকেল ঘটনা, মিথ নির্ভর কিংবদন্তীর ছড়াছড়ি,আছে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে স্বচ্ছন্দ গতায়াত। অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ-মৃত্যুর পরবর্তী জীবন সবকিছু মিলে মিশে একাকার।আর লেখক কাল থেকে কালান্তরে যে অবাধ সঞ্চরণ করেন তা কিন্তু অসঙ্গত মনে হয়না। মিথের প্রান্তরে পরিভ্রমণকে মনে হয় স্বাভাবিক এবং বাস্তব। মার্কেজের ম্যাজিক রিয়ালিটির অনুসরণকারীর সংখ্যাতত্ত্বে সন্তোষ প্রকাশের কারণ নেই। সাহিত্যে পরিবর্তনের পথে রীতি প্রকরণ শৈলী ভাবধারায় বিবর্তন গ্রহণ বর্জণ গ্রাস আত্তীকরণ অনুসরণ এসবের মাঝখান দিয়ে বয়ে যায় নতুন সৃষ্টির ধারা। নতুন ধারা সৃষ্টি হলে তার অনুসরণ সাহিত্য জগতে নিত্য নৈমিত্তিক বিষয়। তবে ব্যতিক্রমও দুর্লক্ষ্য নয়। একটা উদাহরণ উদ্ধৃত করা অপ্রাসঙ্গিক হবেনা। নাট্যরীতির জগতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিশ্ব পটভূমিতে একেবারে নতুন অভিনব এক ধারার স্রষ্টা এবং প্রকৃতই এই ধারা আশ্চর্য সৃষ্টি। তবু বলতে হয় রবীন্দ্রনাথের এই ধারা রবীন্দ্রনাথেই শুরু শেষও রবীন্দ্রনাথে। বিগত শতকে মার্কেজের সৃষ্ট মায়া বাস্তবতার ধারাতেও তেমন প্রবল কোন অনুসরণের হিড়িক লক্ষ্য করা যায় না। বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করলাম দুরূহ ম্যাজিক রিয়ালিটির প্রভাব যেন রুবেল পারভেজের আলোচ্য কবিতায় সুস্পষ্ট। মিথোলজির পথ ধরে রুবেল পারভেজ ধর্মীয় বাতাবরণের সৃষ্টি করলেও তিনি এই সময়ের মানুষ। তিনি ইসলামিক মিথের সহায়তায় সৃষ্টি স্থিতি প্রলয়, ভাল মন্দের দোলাচলতা, সৎ অসতের দ্বন্দ্ব, পাপ পুণ্যের ব্যবধান, নৈরাশ্যের অতলে অবগাহন করে পুনরুত্থানের আশা দেখেন।তাঁর গতায়াত জন্ম জীবন ধর্ম অধর্মের সংঘাতে জর্জরিত মানবাত্মার আকুল উতরোল ক্রন্দন আর্তি আর বিস্ফোরণ মহাপ্রলয়ে যার পরিণাম পুনরুত্থান। কিন্তু সে পুনরুত্থান অতীত থেকে বর্তমান ভবিষ্যৎ পেরিয়ে মহাকালের ধুসর প্রান্তরে। মিথের হাত ধরে তাঁর এই পরিক্রমণ মার্কেজের ম্যাজিক রিয়ালিটির মতই অনায়াসগামী স্বচ্ছন্দ। এক বিভ্রান্ত অন্ধকার। আশাহীন নিরপত্তাহীন নৈতিক অবক্ষয় আর রক্ত নিয়ে হোলি খেলার সময় এখন। ক্ষমতাদর্পী বলবানের আস্ফালন চূর্ণবিচূর্ণ করে নিচে থাকা সাধারণ মানুষের জীবনকে। কোন আশা কোন নির্ভরতা নেই। কবির ভাষায়,
একদিন অপাঙক্তেয় হয়ে যাবো
ক্রুশবিদ্ধ যীশুও আমার
দিকে ফিরে তাকাবেন না
মধ্যরাতে শিয়ালে ছিঁড়ে খাবে
জোছনা বিলাসী সুখগুলো,
এই সময় নিরাশার কালো থাবায় কবির আত্মা অস্তিত্বকে খাবলে ধরে।অনিবার্য পরিণতি ধ্বংসকে প্রত্যক্ষ করেন কবি ‘অপাঙক্তেয়’হয়ে যাবেন। হতাশা এমনি গভীর এ অপাঙক্তেয়তা মানে পায় মৃত্যুর। ক্রুশবিদ্ধ যীশুর উপমা দলিত নিপীড়িত দুর্গত মানুষকে যথাযথ বিশেষিত করেছে।অসহায় মানুষ আত্মরক্ষায় অপারগ। কে কার সহায় হবে? আর কী অনুপম উচ্চারণ ‘জোছনা বিলাসী সুখগুলো’! কবি থাকবেন না, থেকে যাবে তাঁর পার্থিব সুখ জোছনার মত নরম আলোমাখা প্রিয় সন্তানেরা আগামীর মানুষ,ধূর্ত শেয়ালরূপী ঘাতক মানুষ এদের ‘ছিঁড়ে খাবে’। যদি তাঁর প্রিয়তমা পত্নী বেঁচে থাকেন,না ভাল থাকবেন না তিনিও। কবি এই বিষাদিত ক্ষণে ভয়ঙ্কর মিথের সহায়তায় পাড়ি দেন অতীতের ভয়াবহ হারানো দিশায়। বর্তমান যে কত ভয়াল তা যেন অতীত বিভীষিকার মত।‘মনসুর হাল্লাজ’ আল্লাহ্র অস্তিত্বের সাথে একাত্ম হয়ে আর ‘আজদোহা ফেরাউন’ ক্ষমতা দর্পে একদিন নিজেকে সর্বশক্তিমান আল্লাহ্ ভাবতে লাগলো,গগনভেদী চিৎকারে ধ্বনিত করলো ‘আনাল হক’, ‘আমিই আল্লাহ্’। সেই আকাশ ছোঁয়া দম্ভিত চিৎকার,আর আজকের অপরিণামদর্শী ক্ষমতার আস্ফালন কবি আত্মায় ‘বিদিক মাতম’ তোলে। যে মনসুর হাল্লাজ আল্লাহ্র ইবাদতে মশগুল হয়ে আল্লাহ্র সাথে একাত্ম হয়ে নিজের অস্তিত্ব ভুলে নিজেকে আনাল হক ঘোষণা করেছিল, তার খণ্ডিত দেহের টুকরো বাগদাদের দজলার নহরে কোথায় না কোথায় ভেসে গেছে।আজ বিশ্বজোড়া ক্ষমতার দাপাদাপি কি ‘আনাল হক’ প্রতিধ্বনি তোলেনা? ব্যথাতুর কবিকণ্ঠ আর্তনাদ করে উঠে, ‘বিশ্বাসে অবিশ্বাসে / বেড়ে যায় পাপপুণ্যের / ব্যবধানও’। অর্থাৎ মনসুর হাল্লাজের আল্লাহ্র প্রতি বিশ্বাস আর ফেরাউনের অবিশ্বাস। দুজনের আনাল হক উচ্চারণের অর্থ এক নয়। মনসুর হাল্লাজ আল্লাহ্র ইবাদত করতে করতে এমন একটা স্তরে পৌঁছে গিয়েছিল যে, সে কে এটা সে বোঝার ক্ষমতা হারিয়েছিল। আল্লাহ্র অস্তিত্বের সাথে লীন হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এই বিষয়টা তৎকালীন বাগদাদের লোকেরা ভুল বুঝে তাকে আল্লাহ্র সাথে শিরক করার অপরাধে মৃত্যুদণ্ড দেয়। তাঁর দেহকে কেটে টুকরো টুকরো করে বাগদাদের দজলার নহর বা নদীতে ভাসিয়ে দেয়। কথিত আছে এখনও বাগদাদের দজলার নদীতে কান পাতলে আনাল হক ধ্বনি শোনা যায়। যাকে বলে ফানাফিল্লাহ! সুফিদের মতে, আত্মার পবিত্রতার মাধ্যমে ফানাফিল্লাহ (আল্লাহর সঙ্গে অবস্থান করা) এবং ফানাফিল্লাহর মাধ্যমে বাকাবিল্লাহ (আল্লাহর সঙ্গে স্থায়িভাবে বিলীন হয়ে যাওয়া) লাভ করা যায়। এই সাধনাকে ‘তরিকত’ বা আল্লাহ-প্রাপ্তির পথ বলা হয়। তরিকত সাধনায় আবার একজন মুর্শিদের প্রয়োজন হয়। সেই পথই হলো ফানাফিল্লাহ। অপরদিকে ফেরাউন ছিল গাদ্দার যে নিজেকে খোদা দাবী করেছিল। আর শিরকের গুনাহর কোন মাফ নেই। মিশরের নীল নদে ডুবে মৃত্যু হয় আত্মগর্বী ফেরাউনের। শতাব্দী ব্যাপী যেন কল্যাণকামী মানব আত্মা কাল ঘুমে আচ্ছন্ন। যেমন,
শতাব্দীর ঘুম ছেড়ে বিস্মিত
আসহাবে কাহাফের কিতমিন
সত্যের খোঁজে ইসতাফানুস
হাজার বছর ঘুরে সালমান ফারসী
পাঁচ সত্যসন্ধানী মুসাফির কুকুর কিতমিনকে সঙ্গে নিয়ে সফরে বের হয়ে শ্রান্ত ক্লান্ত দেহে পর্বত গুহায় ঘুমিয়ে পড়েছিলো এক কাল ঘুমে।পাঁচশো বছর পরে সে অদ্ভুত ঘুম ভেঙ্গে গেলে জানতে পারলো দুনিয়া কত বদলে গেছে! পাঁচশো বছরের প্রাচীন মুদ্রার মত তারাও অচল মাল এই পরিবর্তনশীল দুনিয়ায়। কবি যেন বলতে চান তাঁর সমাজ প্রতিবেশ এমনি কাল ঘুমে নিমগ্ন। চারপাশের বিশ্ব কত দ্রুতগতিতে প্রগতির পথে দুর্নিবার বেগে গতিশীল। স্থিতিশীলতা মৃত্যুর নামান্তর, গতিশীলতা জীবনের ধর্ম। সমগ্র বিশ্ব চরাচরে গতিই তো প্রাণসত্ত্বা। অথচ শতাব্দী প্রাচীন সমাজে আজ কত অন্যায় কত অবিচার পর্বত প্রমাণ বন্ধনস্তুপ হয়ে সমাজ দেশ জাতিকে পাঁচশো বছরের ঘুমের দিকে অবধারিতভাবে ঠেলে দিচ্ছে।
আত্মঘাতী এই সম্ভাব্য পরিণাম কবিকে বিপন্নতার খাদের সামনে যেন দাঁড় করিয়েছে। অথচ একদিন সত্যসন্ধানী ইসতাফানুস ‘হাজার বছর ঘুরে’ সত্যদর্শী সালমান ফারসী হতে পেরেছিলো। আর দাম্ভিক আযাযীল হলো জঘন্যতম শয়তান ইবলীশ। কবি অনুভব করেন ইসলাম ধর্ম শান্তি ও মানবতার কল্যাণ কামনা করে। শান্তি যে ধর্মের মূল বাণী,মানুষকে ও
মানবতাকে যে ধর্ম প্রাধান্য দেয় সেই ধর্মাবলম্বীদের বিচ্যুতি ও হানাহানি কবিকে আহত করে, বেদনায় দীর্ণ করে। তাই কবির অন্তরাত্মা যেন বেদনায় হাহাকার করে ওঠে,
নবীজীর ভালবাসায় ওয়াইজ
কুরুনি হতে পারিনি
ওয়েসিমের মত হিম
হৃদয়ে অনুশোচনার দংশন
ধর্ম জীবনকে ধারণ করে,যে ধর্মের নির্দেশকে বিকৃত করে মানুষে মানুষে বিকারগ্রস্ত ধ্বংসলীলা চলে কবি তার বিরুদ্ধে সোচ্চার। অনুশোচনা জাগে মানবতা ও শান্তির বিরুদ্ধাচারের পাশবিকতায়। কবি কবিতার শেষ পর্বে আত্ম সমাহিত। অনুশোঢনা থেকে এক চরম নিবেদনে যেন তাঁর অহং বোধকে বিসর্জণ দিতে চান। এই অংশে কবি মিথ আর জীবনের সুদকষার ঊর্ধ্বলোকে বিবিক্ত দার্শনিক। পরাতত্ত্ববাদ কবিতার এই অংশে কবিতাটিতে ভিন্নতর মাত্রা সংযোজন করেছে। সদ্অসদ বিচারের পালার ঊর্ধ্বে কবি নিবেদিতপ্রাণ, মৃত্যুভাবনায় কবি চিরসত্যকে মেনে নেন। মৃত্যু তো অনিবার্য সত্য। কবি বলেন,
ইদানীং আমার অস্তিত্বের প্রশ্নে
দণ্ডায়মান আজরাইল
এবং সিঙ্গা হাতে অনাগত ইস্রাফিল
আমিত্বের অমোঘ পারাপারে
পুনরুত্থানবাদী ‘ইয়ানাফসি’ উচ্চারণ
মহাবাণীর মহাকল্লোল।
‘ইদানীং’ কবির মৃত্যুভাবনা যেন উদগ্র হয়ে উঠেছে। ইসলামিক ধর্মভাবনায় ভাবিত কবি ভাবেন এ তো সত্য যে সৎকর্ম করবে কবরে সে কোন কষ্ট পাবেনা। অসদাচারী পাবে দুর্গতি। মুনকার আর নাকির শেষ বিচার করবে। আজরাইল যে মৃত্যুদূত আমার প্রাণ নিয়ে যাবে,পড়ে থাকবে নিথর দেহ নিস্পন্দ।আর সিঙ্গা হাতে দাঁড়িয়ে আছে ইসরাফিল। আল্লাহ্ নির্দেশ দিলে সে সিঙ্গায় দেবে ফুঁ। শুরু হবে মহাপ্রলয় ! ধ্বংস হবে পৃথিবী নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত আমরা জানি মৃত্যু অবধারিত, শেষের সে খেয়ায় এপার থেকে ওপারে যেতেই হবে। তবে এতো বিভেদ কেন ? কেন এতো উন্মত্ত হিংসার উলঙ্গ নৃত্য ? জানি পুনরুত্থানবাদী ইসরাফিল আবার সিঙ্গায় ফুঁ দিলে আবার সৃষ্টি উঠবে জেগে । যে যেখানে সমাধিস্থ ছিল আবার জেগে উঠবে। জ্বলন্ত সূর্যটা থাকবে মাথার খুব কাছে। কেউ কাউকে চিনবেনা। চিনলেও কেউ কারো দিকে তাকাবে না। হাশরের সেই আসর ‘ইয়াফানসি’,হায় আল্লাহ্ চিৎকারের হুতাশ ধ্বনিতে আকুল হয়ে উঠবে। সেদিনই নিশ্চিত হবে কে যাবে বেহেস্তে আর কে যাবে দোজখে ! মৃত্যু মানে যে শূন্যতা, এই শূন্যতা যে কতো নিষ্করুণ শেষ পংক্তিগুলিতে কী নিদারুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন কবি, তা অবর্ণনীয় কাব্যসুষমা মণ্ডিত। হাহাকার কবির কাব্য ভাষা স্তব্ধ করে দেয়। নিঃসন্দেহে বাংলা কাব্য সাহিত্যের এক কালজয়ী সৃষ্টি এই কবিতা।
অপাঙক্তেয়
------------------
রুবেল পারভেজ
একদিন অপাঙক্তেয় হয়ে যাবো
ক্রুশ বিদ্ধ যীশুও আমার
দিকে ফিরে তাকাবেন না
মধ্যরাতে শিয়ালে ছিঁড়ে
খাবে
জোছনা বিলাসী সুখগুলো,
আমার মগজের কোষে অনুরণিত হয়
মনসুর হাল্লাজ আর আজদাহা
ফেরাউনের
‘আনাল হক’ চিৎকারের বিদিক
মাতম
বিশ্বাসে-অবিশ্বাসে বেড়ে
যায় পাপ-
পুণ্যের ব্যবধানও
শতাব্দীর ঘুম ছেড়ে বিস্মিত
আসহাবে কাহাফের কিতমিন
সত্যের খোঁজে ইসতাফানুস
হাজার বছর
ঘুরে সালমান ফারসী
দম্ভের অনলে আযাযীল শাপভ্রষ্ট
ইবলীশ
নবীজীর ভালোবাসায় ওয়াইজ
কুরুনি হতে পারিনি
ওয়েসিসের মত হিম হৃদয়ে
অনুশোচনার দংশন
মুনকার-নাকির কড়ায় গণ্ডায় বুঝে
নেবেন
বেহিসেবী জীবনের সুদকষা
ইদানীং আমার অস্তিত্বের
প্রশ্নে দণ্ডায়মান আজরাইল
এবং সিঙ্গা হাতে অনাগত
ইসরাফিল
আমিত্বের অমোঘ পারাপারে
পুনরুত্থানবাদী ‘ইয়া নাফসি’
উচ্চারণ
মহাবাণীর মহাকল্লোল।
0 comments: