কবি সুনীতি দেবনাথের ' সেই শেষ দিনে ' কবিতার অনুপুঙ্খ পর্যালোচনা
কবি সুনীতি দেবনাথের ‘সেই শেষ দিনে’ কবিতার অনুপুঙ্খ পর্যালোচনা
রুবেল পারভেজ
কবি সুনীতি দেবনাথের ‘সেই শেষ দিনে’ কবিতাটিতে দাসপ্রথার নির্মমতার করুণ ভয়াবহ চিত্র ফুটে উঠেছে।
খ্রিস্টপূর্ব ৪০০০ থেকে ৩০০০ সালে মেসোপটেমিয়ায় প্রথম ক্রীতদাস প্রথা চালু হয়। মানুষ পশুর অধম বিবেচিত হতো। এর হাজারখানেক বছর পর থেকে এই প্রথা মিসর হয়ে ছড়িয়ে পড়ে ভারতবর্ষে।
১৭৮০ সালে দক্ষিণ আমেরিকায় একজন কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাসের দাম ছিল যেখানে দু’শ ডলার, সেটি ১৮১৮ সালে হয়ে দাঁড়ায় এক হাজার ডলার, ১৮৬০ সালে দাম বেড়ে হয় আঠারোশ’ ডলার। এমন লাভজনক ব্যবসা কে হারাতে চায়! এ জন্য ১৫১৯ থেকে ১৮০৭ সাল পর্যন্ত আমেরিকার উপনিবেশগুলোতে আফ্রিকা থেকে দাস আনা হয়েছে কমসে কম ৫০,০০,০০০। মানুষ বেচাকেনার জন্য হাট-ও তো চাই। এথেন্স, রোমের পাশাপাশি দিল্লি, গোয়া, কলকাতা, হুগলিতেও বসত ক্রীতদাসের হাট। দিল্লিতে যখন চৌদ্দ সের গমের দাম তিন আনা, তখন একজন ক্রীতদাস শ্রমিকের দাম ছিল দশ-পনের টাকা। ১৮৪৭ সালে ‘মারিয়া’ নামের একটি জাহাজের পঞ্চাশ ফুট দীর্ঘ আর পঁচিশ ফুট চওড়া একটি খোলে পাওয়া গিয়েছিল ২৩৭ জন দাস। ‘ব্রুকস’ জাহাজের একশ ফুট লম্বা আর পঁচিশ ফুট চওড়া একটি খোলে ঢোকানো হয়েছিল ৬০৯ জন দাস। ব্রুকস-এর ক্যাপ্টেন খোলের ভিতর বসিয়েছিলেন আরও একটি তক্তা, তাতে দুই ফুট উঁচু খোলে ধরানো হয়েছিল দুই প্রস্থ মানুষ। সোজা হয়ে শোয়া তো দূরের কথা, পাশ ফেরারও উপায় ছিল না। এভাবে ব্রুক্সসের দাসদের থাকতে হয়েছিল টানা দশ সপ্তাহ। মল-মূত্র-কফ-থুথু-বমি সব জড়ো হতো ওখানেই। এমন অনাচার সহ্য না করতে পেরে অনেক সময়ই আত্মহত্যা করতে চাইত ক্রীতদাসরা। তারা খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দিত মরার জন্য। কিন্তু এত সহজে তো লোকসান দিতে রাজি নয় জাহাজের ক্যাপ্টেন। তাই প্রত্যেক জাহাজেই রাখা হতো বিশেষ একটি যন্ত্র, যার সাহায্যে দাসের ঠোঁট কেটে দাঁত ভেঙে পেটে নল ঢুকিয়ে খাইয়ে খাইয়ে বাঁচিয়ে রাখা হতো। একবার এক শিশু দাস কোনোমতেই খেতে রাজি না হওয়ায় চাবুক মেরে হত্যা করা হয় তাকে। তারপর ওই শিশুর মাকে বাধ্য করা হয় সন্তানের মৃতদেহটিকে সাগরের বুকে নিক্ষেপ করতে। শাস্তি দেবার জন্য খোলের ভিতর বন্দি দাসদের শরীরে নল দিয়ে ছিটিয়ে দেওয়া হতো ফুটন্ত পানি।
১৯৯৩ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পাওয়া মার্কিন লেখিকা টনি মরিসনের লেখায় আফ্রিকান-আমেরিকান চরিত্রগুলো মুখ্য হয়ে ওঠে। ১৯৭০ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘দ্য ব্লুয়েস্ট আই’। এক কৃষ্ণাঙ্গ তরুণীর কাহিনী এই উপন্যাসে বর্ণনা করা হয়েছে। এছাড়া তাঁর আরও একটি গল্পে কৃষ্ণাঙ্গদের ভয়াবহ জীবনের চিত্র অংকিত হয়েছে। সেই গল্পের ছায়া অবলম্বনে লেখা কবি সুনীতি দেবনাথের ‘সেই শেষ দিনে’ কবিতার প্রেক্ষাপট।
এই কবিতায় উল্লেখিত কাল্পনিক চরিত্র চিত্রণের মাধ্যমে দাসপ্রথার নৃশংস অত্যাচারের করুণ কাহিনী কবিতায় বর্ণিত হয়েছে খুব হৃদয়বিদারকভাবে।
আফ্রিকা থেকে দাসদের আনা হতো ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে। তাদেরকে সন্তানসহ বিক্রি করে দিত। সন্তানও হয়ে যেত ক্রীতদাস। পুরুষদের বলা হত ‘দাস’ আর মেয়েদের ‘দাসী’।
কবিতায় বর্ণিত হয়েছে এক আফ্রিকান কৃষ্ণাঙ্গ নারীকে দুটি সন্তানসহ শ্বেতাঙ্গদের কাছে বিক্রি দেওয়া হয় চির পরাধীন অত্যাচারিত জীবনের ঘানি টানতে। একদিন কৃষ্ণাঙ্গ জননী তার ছোট্ট ছেলে শিশুটিকে নিয়ে কাজ করছিল প্রখর রৌদ্রে দাবদাহ সূর্যকে উপেক্ষা করে। আর অদূরে গাছের ছায়ায় তার পাঁচ মাসের ছোট্ট কন্যা সন্তানটিকে ঘুমিয়ে রেখে। কাজের এক ফাকে খুব সন্তর্পণে এদিক সেদিক তাকিয়ে কাঠফাটা রোদের জননী তার সন্তানটির মুখে তুলে দিচ্ছিল কাঠের মত শক্ত এক টুকরো রুটি। ঠিক তখনই- “ওরা এলো দুর্ধর্ষ তাতার বাহিনীর মত, /এলো নরক থেকে আসা ভয়ঙ্কর সেই /মৃত্যু পরোয়ানা নিয়ে যমদূতের মত”। তারপর শ্বেতাঙ্গ মণিব চাবুক দিয়ে দাসীটিকে এবং জন্মসূত্রে ক্রীতদাস ছেলেটিকে চাবুক দিয়ে প্রচণ্ড রুদ্র বেগে মারতে থাকে। মায়ের ঠোঁট থেকে ঝরে পড়লো রক্ত, মা প্রাণপণে তার ছোট্ট শিশুটিকে তার বুকে আগলে রাখতে চেষ্টা করলো। প্রচণ্ড চাবুকের আঘাতে শিশুটি আর্তনাদ করতে লাগলো। শিশুটির আর্তনাদের প্রকম্পিত হল আকাশ বাতাস।
সাদা জানোয়ারদের বুটের আঘাতে রক্তাক্ত দেহটা পড়ে মাথা থেতলে গেলো। অত্যাচারের আতিশয্যে এক সময় থেমে গেল শিশুটির কান্না। শিশুটি প্রাণ দিল দাসপ্রথার নির্মমতার শিকার হয়ে। তারপর মৃত শিশুটির শরীর ঘিরে শকুনের উল্লাস শুরু হল। এলো সারি সারি পিঁপড়ার দল, মাংসাশী কাঁকড়ার দল। খাবলে খেলো শিশুটির শরীর। মা তখন যন্ত্রণা আর প্রতিবাদের আগুনে জ্বলছে, কাঁপছে পৃথিবী। মায়ের সনির্বন্ধ আকুতি প্রকাশ পেয়েছে কবির আহত উচ্চারণ-“ইচ্ছে যেন /আর কোন শিশু বংশসূত্রে /ক্রীতদাস না হয়, আর কোন ক্রীতদাসী /না হারায় মা হবার পবিত্র অধিকার!
শিশুর মৃত্যুতে মা দিশাহারা দিগ্বিদিক শুন্য। অপ্রতিরোধ্য তার বেদনা আর অসহায়ত্বের করুণ আর্তনাদ। যখন শিশুটির শরীরে আর এক ফোটা রক্তও অবশিষ্ট নেই তখন কঙ্কালসার শিশুটিকে বুকে জড়িয়ে নতজানু মা বিদ্রুপে হেসে শিশুটিকে ভাসিয়ে দিল সমুদ্রে, মুক্ত করে দিল তার ক্রীতদাস শিশুটিকে। সেদিন এই মর্মান্তিক দৃশ্য দেখেছিল আকাশ, দেখেছিল সমুদ্র। সেদিন আটলান্টিক পেরিয়ে ক্যারিবিয়ান দ্বীপে, সমগ্র মানব সভ্যতাকে ধিক্কার জানিয়ে “ইক্ষু ক্ষেতে রচেছিল ভিন্নতর ইতিহাস, /মুক্তির আকাঙ্ক্ষার ভয়ঙ্কর সুন্দর ইতিহাস”।
পুত্রের অসহায় মৃত্যু মাকে বেপরোয়া করেছিল। মুক্তির নেশা পেয়ে বসেছিল কৃষ্ণাঙ্গ জননীকে। তাই তার কন্যা যাতে ভাবীকালের ক্রীতদাসী না হয় এজন্য মেয়েকে হত্যা করে তাকে মুক্তি দিতে চায়। মা দাসত্ব মুক্তি চায়, সন্তানকেও মুক্তি দিতে চায়। সেদিন মৃত্যু ছিলো একমাত্র পথ। নারীত্ব ও মাতৃত্বের দ্বন্দ্ব। বিজয় হল মাতৃত্বের। অদূরে গাছের নীচে শুয়ে থাকা পাঁচ মাসের শিশু কন্যাটিকে বুকে জড়িয়ে ধরে কপালে শেষ চুম্বন একে দেয় মা। এরপর মা একবার নিষ্পলক শেষ দেখা দেখে নেয় মেয়েটিকে। তারপর ‘ইক্ষু কাটারির কোপ গলায় দিল তার’, ‘তারপর নিষ্কম্প হাতে নিজকণ্ঠে’ কাটারির ঘাতে নিজেই আত্মহত্যা করে মুক্তির স্বাদ নিয়েছিল কৃষ্ণাঙ্গ জননী। সভ্যতার নির্মমতার সেই দাসপ্রথা থেকে চিরতরে মুক্তি নিয়েছিল নিঝুম ঘুমের ঘরে।
কবি সুনীতি দেবনাথ একজন প্রাজ্ঞ ঋষি, ধ্যানস্থ কবি। প্রচণ্ড জীবনবোধ থেকে লেখা তাঁর ‘সেই শেষ দিনে’ কবিতাটি। কবিতার ক্লাইমেক্স শেষ হয়েছে এক কৃষ্ণাঙ্গ দাসী, তার পুত্র সন্তান আর কন্যা সন্তানের মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে। জীবনের বিষাদিত পরিণতি। এই মৃত্যু আমাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেয় দাসপ্রথার ভয়াবহ অত্যাচার, নিপীড়ন আর বীভৎসতার মর্মান্তিক কাহিনী। ইতিহাস আশ্রিত এই কবিতাটির চরিত্র কাল্পনিক হলেও বিষয়বস্তু বাস্তবিক। কবিতাটি শৈল্পিক বিচারে অনন্য। কবিতায় ব্যবহৃত চিত্রকল্প আর বর্ণনার ধারাবাহিকতা অনবদ্য। কবিতাটির ট্র্যাজিক পরিণতি পাঠকের মনে দাগ কেটে যায়। পাঠকের ভাবনার জগতে আলোড়ন সৃষ্টি করে। নিঃসন্দেহে কবিতাটি পাঠকের মনে স্থান করে নেবে বলে আমার বিশ্বাস।
0 comments: