ঋদ্ধ সত্য অনুভবে আসে
© সুনীতি দেবনাথ
অবশেষে বহু যুদ্ধ শেষে সাদা পতাকা উড়ল-
এবার বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে প্রসন্ন সাক্ষাৎ।
এমনটাই ঘটে,ইতিহাসও সাক্ষ্য দেয়,
উদ্দাম ভয়ানক ঝড়ের শেষে কোনও একদিন আসে
অবশ্যই আসে, যৌবন তো চিরস্থায়ী নয়,
চিরস্থায়ী নয় যৌবনের দামালতার মত
আরও অনেক কিছু,অনেক মিথ্যে লড়াই ও বড়াই-
একদিন ঋদ্ধ হয়ে সত্য অনুভবে আসে-
জীবনের জন্য কবিতা, কবিতার জন্য লড়াই নয়,
মানুষের লড়াইয়ের দিনলিপির ভাষা কবিতা,
লড়াকু মানুষের উদ্যম আর প্রাণের ভাষা তা।
কবি কি প্রাত্যহিকতার তুচ্ছতা বা গ্লানির ঊর্ধ্বে?
কবির প্রাণে কি কেবল পার্থিব সবকিছুর
সৌন্দর্যসত্ত্বাই আলোড়ন তোলে?
উল্টো ছবির আবেদনে কি অবিচলিত তিনি?
সৌন্দর্যের যা কিছু উপাদান প্রকৃতি নারী শিশু
এবং অবশ্যই তালিকাটি বৃহত্তর হতে বাধ্য
মনন জগতের পাপ পুণ্য প্রেম রিরংসা কাম
নারী পুরুষের পারস্পরিক দেহ সম্পর্কিত
আকর্ষণ বিকর্ষণ- চিরকালীন চৌম্বকক্ষেত্র
এতো সব কিছু মিথ্যে হয়ে যাবে? সত্য নয় তা?
কিন্তু বন্ধু, এরপরেও তো কবিতার বিচরণ ক্ষেত্র
আরও বহু বিস্তৃত, মানুষের সঙ্গে সম্পৃক্ত যা কিছু-
তার সমাজ, তার অর্থনীতি, রাজনীতি সর্বোপরি
সবকিছুর মধ্যে চির অমলিন শাশ্বত মনুষ্যত্ব-
ব্যক্তি আমির অনুভূতির বিভূতি কি সমষ্টির বহির্ভূত কিছু?
আমি কি উচ্চ নীচ ভেদে জনতার অংশীদার নই?
জনতার স্পন্দিত প্রাণের আকুতি আর সংগ্রাম
কোনকালেই কি আমাকে বহির্ভূত রেখে পেয়েছে প্রতিষ্ঠা?
সমষ্টির অংশ হয়েও উচ্চে অবস্থানকারী মুষ্টিমেয় জন
শাসকের স্পর্ধায় উচ্চাসনে বসে নীচে থাকাদের,
চিরকাল সভ্যতার তুমুল সমারোহে সম্পদের সৃষ্টিকর্তাদের
শোষণের স্টিম রুলার চালিয়ে চূর্ণ বিচূর্ণ করেনি কি?
কবি, তখনো কি নিরুদ্বেগ থেকে নিজের মনে খেলা যায়?
একটুও বেদনা কি প্রাণে মোচড় দেয়না?
কবির হৃদয় কি গ্রানাইট পাথর?
কবির কবিতা কি নির্লিপ্ত বোবা হয়ে অভিনয় করে যাবেই?
জীবনকে দেখে ও জেনে উপলব্ধির গভীরতম প্রদেশে
সত্যকে প্রতিষ্ঠা দিতে হয় এই শুধু জানি।
নীচে থাকা মানুষের বিপন্ন অস্তিত্ব শুধু নয়
তাদের মানবিক দেনাপাওনার হিসেবটা
কবির চেয়ে অন্য কেউ, তিনি যত বড় সমাজতাত্ত্বিক
রাজনীতিবিদ্ বা অর্থনীতিবিদ্ হোন না কেন-
একেবারে সঠিকভাবে মেলাতে অক্ষম।
কেবল কবিই পারেন অন্তরাত্মাকে জাগিয়ে
অধিকারবোধে প্রতিরোধ সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করতে জনতাকে।
কবি চিরকালই মানুষের বিজয় বার্তার ঘোষক,
মানুষের বেদনা ও অপমানের প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর।
বন্ধু, আমি কোন ইজমের খবরদারি করছি না,
কোনও স্লোগানও দিচ্ছি না, অবশ্য এসব কথা
আঁতে লাগে বলে বহুলোক ‘ স্লোগান সর্বস্ব’ আখ্যা দেয়।
আমার কিন্তু হাসিই পায় চিরটা কাল রাজার নীতি রাজনীতি
আমাদের জীবনকে ছাঁচে ঢেলে নিয়ন্ত্রিত করেছে
আজও করছে, হ্যাঁ সত্যদ্রষ্টা কবি পলায়নবৃত্তির অকবি সবাইকে।
অথচ মাটির জন্য বেঁচে থাকার জন্য প্রতিবাদের অধিকার জন্মগত,
সেই অধিকারকে হরণ করতে কত ভণিতা,মিথ্যাভাষণ, শোষণ-
নানা কূটকৌশল প্রয়োগে চালাকদের অধিকার হরণ মহোত্তম কাজ!
আজ বেলাশেষে প্রদোষকালে
পূরবীতে বেজে উঠেছে বিষাদ তান।
বিশ্বব্যাপ্ত মানবিকতার চরম বিপর্যয়কালে
পার হয়ে আসা সুদীর্ঘ অতীতের প্রতিবাদী কবিদের
প্রতিরোধকামী সোচ্চার কণ্ঠকে রুদ্ধ করে দেবার প্রয়াস
স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়ে উঠছে-
পাবলো নেরুদা নিজ বাসভূমে বন্দি কি ছিলেন না?
তাঁর মৃত্যু তো আজো প্রহেলিকা- হত্যা নয়তো?
পল রবসনের গান কেবলই কি প্রতিধ্বনি তুলছে না
ওরা আমাদের গান গাইতে দেয় না , জীবনের গান গাইতে দেয় না!
কবিকে হত্যা করে,কারাগারে রুদ্ধ করে, নির্বাসনে দিয়ে
কোনকালে কেউ তাঁর উচ্চারিত উচ্চকিত কাব্যভাষা খতম করতে পারেনি।
কবিকণ্ঠ রুদ্ধ করার প্রয়াস যত প্রবল হয়েছে প্রবলতর শক্তিতে তা
সারা বিশ্বের নিপীড়িত শোষিত কণ্ঠে বলবান তেজীয়ান হয়।
আর তার দ্যোতনা উপলব্ধির বিশুদ্ধতায় অতীত থেকে বর্তমানে
বর্তমান পেরিয়ে অনির্দেশ্য আগামীর অভিযাত্রী হয়।
বন্ধু, সুবিশাল এই প্রাণপ্রবাহে নিজের সবটুকু নিয়ে
যোগ দিতে দ্বিধাতুর থাকার অবকাশ একটুও নেই।
কাজরী,
২৯ ডিসেম্বর, ২০১৩
0 comments: