লেখা-লেখি

ইতিহাসের বৃত্ত

৯:৪৯:০০ PM 0 Comments















       © সুনীতি দেবনাথ
          ১৮ এপ্রিল, ২০১৫

কিশোরী কন্যাটি আমার
জ্যামিতি বেশ ভালোই শিখেছিল
 —ত্রিভুজ বহুভুজ
আয়তক্ষেত্র বর্গক্ষেত্র পিথাগোরাসের সূত্র বৃত্ত
এসব ছিল নখদর্পণে তার।
ভূগোল পড়তে ভালবাসতো পৃথিবী
অনেকটা বৃত্তাকার বলে, গ্লোব নিয়ে
খুঁটিনাটি নটখট মজার বিষয় —
ওখানেও বৃত্তের ছড়াছড়ি ছিল যে!
ইতিহাস মৃত রাজা মানুষের কাহিনী!
ওসব তার একদম নাপছন্দ।
বলত জ্যামিতিই ভাল্লাগে মা!
বলতাম ইতিহাস পাঁতিহাস নয়
রাজহাঁস সোনা, ইতিহাস না জানলে
নিজেকে জানা অসম্ভব —
না বর্তমান না ভবিষ্যৎ কোন কালই
কোনদিনই স্বরূপে দেবে না ধরা।
প্রসঙ্গান্তরে  পাঁকাল মাছের মত
পিছলে চলা ওর কাছেই শিখতে হয়।
ওর প্রশ্ন ছুটেছে তখন আফ্রিকার কঙ্গো
থেকে আটলান্টিক পেরিয়ে
ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ ছুঁয়ে
লাতিন আমেরিকার বিশাল অববাহিকা
আদিম অরণ্যের ঘন অন্ধকারে,
এক জম্পেস লাফে পড়ল গিয়ে
নব্য সভ্যতার কেন্দ্রবিন্দু আমেরিকা
যুক্তরাষ্ট্রের হোয়াইট হাউসের সুউচ্চ
ছাঁদের পাটাতনে – ও মা, দেখো আমি
মহাকাশচারিণীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করছি!
ভালেন্তিনা তেরেস্কোভা,  প্রথমেই আপনি?
 স্যালুট! কল্পনা চাওলা,
প্রথম ভারতীয়! নাহয় ফেরা হলো না
এই নীলগ্রহের সবুজের প্রান্তরে
মৃত্তিকা নন্দিনী! আপনার জন্য  গর্বিত!
সুনীতা উইলিয়ামস্! ধন্যি মেয়ে আপনি
সাত সাতটি বার ভ্রমণে ক্লান্তি আসেনি,
কত রেকর্ড গড়লেন! মহাকাশ ঘরবাড়ি?
শ্বেতলানা সাভিত্স্কায়া, প্রথম
স্পেস্চারণার সেই অবর্ণনীয় অনুভূতি
আপনাকে কি উত্তেজনায় থরথর কাঁপালো?
ঠিক করে বলুন চোখে জল?
স্যালি রাইড মহাকাশ কি আপনার
দেশ আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে সুন্দর
আর ওখানকার বৃত্তের পরিধি জানেন?
সামান্তা ক্রিস্টোফরেত্তি ইতালিকন্যা,
এই সেদিন বেড়িয়ে এলেন, হালচাল কি,
 কেমন সব? আবার কবে যাচ্ছেন?
তারপর অনবদ্য কৌশলে গ্লোবটা সে
ঘুরিয়েই চললো বনবন,  মহাকাশ এক
বিশাল বৃত্তের অলৌকিক জগৎ মা!
তোমার ঐ বস্তাপচা ইতিহাস নয় জানো
আমি ভালোবাসি  বৃত্ত বৃত্তাকার সব!

আমি ভাবছিলাম ইতিহাসের
পথ পরিক্রমার কথা, সেতো বৃত্তাকার নয়,
কেন জানি মনে হয় সে এক সুদীর্ঘ
প্রলম্বিত রেখা সরল সে নয় মোটেও,
আঁকাবাঁকা উঁচুনীচু গড়িয়ে চলেছে
সৃষ্টির শেকড় থেকে উদ্গত হয়ে কোন
সে অসীমের অনন্ত নিলয় সন্ধানে,
সে বৃত্তের পরিধি মেনে বৃত্তাকার নয়।
বৃত্তপ্রিয়া কন্যাকে আমার  কি করে
শেখাবো ইতিহাস আর তার গূঢ়তম
সত্যের চলমান পাদ পরিক্রমা ?
অকস্মাৎ বিদ্যুৎ ঝলক,  অন্য এক
আলোর উৎসারে জানা হয় গেলো
বৃত্তের পথে চলে ইতিহাস রেখায়িত হয়

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইংল্যাণ্ডের শিল্পবিপ্লব—
সম্পূর্ণ এক বৃত্তাকার বিস্ফোরণ! আশ্চর্য!
আমার কন্যা ইতিহাস পড়ে না।
ইতিহাসে কেন্দ্র পরিধির বৃত্ত সে পায় না
আফ্রিকার কঙ্গো অববাহিকা আটলান্টিক মহাসমুদ্র
ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ
লাতিন আমেরিকা
ম্যাসাচুসেটস
নিউইংল্যাণ্ড
একেকটি পরিধির বিন্দু বিন্যস্ত
কেন্দ্রে যুক্ত হলে সম্পূর্ণ হয় বৃত্ত।
লিভারপুলে দশটি ক্রীতদাস ব্যাপারী সংস্থা
সেদিন নিয়ন্ত্রণ করছিল বাণিজ্য।
তারপর তা সংক্রামিত হলো দূর দূরান্তে
ব্রিটেনের শিল্পবিকাশ যখন পূর্ণ হলো
জেমস ওয়াটের স্টিম ইঞ্জিন
জয় করলো ধমনির রক্ত সঞ্চালন
একচেটিয়া বাজার দখলে কৌশলী
ক্রীতদাস দরদী সেজে আফ্রিকার
ক্রীতদাস বোঝাই জাহাজের হানাদার
তখন উপনিবেশে সর্বোচ্চ কর্তা ব্রিটেন
আইন জারি করে এই প্রথার বিরুদ্ধে,
বাজার দখলের নতুন কৌশল?

আমেরিকা ফরমান মানেনি রমরমিয়ে
বেপরোয়া  চালায় মানুষ কেনা বেচার
নারকীয়  বাণিজ্য,  বড়দার হুমকি
তোয়াক্কা না করে চোলাই রাম বোঝাই
জাহাজ ছুটে চলে আফ্রিকার উদ্দেশ্যে।
কঙ্গোর অববাহিকার সেই কালো কালো
হাড় চামড়ার বোকা অরণ্যচারী মানুষ
রামের নেশায় মত্ত স্বগোত্রীয়ের চক্রান্তে
বিক্রি হয়ে ভেড়ার পালের মত
জাহাজ বোঝাই হয়ে চলে যেতো
ওপার সমুদ্রের ক্যারিবিয়ান দ্বীপমালায়,
ব্রাজিলের আখের ক্ষেতে আবার বিক্রি হয়ে —
মানব সভ্যতায় এরচেয়ে
কলঙ্কিত ন্যক্কারজনক আর কিছু নেই।
ওদের দেহে চাবুকের জ্বলন্ত চুম্বন
পেটের নাড়িভুড়ির দগ্ধ গন্ধ বাতাসে
কতজন খাদ্যথালা একবারও না দেখে
ঝাঁপিয়ে পড়েছে খাদ্য হয়ে হাঙরের মুখে
সমুদ্রের জলে শ্রেয় মনে করে।
শেকলের ঝংকারে হিসেবে কুলোবে কি?
বাকিদের ছেঁড়াকম্বলে ঢেকে
বলির পাঁঠার মত যত্নআত্তি করে
গতরে মাংসের পোঁচ লাগিয়ে
বিক্রি করা হতো ভেড়ার পালের মত
বাজারের গলিতে।
বিক্রি হতো মানুষ নামধেয়
ক্রীতদাসের দল দলেদলে।
তৈরি হতো গুড় ওদের শ্রমের পুরোটা প্রাণের রসে।

সেই ম্যাসাচুসেটেসে চোলাই হয়ে
গুড় আবার হয়ে যেতো রাম, চলে যেতো
আফ্রিকার অরণ্যে ছায়ায় আদিবাসীর
পল্লীতে ঝুপড়ির কোণে।
নিউজপোর্টাল বা প্লোভিদেনস হয়ে।
বৃত্তের মত চক্রায়িত অর্থনীতির চাকা
ঘুরতো বনবন উড়তো মাটি বায়ু আকাশে
টাকা ক্রীতাসের ঘাম রক্ত
আর প্রাণের বহুমূল্য রসায়নে।
পূর্ণ হতো নিখুঁত বৃত্ত।
আমার কিশোরী কন্যা হা করে শুনতো
পৃথিবীর আরেক ঘৃণ্যতম বৃত্তের কথা,
মার্কিনি শিল্প বিপ্লবের অন্তরতর বৃত্তের বৃত্তান্ত।
পরবর্তী কাহিনী জলবৎ তরলম্
এই বাণিজ্যের মুনাফা প্রোভিদেনসে
ব্রাউন ব্রাদার্সের ঢালাই কারখানা
বানায় বন্দুক আর আমেরিকার
স্বাধীনতা যুদ্ধে জর্জ ওয়াশিংটন
তা পরোক্ষে উপহার পেয়েছেন কালো
মানুষের রক্ত ও ঘামের দামে —
আমার কিশোরী কন্যার চোখে
কেঁপেছিলো আটলান্টিকের বিক্ষুব্ধ তরঙ্গের
উদ্বেলিত নিষ্ঠুর সংলাপ
জলদস্যু আমেরিকার জলে ডুবিয়ে
মারা জীবন্ত হাজারো আত্মার আর্তনাদ
ইতিহাসের ভয়ঙ্কর বৃত্ত স্পষ্ট থেকে
স্পষ্টতর বীভৎসতায় জেগে উঠেছিল।


SUNITI Debnath

আমি সুনীতি দেবনাথ, অবসরপ্রাপ্ত সরকারি শিক্ষিকা। কবিতা, প্রবন্ধ ও ছোটগল্প লিখি। কবিতা আমার প্রিয়ভূমি, শৈশব থেকেই হেঁটে চলেছি...

0 comments: