সুনীতি দেবনাথের 'ছেলেটি আর মেয়েটি কবিতার আলোচনা
পিনাকী হালদার
এ যুগের অন্যতম ব্যতিক্রমী কবি সুনীতি দেবনাথ তাঁর লেখা কবিতা 'ছেলেটি আর মেয়েটি ' কিছুদিন আগে মুক্তধারা সাহিত্য প্রবাহে পোস্ট করেছিলেন। তাঁর এই আশ্চর্য কবিতাটিকে বিশেষ শ্রেষ্ঠ কবিতা হিসেবে নির্বাচিত করা হলো।
অসাধারণ প্রতিভাসম্পন্ন সুনীতি দেবনাথ একালের অন্যতম সাহিত্যিক ও কবি । ওনার লেখায় বারবার ধরা পড়েছে এক ধরনের সার-রিয়েলিজম (surrealism). ওনার “ছেলেটি আর মেয়েটি” এই ধারার এক অনন্য নিদর্শন ।
“ছেলেটি কথা দেয় আগামী পূর্ণিমার প্রথম ভোরে প্রথম আলোয় মেয়েটিকে সে সাজিয়ে দেবে দেবেই গুচ্ছ গুচ্ছ কৃষ্ণচূড়ার স্তবকে স্তবকে।” – এখানে সেই ম্যাজিক রিয়েলিটির পূর্ণ স্বাদ পাওয়া যায় । কবি কল্পনা করেছেন ছেলেটি ও মেয়েটির প্রেম এমনই ঐশ্বরিক যে তা স্থান, কাল মানে না, শুধু ওদের নিজস্বতা, ওদের প্রেম, ওদের ভালোবাসা নিজ গুণে বয়ে চলে । এ এমনই সনাতন এক সূত্র যা কিনা সময়ের ব্যবধান পেরিয়ে জন্ম মরণের বাঁধা অতিক্রম ক’রে – এখানে ছেলেটি যে কেউ হতে পারে, মাটির মানুষ অথবা জড় সত্তা ; মেয়েটি হতে পারে প্রকৃতি কিংবা আলো-ছায়া ।
এই কবিতার Form “মায়া বাস্তবতা” আমাদের সচরাচর পৃথিবীতে যা আমরা অবাস্তব বলি, কিন্তু কল্পনায় হয়ত, সবাই এক-না-একদিন এই রকম প্রেম করতে চেয়েছেন । এরকম লেখা আগে দেখা গেছে লাতিন আমেরিকার নোবেল পুরস্কার বিজয়ী ঔপন্যাসিক গ্যাব্রিয়ল গার্সিয়া মার্কেজের উপন্যাস ' One Hundred Years of Solitude '-এ । শ্রদ্ধেয় মার্কেজ গার্সিয়া যে ধারায় লিখেছেন, কবি সুনীতি দেবনাথও নিজের মাতৃভাষা, বাংলায় ঠিক তেমনই “ম্যাজিক রিয়েলিটি” পরিবেশন করেছেন তাঁর এই লেখাটিতে ।
এখানে তিনি গল্প উপন্যাস নয়, কবিতার শৈলীতে বুঝিয়ে দিয়েছেন যে সাহিত্য কোনো বাঁধা মানে না ভাষার ; কল্পনা কোনো বাঁধা মানে না ভাষ্যকারের । শুধু শিল্প থেকে যায় চিরন্তন; কবির ভাষায় - “খোলা দরজায় হেলান দিয়ে কোণার্কের প্রতিমা! এরপর অসহনীয় প্রতীক্ষা” । এই প্রতীক্ষার কিন্তু কোনো নিয়ম নেই, কোনো লজ্জা, দ্বিধা নেই, ভুত-ভবিষ্যৎ আদি-অন্ত নেই । শুধু ভালোবাসাই পারে এরকম প্রতীক্ষা করতে ও করাতে; বুক জুড়ে দুরু দুরু ভয় আর তাঁর মাঝে আলপনার মতন, কিছু ছড়ানো ছেটানো - নিজের মনের মানুষটাকে একবার আবার কাছে পাওয়ার ইচ্ছা - পূর্ণতার প্রতীক্ষা । এই পূর্ণতা শারীরিক নয়, কারণ শরীরের চাহিদা মুহূর্তে শেষ হয়ে যায় – এটি মানুষের মনে যুক্তির মতন সনাতন । “আর মেয়েটি? ঝনাৎ ঝনাৎ কাচের টুকরো ভেঙ্গে ভেঙ্গে” ।
কবির মন কল্পনায় পাড়ি দেয় – “ছুটছে পক্ষীরাজ হুড খোলা জিপ ছুটছে নাকি উড়ছে নাকি বোল্ডার ছড়ানো পাহাড়ি পথে উঠছে নামছে দোল দোদুল দুলছে দুলছে যেন পার্কের দুরন্ত নাগরদোলায়, উড়ছে খোলা চুল উড়ন্ত আঁচল মনটা ছুটছে বাজছে দুরন্ত মাদল।” মেয়েটিও ছুটছে, এক অসীম বিপরীত মেরুর টানে – মাধ্যাকর্ষণ ছাড়িয়ে, ম্যাগনেটিক আকর্ষণ ছাড়িয়ে মহাজাগতিক শক্তিকে উপেক্ষা করে সে ছুটে যায় তাঁর প্রেমিকের কাছে । সেই ছেলেটি “ভ্যান গগ্ নাকি লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি? জানা হলো না!”, কারণ যখন সে তাঁর প্রেয়সী মানবীর ছবি আঁকলো, তখন “তার দীঘল গোছা চুলে সাজানো কৃষ্ণচূড়ার গুচ্ছ, ওডিসি নৃত্য মুদ্রায় এলিয়ে আছে বাহুবল্লরী অলক্তক সিঞ্চিত দুটি পা, আধবুজানো আঁখি দুটি!” – আর তারপর ? কবিতাটি পড়ে দেখুন, কথা দিলাম, এক অপূর্ব সুন্দর ঐশ্বরিক আনন্দ পাবেন, মুহূর্তে সৃষ্টি থেকে ইতিহাস হয়ে যাওয়ার আস্বাদ ও অভিজ্ঞতা পাবেন । স্বর্গ আর মর্ত্যে কোন ফারাক রইলো না, পরাতত্ত্ববাদ আর ঐহিকতার মেলবন্ধনে স্বর্গ মর্ত্য একাকার হয়ে গেলো!
একালের অসামান্য কবি সুনীতি দেবনাথ কে আমার নতজানু প্রণাম । আমরা আশা রাখব ভবিষ্যতেও যেন আমরা ওনার এরকম আরও লেখা পড়তে পারি । বাংলা ভাষা ও সাহিত্য যেন তাঁর এই প্রয়াসে আরও উন্নত হতে পারে । কবির দীর্ঘায়ু কামনা করি ।
----- পিনাকী হালদার
---------------------------------------
ছেলেটি আর মেয়েটি
---------------------------------------
© সুনীতি দেবনাথ
নীল সমুদ্রের চোরাবালিতে ডুবো পায়ে
সেদিন দৌড়োতে দৌড়োতে ওরা
হুমড়ি খেয়ে ঠিক পড়েছিল ঢেউয়ের কোলে।
তারপর ভিজে গেলো, ঢেউয়ে নাচলো
সাঁঝের ছায়াঘেরা অস্পষ্ট আলোয়--
টলেটলে ঢলেঢলে ফিরে গেলো ঘরে।
সেই চান্দ্রমাসে ছেলেটি কথা দেয়
আগামী পূর্ণিমার প্রথম ভোরে প্রথম আলোয়
মেয়েটিকে সে সাজিয়ে দেবে দেবেই
গুচ্ছ গুচ্ছ কৃষ্ণচূড়ার স্তবকে স্তবকে।
তারপর তারার আলোয় সে কী যুগল নৃত্য!
সেদিন পূর্ণিমার ভোর
আকাশের আঙিনায় লেগেছে লালের ছোঁয়া
সাতসকালে মেয়েটি ডুব ডুব দিঘীর জলে
স্নান শেষে সবুজ শাড়ি পরলো
হলুদ ব্লাউজে সোনালি চুমকির
চিকন কারুকাজ
কপালে হলুদ ছোট্ট এক চিলতে টিপ!
খোলা দরজায় হেলান দিয়ে কোণার্কের প্রতিমা!
এরপর অসহনীয় প্রতীক্ষা _
সকাল গড়ালো দুপুরে গনগনে আগুন সূর্য,
দুপুর ছুটলো ক্লান্ত বিকেলের ম্লানিমায়
সেতো এলোনা -- আর মেয়েটি?
ঝনাৎ ঝনাৎ কাচের টুকরো ভেঙ্গে ভেঙ্গে।
গেটের ওপাশে হুডখোলা পক্ষীরাজ জিপ
কত সফরের রোমাঞ্চ গায়ে মেখে!
ঝনঝনিয়ে উঠলো সারাটি শরীর ছুটলো মেয়েটি।
ছুটছে পক্ষীরাজ হুড খোলা জিপ ছুটছে নাকি উড়ছে
নাকি বোল্ডার ছড়ানো পাহাড়ি পথে
উঠছে নামছে দোল দোদুল দুলছে
দুলছে যেন পার্কের দুরন্ত নাগরদোলায়,
উড়ছে খোলা চুল উড়ন্ত আঁচল
মনটা ছুটছে বাজছে দুরন্ত মাদল।
ওখানে যেতে হবে যেতেই হবে
পাহাড়ের খাঁজে নিচে ঝর্ণা ছলোছল নটিনী,
ওখানে সেই ছেলেটি ক্যানভাসে ছবি আঁকে
ওকি ভ্যান গগ নাকি লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি?
জানা হলো না!
মেয়েটির একটা ছবিও আঁকেনি সে, একদিনও না!
কি যে আঁকে সেই জানে।
মনে হয় দেখে আদিম মানবের গুহাচিত্র যেন
ছেলেটিকে মনে হয় বহুকাল আগের
সেই আধামানুষ, সেও নিজে তেমনি মানবী।
মন চাইতো বলে, আমাকে আঁকো না!
আর তখনই ভোরালি সিঁদুরে লজ্জা আঁকতো মুখে,
না বলেনি কোনদিন।
যখন আঁধার নামছে ভরা পূর্ণিমা নিটোল --
অরণ্য ঝর্ণা জ্যোৎস্না স্নানে মগ্ন
মেয়েটি কাঁপা পায়ে সিঁড়ি ভেঙ্গে চললো
পৌঁছে গেলো সেখানে, ডাগর চোখ আরো বড় করে তাকালো
সুবিশাল ক্যানভাসে সেই তো শুয়ে
অবিকল সে, তার দীঘল গোছা চুলে
সাজানো কৃষ্ণচূড়ার গুচ্ছ, ওডিসি নৃত্য মুদ্রায় এলিয়ে আছে বাহুবল্লরী
অলক্তক সিঞ্চিত দুটি পা,
আধবুজানো আঁখি দুটি!
সে যেন নারী নয় স্বর্গনদী সুরধুনী!
ছেলেটি শুয়ে আছে পদতলে
যেন দেবাদিদেব মহেশ্বর!
এ কী অপরূপ দৃশ্যপট!
মুহূর্তে সে ছবি হয়ে গেলো
গঙ্গোত্রী থেকে সহস্র ধারে আনন্দে তরঙ্গ তুলে সে নেমে আসছে
ভেসে যাচ্ছে দিগ্ দিগন্ত বেগের তাণ্ডবে,
আর হাসিমুখে ছেলেটি ছড়িয়েছে জটাজুট
মস্তকে ধারণ করছে বেগবতীর ধারা।
মেয়েটি গলে যাচ্ছে কেবলই যাচ্ছে,
ছেলেটি হাসিমুখে তাকে
জটাজুটে আটকে রাখছে শুধু রাখছে।
____________________________________________
সংযোজন : কবিতার মর্মগ্রহনে কবি সুনীতি দেবনাথের মত পারঙ্গমতা কম জনের পাই। তাই একটু বিস্তৃত জবাবে যাচ্ছি। ত্রিকাল আরো একটু এগিয়ে পরাতত্ত্বে যান, জাতিস্মর নয়। লাতিন আমেরিকার নোবেল পুরস্কার বিজয়ী ঔপন্যাসিক গ্যাব্রিয়ল গার্সিয়া মার্কেজের উপন্যাস ' One Hundred Years of Solitude '-এ ' ম্যাজিক রিয়েলিজম ' বা ' মায়া বাস্তবতা ' নামে নতুন তত্ত্ব ব্যবহৃত হয়েছে। যাতে জন্ম থেকে জন্মান্তরে, কাল থেকে কালান্তরে, এমনকি পরলোকে অবাধ সঞ্চরন দেখা যায়। তিনি সাহিত্যের যে ফর্মে কাজ করেছেন কবি সুনীতি দেবনাথ, সে ফর্মে তা লেখেননি, চেয়েছেন কবিতার শৈলীতে তা প্রয়োগ করতে। এটা একটা সুন্দর প্রয়াস নতুন আঙ্গিকে কবিতা নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করার। যা এর আগে কোনও বাংলা কবিতায় লক্ষ্য করা যায়নি। কবি সুনীতি দেবনাথ এমনই একটি ব্যক্তিত্ব, যিনি কবিতার উপরে এর আগেও বিভিন্ন রকমের সফল পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছেন।
সাফল্য বিচার করবেন পাঠকসমাজ। ধন্যবাদ ও শুভকামনা কবিকে মুক্তধারা সাহিত্য প্রবাহের পক্ষ থেকে।
------- মৌসুমী মন্ডল।।
0 comments: