সুনীতি দেবনাথের কবিতা " ত্রিবেণী সঙ্গমে " ও একটি সাধারণ ভাবনা
আলোচক — রূপক বড়ুয়া
কি অসাধারণ দক্ষতায় কবি সমাজ জীবনের কথা ভাবলেন, ভাবলেন প্রচলিত ধর্মীয় অনুশাসনের কথা সচরাচর প্রথা, কবি সেই অনুশাসন থেকে বের হয়ে আসতে চাইলেন সাহজিকভাবে ;
"ত্রিবেণী সঙ্গম
গঙ্গা যমুনা আর ফল্গুধারা সরস্বতী
ভারতাত্মার পবিত্রতমা তিনটি নদীর মিলিত ধারা!
কোমর জলে সেদিন ডুব দিয়ে বারবার সামনে তাকালাম
আজ পরম্পরা মাফিক গর্ভধারিণী জননীর অস্থি বিসর্জন দেব।
বহু যুগ পেরিয়েও কেন সংস্কারের শিকল ছেঁড়া সুকঠিন
অতি সুকঠিন থেকে গেল ভেবে ভেতরে উন্মত্ত ঝড় ফুঁসছিল!
তবু সেই শীতের ভোরে কী এক জ্বালা জুড়োতে ডুব ডুব বার বার—
মাথা উঁচু করে সামনে তাকিয়ে জবাকুসুম সঙ্কাশ মহিমান্বিত সূর্যদেব!"
আবার কেন জানি সে শৃঙ্খল ছেড়ে ও অবমুক্ত হতে
পারলেন না, সেই প্রথাকে আকড়ে ধরে সুর্যের আলোক
প্রভায় নমিত হলেন, উদ্ভাসিত হলেন প্রভাতের আকা
নরম আলোতে, সহজ সাবলীলভাবে বললেন ;
"মনে হল এমন সকাল এই প্রথম পৃথিবীতে প্রস্ফুটিত হল
এ এক অদ্ভুত জ্যোতির প্রথম প্রকাশ অনির্বচনীয় অনন্য
অজান্তে আমার কম্পিত দুটি করপুট জোড় হয়ে গেল—
আমি ধর্মের সংস্কার বা কুসংস্কারে,
রীতি রেওয়াজে কোনদিন সম্পৃক্ত থাকিনি
সেই আমি কোন সম্মোহনে
জানিনা আচ্ছন্ন হয়ে গেলাম ,আমার অস্ফুটকণ্ঠে
উচ্চারিতহলো , হে সূর্য আদিত্য পুরুষ,আলোময় প্রকাশ
তোমার রশ্মিপাতে আমাকে আলোকিত করো,
সব মালিন্য পার করে আমি আলোময় সত্তার গভীরে
এই বিশালতায় ডুবে যেতে চাই।
আমার চোখ দুটি অজান্তেই বুজে গেলো
সমগ্র আমিত্ব আমার এক হলো,
ত্রিবেণীর ধারাস্রোতে রশ্মিস্রোত একাকার হয়ে
আমাকে জড়িয়ে পরম মমতায় এক অদ্ভুত খেলায় মাতলো"
কবি চললেন এক অনাদির দিকে, কি অনন্য গভীর
অনুভূতিতে তিনি বললেন :
"আমার সামনে দোলে উঠল,
কোন কালের ওপার থেকে
বর্তমানের উন্মুক্ত প্রসারে বিস্তৃত এক মহামানবের ধারা
এক অনাদি চলিষ্ণু স্রোত সঙ্গমে এসে মিলেমিশে একাকার।
চলিষ্ণু এই ধারা অতীত অন্ধকার থেকে যাত্রা শুরু করে
মহা পাদ-পরিক্রমায় বর্তমান থেকে ভবিষ্যতের পরিধি
ছুঁয়ে আছে।"
কবি উপলব্ধির চরম মাত্রায় উঠলেন, সামগ্রিকভাবে আমি সর্বোপরি এই আমি, আমিত্ব থেকে বের হয়ে আসতে চাইলেন, নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে অসীম আলোর মাঝে খুঁজে পেতে চাইলেন ;
"আমি তো আর আমি নই বিশাল সমগ্রে ক্রমে
বিলীন হয়ে যাওয়া কী এক অনুভূতি, কী তা জানিনা!
মনে হলো আমার সমগ্র দেহ চোখ মুখ সারাটা অবয়ব
অলৌকিক অন্য আলোয় অভিষিক্ত হলো,
আমার আমি অন্য অনুভবে উঠলো কেঁপে,
এই আমি আমি নই
বিশাল এক সমগ্রে ধীরে ধীরে যেন বিলীন হয়ে যাচ্ছি
কোন সে বিস্মৃত কালে কোন এক বিশাল আমি
বিচ্ছিন্ন সব আমিকে গ্রাস করে গড়ে উঠেছি অনন্য আমি। "
তারপরে ও কবির ভাবনা থেমে থাকেনি ভাব আর শব্দের তারল্যে জীবনের চরম সত্য অর্থাৎ জন্ম সত্য
মৃত্যু সত্যকে প্রত্যক্ষ গোচরে এনে দেখলেন কালের
অন্তিম যাত্রায় দেহকণা অনন্তে বিলীন হয়ে যাওয়ার
প্রবণতাকে দেখলেন অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে ;
"এই আমি কাল কালান্তরে প্রশ্ন করেছে
জন্ম সত্য জীবন সত্য মৃত্যুও সত্য প্রত্যক্ষ গোচরে।
তারপর? তারপর কি অজস্র অসংখ্য প্রাণকণা
নক্ষত্রের মত একত্রিত হয়ে মিশে যায় আকুল প্রার্থনায়
বিবিক্ত বোধের চিরন্তন এককে?"
কবির অতলান্ত ভাবনা সপ্রাণ অনন্ত জিজ্ঞাসা কবি
হৃদয়কে আলোড়িত করেছে,তিনি আপনাকে বারবার
নিজেকে, নিজের অস্থিত্বকে সীমাবদ্ধ গন্ডি থেকে বের
করে অসীমের মাঝে খোঁজার চেষ্টা করলেন ;
"প্রাণের চলমানতার বিপুল চেতনায় আমার আমিকে
অহংকে যুক্ত করলো জানালো আমি কেউ নই
বহুযুগের অত্যাশ্চর্য এক বিশ্বাসের কণামাত্র!
মনে হলো জন্ম জীবন মৃত্যুর তোরণ পেরিয়ে
সেই প্রাণকণা পৌঁছে যায় সেই বৃহৎ আমিতে।
আর সেই বৃহৎ আমির রহস্য সেদিন ত্রিবেণী সঙ্গমে
প্রভাতী সূর্যের প্রথম আলো আমার অনুভূতির
তারে তারে অতীন্দ্রিয় ঝঙ্কার তুলেছিলো।
এই আমি সীমায়িত আমি ক্ষুদ্রত্বের বন্ধনে বাঁধা
মহাকাশ তলে ত্রিধারার সঙ্গমে বিভাষিত আলোর মহিমায়
ক্রমশঃ গলে গলে আরেক অস্তিত্বের ঘরে প্রবেশ করছি।"
তাই কবি ছুটে চললেন অসীমের মাঝে অন্তঃসত্তা দিয়ে অনুভব করলেন কালের গহীনে বিলীন হয়ে যাবার কথা, অসীমে লীন হয়ে যাওয়ার এক অপার আনন্দে অবিভূত
হয়ে পড়লেন, পুলকিত হয়ে বলে উঠলেন :
"যেখানে জন্ম – জীবন- মৃত্যু কালের ছন্দে নেচে নেচে
চরম পরম একে মিশে যায়, নেই আর পৃথক সত্তা
অস্তিত্বের দ্বন্দ্ব নেই বিক্ষুব্ধ যাপন সংগ্রামও নেই।
সেই পরম বৃহৎ সত্তার স্বরূপ সে মুহূর্তে সম্পূর্ণ মূর্তিতে
প্রকাশিত হলো সুখ দুঃখ আনন্দ বেদনা রহিত রূপে
আমি সেই নির্লিপ্ত ব্যাখ্যাতীত আনন্দ প্রবাহে
সমগ্র আমিকে নিয়ে একীভূত হয়ে যাচ্ছিলাম।"
কবি সব উপলব্ধির মাঝে খুঁজে পেলেন তার প্রশ্নের
সমাধান, পেলেন কাঙ্খিত উত্তর, যা তিনি খুঁজে পেয়েছেন, তিনি উৎফুল্ল হলেন ;
"সে মুহূর্তে মনে হলো জীবনই তো চরম পরম প্রাপ্তি
একবারই মেলে যা, এই পথে এগিয়ে যেতেই হয়
যায় না তো ফেরা । আমার আমিত্ব আর বিশ্বের সাথে
গভীর আত্মীয়তার মহান সে উপলব্ধি জীবনই তো দেয়
অন্য কেউ অন্য কিছু নয়,নেই শক্তি কারো
এই প্রাপ্তির মূল্য শোধিবার।"
অসাধারণ লিখলেন কবি, চমৎকার শব্দশৈলী, অনন্য চিন্তা চেতনায় কবিতা সৃজিত। কবিতা আগাগোড়া মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখলে ও কবিতার শেষের দিকে হিন্দী ভাষার ব্যবহার কেন জানি আমার বাংলাভাষার মাঝে
অন্য ভাষার অনুপ্রবেশ কেমন মনে হলো। যে অপূর্ব
শব্দযোজনা, ছন্দের ঝংকার, গভীর অনুভূতিতে বিজাতীয় ভাষার অনুপ্রবেশ খাপছাড়া লাগলো বলে মনে হলো। তবে উপমা উপমাই এর বিকল্প থাকলে ও কেমন করে যেন কবিতায় মানান সই হয়ে গেলো।
কবিতা অনবদ্য, অনুপম।
মুগ্ধ...... কবি
0 comments: