শোষণ মুক্তি আর স্বাধীনতার গান
।। ©সুনীতি দেবনাথ।।
কৃষ্ণ আফ্রিকার অরণ্য ছায়ায় মাথা উঁচু করে
দাঁড়ানো মানুষটি আজ চিরনিদ্রায় নিদ্রিত।
সাড়ে ছ’ফুট বাই পাঁচ ফুট ঘরে একটিমাত্র বালিশ
আর হতশ্রী কম্বলটি নিয়ে কত বিনিদ্র রাত
হাঁটু মুড়ে শুয়ে কাটিয়েছেন তিনি সাতাশ বছর
তার হিসেব তো নেই—সেই তিনি আজ নিদ্রিত।
হীরার দেশের মহত্তম কালো হীরাটির অত্যুজ্জ্বল দ্যুতি
আর কোনদিন ঝলসে উঠে কালো মানুষের অশ্রু মুছাবেনা।
আহ্! ডালিভুঙ্গা, আহ্! ডালিভুঙ্গা, আহ্! ডালিভুঙ্গা!
প্রতিদল আপনজন সমবেত চিৎকারে তিনবার করে
ঐতিহ্যমণ্ডিত প্রথায় সুপ্রাচীন রীতিতে
বুক উজাড় করা ভালবাসায় মাখামাখি করে
শ্রদ্ধা জানালো তাঁকে, সেই তাঁকে—
দক্ষিণ আফ্রিকার কালো মানুষের মুক্তির দূত যিনি,
স্বাধীন দক্ষিণ আফ্রিকাকে যিনি ছিনিয়ে আনলেন
শ্বেতাঙ্গ শাসক প্রভুর নিষ্ঠুর হাত থেকে।
প্রিয় মাদিবা,তোমাকে কতটুকু শ্রদ্ধা জানালে
তার পরিমাপ হবে ঠিকঠাক ? সারা বিশ্বের অগুন্তি
মানুষের ভালবাসা ও শ্রদ্ধা একত্রে উজাড় করে দিলে
মনে হয় তাও বড় কম হবে তোমার মত বিশ্বনেতার জন্য।
সারা দুনিয়ার নিপীড়িত, লাঞ্ছিত, অপমানিত মানবতা
আজ নির্বাক হয়ে, শোকস্তব্ধ হয়ে তোমাকে ভালবাসা দিয়ে
অভিনন্দন জানায় তোমার লং ওয়াক টু ফ্রিডমের জন্য,
মুক্ত কালো মানুষের স্যালুট গ্রহণ কর নেলসন ম্যাণ্ডেলা!
এদেশের এক ক্রীড়া সাংবাদিক তোমার সাক্ষাৎকার
নেবার সুযোগ নাকি পেয়েছিলেন, বড় ভাগ্যবান তিনি।
তোমাকে লোকে আফ্রিকার গান্ধী বলে, তাঁর দর্শনের অনুগামী বলে।
তোমার সঙ্গে বার্তালাপের জন্য গান্ধীর দেশের সেই সাংবাদিক-
কৃষ্ণ আফ্রিকার উজ্জ্বলতম হীরক খণ্ডের একান্ত সাক্ষাৎকারে উন্মুখ,
এমনি সময় নামল বৃষ্টি ঝম্ ঝম্, আকাশভাঙ্গা বৃষ্টি।
উন্মুখ মানুষটি কাতর বিহ্বল – হলোনা বুঝিবা!
তুমি কিন্তু সঠিক সময়ের এক মিনিট আগেই এলে।
তোমার মুখে সেই হাসি যে হাসি বিশ্বকে উল্লসিত করে,
যে হাসি কালো রঙের ভাঁজ ফেলা মুখের আস্তরে
আলোর ঝলক তুলেছিল, যেন কতদিনের চেনা আপনজন।
সেই হাসিতে জোহান্সবার্গের চার নম্বর টার্মিনালকে
আলোকিত করে বলেছিলে, বুঝিনা গান্ধীর দেশে এতো রক্ত কেন ?
স্বাধীন ভারতে, গান্ধীর ভারতে সত্যিই তো এতো রক্ত কেন?
অবশ্য অহিংস গান্ধীকেই স্বাধীন দেশে ঘাতকের হাতে
প্রথম রক্তের আলপনা আঁকতে হয়েছিল এ দেশের মাটিতে।
স্বাধীনতার জন্য মনে তো হয়না এতো রক্ত
দিতে হয়েছিল, যত রক্ত স্বাধীন ভারতে
স্বাধীন নিরীহ মানুষকে দিতে হয়
দেশের মাটিকে ভেজাতে রক্তস্রোতে।
এ কেমন স্বাধীনতা তুমি বুঝতে পারনি,
আমরাও পারিনা তা বুঝতে এই মুক্ত দেশে
স্বদেশী ভাইয়ের রক্ত অহিংসার নীতিতে
কোন অধিকার বলে ঝরায় প্রতিটা দিন?
নাকি অহিংসার অনিবার্য পরিণাম হিংসার উন্মত্ত তাণ্ডব!
তখনো তো নন্দীগ্রাম নেই প্রেক্ষাপটে,
নেই মুম্বইয়ের সেই রক্তঝরা রাত ২৬ / ১১- র,
আমেদাবাদের মসজিদের ভয়ঙ্কর সেই
বিপুল ধারার রক্তস্রোত হয়নি প্রবাহিত।
তারও আগে যা ঘটেছিল তাতেই তোমার কণ্ঠ উপচে
ঝরেছিল রাশি রাশি উদ্বেগ আর বেদনার ধারা।
আফ্রিকার কালো মানুষের অধিকার আর
খণ্ড খণ্ড রাজ্য মিলে সুসংহত বিশাল স্বাধীন দেশ
স্বাধীন দক্ষিণ আফ্রিকার যে অদ্ভুত উত্থান—
এতো রক্তের উৎসারে মত্ত হয়েছিল বলে মনে তো হয়না।
প্রিয় মাদিবা, আফ্রিকার পিতা তুমি, তোমাকে দেশের গান্ধী আখ্যা দিয়ে
এখন চুপিসাড়ে আরেক সাম্রাজ্যবাদ
তোমাকে নতুন ব্যাখ্যায় আখ্যা দিতে তৎপর।
জীর্ণ ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদ পিছু হটার পর—তাই ভীত হই।
তোমার স্বদেশের উত্থানে আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস কেবল ছিলনা,
ছিলনা শুধু অহিংস আর অসহযোগ আন্দোলন,
উমাখাণ্ডো উইসিজওয়ে- দেশের বল্লম! সর্বাধিনায়ক তুমি!
সশস্ত্র উত্থান তো আফ্রিকার গান্ধীর অহিংস আন্দোলন নয়!
সাতাশটি বছর বর্ণদ্বেষীর কারাগারে বন্দি থেকেও
‘ স্বাধীনতার সনদ’ –এর স্রষ্টা তুমি, পতন ঘটালে
সাদা চামড়ার কঠিন আগ্রাসী শাসনের,
ছিনিয়ে আনলে স্বদেশের মুক্তি!
অহিংস পথে দেশকে স্বাধীন করা যাবেনা
গান্ধীকে শ্রদ্ধা করেও অনুভব করেছিলে—
কমিউনিস্ট তুমি জেগে উঠেছিলে
জেগে উঠেছিল আফ্রিকার কালো মানুষ,
তাই প্রয়োজন পড়েছিল গেরিলা বাহিনীর যুদ্ধের।
বন্দি থেকেও আদালতে নিজের সওয়াল-জবাবে
সজোরে ঘোষণা করেছিলে সন্ত্রাসবাদী নয় কালো মানুষ—
সন্ত্রাসবাদী তারা ঐ মসনদে আসীন সাম্রাজ্যবাদীরা
কালো আদমীর সম্পদের লুঠেরা বর্ণবিদ্বেষী,
মনুষ্যত্ব আর স্বাধীনতার পদদলনকারী
ঐ ঘৃণ্য হার্মাদবাহিনী সবচেয়ে বড় সন্ত্রাসবাদী।
সত্যকে অনুভব করেছিলে বলে সাতাশটি বছর
সাতাশটি বসন্ত তোমার কারাগারের কুঠুরিতে বন্দি হলো—
তবু কি বন্দি হলো? ওরা বুঝতেও পারেনি
বিশ্বময় ব্যাপ্ত হয়ে গেলো! দুনিয়াজোড়া শোষিত বঞ্চিত
আর লাঞ্ছিত অপমানিতদের মনের ভালবাসার
বিশাল প্রান্তরে প্রান্তরে এক প্রত্যয় সুবিশাল প্রত্যয়
নাম তার নেলসন ম্যাণ্ডেলা!
তারপর মুক্তিও এসেছিলো, মানুষের বিজয় হয়েছিলো—
আর স্বাধীনতার লাল সূর্যটা নিয়ে মেরুদণ্ড খাড়া করে
কালো কালো মানুষগুলি লোফালুফি খেলায় মেতে উঠেছিলো।
মুখে নির্ভয় আলোর ছটার মত ঝলোমল হাসি
কালোকে আলো করার মন্ত্রগুপ্তি
প্রিয় মাদিবা, দু’টি সত্যকে অনুভব করেছিলে তুমি—
সাম্রাজ্যবাদ অবিনশ্বর নয় মুক্তি অবশ্যই
এই জীবনেই পাওয়া যাবে। হলোও তাই।
তোমার দ্বিতীয় উপলব্ধ সত্য পরাজিত য়ুরোপীয় সাম্রাজ্যবাদের
পেছনে ওৎ পেতে আছে বন্ধুত্বের মুখোশ পরে
আরেক বিশ্বগ্রাসী সাম্রাজ্যবাদ
এশিয়া আফ্রিকার নতুন স্বাধীন দেশগুলিকে
গ্রাস করবে সমস্ত সম্পদ শুষে নেবে বলে।
তৃতীয় বিশ্বের পরম শত্রু সেই সাম্রাজ্যবাদ
ভয়ানক ধূর্ত আর ক্ষমতা কেড়ে নেবার কৌশলী নেকড়ে!
মাদিবা প্রিয় মাদিবা,আজ থেকে পঞ্চাশেরও বেশী বছর আগে
তোমার উপলব্ধ সেই সত্য আজ সম্মুখে।
তোমার আমার দেশের সম্পদ লুঠ হয়,
তোমার আমার স্বদেশের স্বাধীনতা
আজ আবারো বিপন্ন।
প্রিয় মাদিবা, তোমাকে দেখে ও জেনে
উদীয়মান বিশ্বের দেশগুলিকে সংঘবদ্ধ হতে হবে।
আর জনগণকে আসন্ন শংকাতুর কালের
সংগ্রামী যোদ্ধা হতে হবে, প্রত্যেককেই
হতে হবে নেলসন ম্যাণ্ডেলা।
নেলসন ম্যাণ্ডেলা মানে সংগ্রাম
নেলসন ম্যাণ্ডেলা মানে প্রতিরোধ
নেলসন ম্যাণ্ডেলা মানে মানবমুক্তির গান,
মানুষের স্বাধীনতার গান, শোষণমুক্তির স্বপ্ন!
কাজরী,
ডিসেম্বর ১৬ / ২০১৩
......................................................
আবৃত্তি শুনুন বদরুল আহসান খানের কন্ঠে --- শোষণ মুক্তি আর স্বাধীনতার গান
Darun
উত্তরমুছুন